ডিআইজি মিজানকে প্রত্যাহার

ডিআইজি মিজানকে প্রত্যাহার

ঢাকা, ৯ জানুয়ারি (জাস্ট নিউজ) : অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে বিয়ে করাসহ নানা অপকর্মের জন্য অভিযুক্ত পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমানকে প্রত্যাহার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।

মঙ্গলবার বিকালে মিজানকে প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) সহেলী ফেরেদৌস।

এদিকে পুলিশ সপ্তাহ শেষে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। সোমবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন- ডিআইজি মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্ত চলছে। তার অপরাধ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর পরই মঙ্গলবার ডিআইজি মিজানকে প্রত্যাহার করল প্রশাসন।

‘তুলে নিয়ে বিয়ে করলেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার!’ এমন শিরোনামে রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে।

মরিয়ম আক্তার ইকো নামে এক তরুণীর দেয়া সাক্ষাৎকারের এতে মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে তাকে তুলে নিয়ে জোরপূর্বক বিয়ে করাসহ পুরো ঘটনার রোমহর্ষক বর্ণনা দেন ইকো।

ইকো জানান, চাকরির জন্য বান্ধবীর পরিচয় সূত্রে এক মহিলার মাধ্যমে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মিজানুর রহমানের সঙ্গে প্রথমে মুঠোফোনে পরিচয় হয় মরিয়ম ইকোর। এরপর তিনি তাকে ফোনে কথা বলার সময় অশোভন ইঙ্গিত দিতেন। বোঝাতে চাইতেন তার প্রথম স্ত্রী বিদেশে থাকেন। তাকে নিয়ে সংসার করবেন না। ইকোকে তার খুব পছন্দ ইত্যাদি। কিন্তু এর মধ্যে কানাডা প্রবাসী এক ব্যক্তির সঙ্গে ইকোর বিয়ে প্রায় ঠিকঠাক হয়ে যায়। টেলিফোনে আড়ি পেতে যার আদ্যোপান্ত জানতে পারেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মিজান।

এরপর ক্ষমা চাওয়ার কথা বলে ১৪ জুলাই ইকোকে তাদের পান্থপথের বাসা থেকে এক রকম কৌশলে তার গাড়িতে তুলে জোরপূর্বক ৩০০ ফুট এলাকায় নিয়ে যান। সেখানে মারধর করে রাতে ইকোকে তার বেইলি রোডের বাসায় নিয়ে আসেন। সেখানে তাকে সুস্থ করার কথা বলে অসুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে ফেলেন। এ সময় সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারের ডাক্তার বন্ধু বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন গাজী শামীম হাসান উপস্থিত ছিলেন।

মরিয়ম ইকো পরদিন দুপুর ১২টার দিকে ঘুম থেকে জেগে দেখতে পান তার পরনে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মিজানের স্লিপিং ড্রেস এবং তিনি তার বেডরুমে। বুঝতে পারেন, তার সর্বনাশ হয়ে গেছে। এরপর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে আত্মহত্যা করবেন বলে দৌড়ে রান্নাঘর খুঁজতে থাকেন। এ সময় তাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারের দু’জন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী ও গাড়িচালক। ওদের ঠেলে ফেলে তিনি রাগে-ক্ষোভে-দুঃখে রান্নাঘরে ঢুকে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে ওড়নায় আগুন লাগিয়ে দেন। এ সময় খবর পেয়ে ডিএমপি কার্যালয় থেকে ছুটে আসেন মিজানুর রহমান। ইকোকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। আশ্বাস দেন তাকে দ্রুত তার বাসায় রেখে আসবেন। ইকোর প্রশ্নের মুখে তিনি আগের রাতে ড্রেস খুলে ফেলাসহ খারাপ আচরণের জন্য ক্ষমা চান। কিন্তু তাকে শান্ত করতে না পেরে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফেলেন। এভাবে ১৪ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত ৩ দিন মেয়েটিকে বাসায় আটকে রাখেন তিনি।

ইকোর বাবা বেঁচে নেই। খবর দেয়া হলে বগুড়া থেকে তার মা কুইন তালুকদার ১৭ জুলাই সন্ধ্যায় ডিআইজির বেইলি রোডের বাসায় এসে উপস্থিত হন। মেয়েকে কেন এভাবে আটকে রাখা হয়েছে জানতে চাইলে ডিআইজি মিজান ধমক দিয়ে বসিয়ে রাখেন। এরপর বলেন, এখান থেকে মুক্তির একটাই পথ আছে। তা হল আপনার মেয়েকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে। এতে মা-মেয়ে কেউ রাজি না হলে টেবিলে ব্যক্তিগত পিস্তল রেখে মা-মেয়েকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। অনেক বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে ৫০ লাখ টাকা কাবিনে মেয়েকে তার কাছে বিয়ে দিতে বাধ্য করা হয়। বিয়ে পড়ানোর জন্য মগবাজার কাজী অফিসের কাজীকে ডেকে আনা হয়। বিয়ের উকিল বাবা হন তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক গিয়াসউদ্দিন। এছাড়া সাক্ষী করা হয় দেহরক্ষী জাহাঙ্গীরকে। বিয়ের পর ওই রাতে মা-মেয়েকে ছেড়ে দেয়া হয়।

পরে লালমাটিয়ায় ৫০ হাজার টাকার ভাড়া ফ্ল্যাটে নিয়ে গোপনে সংসার শুরু করেন ডিআইজি মিজান। ওই ফ্ল্যাটের নিচে সাদা পোশাকে সার্বক্ষণিক পুলিশের দু’জন সদস্যকে পাহারায় রাখা হয়। এর ফলে ইকো এক রকম গৃহবন্দি হয়ে পড়েন। তার ব্যক্তিগত জীবন বলতে কিছু ছিল না। অনেকটা জেলখানার মতো। অনেক চেষ্টা করেও নিজের ভাইকে ফ্ল্যাটে রাখার অনুমতি পাননি। কথায় কথায় তাকে মারধর করতেন ডিআইজি মিজান।

এভাবেই কেটে যায় ৪ মাস। একদিন তিনি অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মিজানকে স্বামী হিসেবে পরিচয় দিয়ে অফিসে মুডে থাকা একটি ছবি ফেসবুকে আফলোড করেন। এতেই চরমভাবে ক্ষিপ্ত হন মিজানুর রহমান। এ ছবির বিষয়টি পুলিশের উপর মহলে জানাজানি হয়ে যায়। ফেসবুক থেকে দ্রুত ছবিটি সরিয়ে ফেলতে তিনি লালমাটিয়ার বাসায় ছুটে আসেন। সেখানে বিষয়টি নিয়ে স্ত্রী ইকো, শাশুড়ি কুইন তালুকদারের সঙ্গে তার চরম মাত্রায় বাকবিতণ্ডা হয়।

এদিকে সেপ্টেম্বরের এ ঘটনার পর তাদের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। ইকো সমাজিকভাবে ডিআইজি মিজানের স্ত্রী পরিচয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অটল থাকেন। এর মধ্যে তার বিরুদ্ধে স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় গোপন রেখে বাসা ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের মামলা করা হয়। এ মামলায় ইকোকে ১২ ডিসেম্বর পুলিশ গ্রেফতার করে। ১৩ ডিসেম্বর আদালতে হাজির করার পর তার জামিন আবেদন নাকচ হওয়ায় তাকে কারাগারে যেতে হয়। পরে তার বিরুদ্ধে ভুয়া কাবিন করার অভিযোগ এনে আরও একটি মামলা করা হয়।

এদিকে ডিআইজি মিজানের অপকীর্তি নিয়ে আজ মঙ্গলবার ‘অস্ত্রের মুখে সংবাদপাঠিকাকে তুলে নেয়ার সময় জনতার রোষানলে পড়েন’ শীর্ষক আরেকটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।

এই রিপোর্টে জানা যায়, ডিআইজি মিজানুর রহমান ফিল্মিস্টাইলে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের জনৈক সংবাদ পাঠিকাকে জোর করে গাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় জনতার হতে ধরা পড়েন। খবর পেয়ে পুলিশ এসে তাকে জনতার হাত থেকে উদ্ধার করে। সম্প্রতি রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী সংবাদপাঠিকার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, গত ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর কুড়িল এলাকায় দুর্ভাগ্যজনক এ ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, ডিআইজি মিজানুর রহমান আমাকে দেড় বছর ধরে ডিস্টার্ভ করছেন। আমার বাসা, অফিস সব জায়গায় সাদা পোশাকে পুলিশ ডিউটি রেখে আমাকে অনুসরণ করা হয়। তার কারণে আমার সংসার তছনছ হয়ে যাচ্ছে। বাসায় গিয়ে আমার স্বামীকে গুলি করার হুমকি দেন।

কিভাবে অস্ত্রের মুখে তুলে নেয়া হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি অফিস থেকে নিচে নেমে দেখি ডিআইজি মিজানুর রহমান নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। একপর্যায়ে তিনি আমাকে দেখেই তার ব্যক্তিগত অস্ত্র ধরে বলেন, তোকে আজ মেরেই ফেলব। আমি বললাম, ঠিক আছে আমাকে মেরেই ফেলেন। কারণ এভাবে যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না। এই জিহাদ (মিজানুর রহমানের গাড়িচালক) চলো আমাকে নিয়ে। দেখি কিভাবে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। এই কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে তিনি আমাকে নিয়ে গাড়িতে ওঠেন। যাওয়ার সময় তিনি আমার মুখে মলম জাতীয় কিছু একটা খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে জিহ্বায় মলমটি লাগতেই আমার শরীর শিহরিত হয়ে ওঠে। আমি আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিলাম। বিষয়টি বুঝতে পেরে আমি ডিআইজি মিজানকে বলি, এই তুমি আমাকে কী খাওয়াচ্ছ? তোমার উদ্দেশ্যটা কী। এ কথা বলতেই তিনি আমার গালে থাপ্পড় মারেন। এর পর আমি তার গাড়ির গ্লাস ভেঙে সাধারণ মানুষের সহযোগিতা চাই। কি মডেলের গাড়ি ছিল জানতে চাইলে সংবাদপাঠিকা বলেন, সেটি ছিল হেরিয়ার মডেলের গাড়ি।

(জাস্ট নিউজ/জেআর/১৬১৩ঘ.)