আমার বাবা নেই, মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে চাই

কোটা আন্দোলন নেতার মিনতি, আমাকে বাঁচতে দিন

কোটা আন্দোলন নেতার মিনতি, আমাকে বাঁচতে দিন

ঢাকা, ২৬ মে (জাস্ট নিউজ) : কোটা আন্দোলনের নেতা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী এপিএম সোহেল বলেছেন, আমাকে আবারো মারধরের হুমকি দেয়া হয়েছে। সবার কাছে করজোড়ে মিনতি আমাকে বাঁচতে দিন। আমার বিধবা মায়ের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে দিন। আমিই পরিবারের সব। বুধবার হামলার শিকার হওয়ার পর তিনি বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

নিজের নিরাপত্তা দাবি করে তিনি বলেন, আমি একটা এতিম ছেলে। আমরা আপনাদের সন্তান। আমরা বাংলাদেশের সন্তান। আমরাও বাঁচতে চাই। বিধবা মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। আমার বাবা নেই, আমার ভাই পিয়নের কাজ করে বাসায় টাকা দিত। কিন্তু সে এখন গ্রামে চলে গেছে। অন্যের জমিতে চাষ করে। আজ সকালে দেখি শুকিয়ে সে কাঠ হয়ে আছে। আমার ভাই ঠিকমতো কথা বলতে পারে না। খালি কাঁদে, আমার বিধবা মাও কাঁদে।

হাসপাতালে বেডে শুয়েই শুক্রবার দিবাগত রাতে তিনি লিখেছেন, কোটা আন্দোলনের জন্য দ্বিতীয়বার তাকে মার খেতে হয়েছে। প্রথমবার চড়-থাপ্পর ও লাথি মারা হয়েছিল। দ্বিতীয়বারের মারধরে ঠোঁটের বাইরে ৯টা ও ভেতরেও দুটি সেলাই লেগেছে।

সোহেল বলেন, ওরা আমাকে মারার সময় হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছিলাম। হাতেও ব্যথা। লিখতে কষ্ট হচ্ছে। ডান পায়ের হাঁটুতে ওরা অনেকগুলো আঘাত করে। পা সোজা কিংবা বাঁকা করতে গেলেই হাঁটুর জোড়ায় টান পড়ে।

তাকে মারধরের সময় হামলাকারীরা মশকরা করেন এই বলে যে ‘ভাইয়ের চেহারা খুব সুন্দর, আয় মাইরের আগে সেলফি তুলি’।

আমরা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শোভন তাকে প্রথম আঘাত করেন বলে তিনি জানান।

ফেসবুকে দেয়া তার স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে দেয়া হল:

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
ওয়ার্ড ১০১,বেড ১০।

আমি যে বেডে শুয়ে আছি। সেই বেডের কয়েক বেড পরই দুইজন আসামীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আসামীর নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক পুলিশের ২জন সদস্য। এই কয়দিন বিছানা থেকে উঠতে পারি নাই তেমন। পিঠের দাগগুলো কালো হয়ে আছে। প্রচণ্ড ব্যথা। ওরা মারার সময় হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছিলাম। হাতেও ব্যথা। লিখতে কষ্ট হচ্ছে যদিও। ডান পায়ের হাঁটুতে ওরা অনেকগুলো আঘাত করেছিল। পা সোজা/বাঁকা করতে গেলেই হাঁটুর জয়েন্টে টান পড়ে। আমাকে চারপাশে কয়েকজন ধরে রেখেছিল।

একজন সেলফি তুলতেছিল এই বলে যে ‘ভাইয়ের চেহারা খুব সুন্দর, আয় মাইরের আগে সেলফি তুলি।’

শোভন, আমরা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান, জবি শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলে, ‘কোটা আন্দোলন তো ভালই করতেছিস, কত টাকা-পয়সা পাইলি। আমাদের কিছু দিবি না’। আমি হাসতেছিলাম।

ঠাস করে একটা থাপ্পড় দিয়ে আমার গলা টিপে ধরে শোভন। মূহুর্তেই হাত-পা-মুখ- পিঠে কাঠ আর রডের আঘাত বৃষ্টির পানির মত। আমি ‘মা’ ‘মা’ বলে চিৎকার করতেছিলাম। মাথায় কয়েকটা আঘাত আসার পরেই মাটিতে পড়ে যাই। ওরা পিঠে ইচ্ছামত মারতে থাকে। আমি আর চিৎকার করতে পারতেছিলাম না। এত মাইর দিয়েছে যে কখন ঠোঁট কেটে দিয়েছে তা টেরই পাই নি। নাক-মুখ আর হাতে রক্ত আর রক্ত। আমার চারপাশটা ঘুরতেছিল।

শোভন, মিরাজ, মাহফুজসহ বাকি যারা ছিল ওদের কারো সাথেই আমার কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা কোনদিন ছিল না। ক্যাম্পাসে এই পর্যন্ত কোনদিন কারো সাথে আমি বেয়াদবি করি নাই। কারো সাথে উচ্চবাচ্য করি নাই।

আমি সাধারণ ঘরের ছেলে। খুব কষ্ট করে ছোটবেলা থেকে আজকের এই অবস্থানে এসেছি। স্যারদের সাহায্য, বন্ধুদের সাহায্য, বিভিন্ন সংস্থার বৃত্তি আর নিজের কষ্টে আজ হয়তো পড়ছি। জানি না আর পড়তে পারব কি না।

নিজে খুব কষ্ট করে বড় হয়েছি, তাই অন্যের কষ্ট আমার কাছে লাগত। আমি নিজ থেকে খুঁজে খুঁজে আমার মত যারা তাদের টিউশনি, কোচিং,পার্ট টাইম জব ম্যানেজ করে দিতাম। বিনিময়ে কোনদিন ১কাপ চা ও খাই নি। অথচ আমার নামে সাজিদুল নাঈমরা ফেক আইডি(Sadia Afrin) খুলে লিখেছে আমি নাকি দেহের বিনিময়ে টিউশনি দিতে চেয়েছি।

এমনকি আমাকে মারার পরেও প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছে আমাকে নাকি আরো মারবে, মাইর নাকি কম হয়ে গেছে। আমার ফ্রেন্ডের সাথে ঘোরার ছবি ইডিট করে বিভিন্ন ফেক আইডি দিয়ে তা ছড়াচ্ছে। ফেক ভিডিও বানিয়েছে। আপনারা চাইলে আমার ফ্রেন্ডদের সাথে কথা বলতে পারেন।

কোটা আন্দোলনের জন্য ২য় বার মারল আমাকে। প্রথমবার থাপ্পড়, লাত্থি। আর ২য় বার ত দেখতেই পাচ্ছেন, ঠোঁটের বাইরে ৮-৯টা সেলাই, ঠোঁটের ভিতরে ২টা সেলাই। আর সারা শরীরে ব্যথা ত আছেই। পিঠের মাইরের দাগগুলো এখনো স্পষ্ট। কোটা অ্যান্দোলনে সমর্থন দিয়ে আমি আমার প্রথম সেমিস্টার ফাইনালটাও মিস করি।

আমাকে আমার ডিপার্টমেন্ট এর সিনিয়র মাসুদ মোল্লা ভাই ফোন প্লাস ক্যাম্পাসে ডেকে নিয়ে বলে আমি যাতে আন্দোলন না করি,এবং ক্যাম্পাসেও না ঢুকি। আমাকে দেখলেই শিবির ছাত্রদল বলে পুলিশে ধরিয়ে দিবে আর মাইর ত ফ্রি।

আমি এইজন্য ক্যাম্পাসেও যাইতাম না। পরীক্ষা না থাকলে যাইতামও না।বিশ্বজিৎ এর খবর ত আমি জানি,পরিবারের প্রতি ভালবাসা তো আছে আমার।

আবার নাসির স্যারের জন্য আন্দোলন করছি দেখে ডিপার্টমেন্ট এর সাইফুল ভাই থ্রেট, মাইরের হুমকি তো দিছিলেনই। আমাকে নাকি অপ্রীতিকর অবস্থায় পেয়ে মারছে। আবার এই নিউজটা সাইফুল ভাই শেয়ার দিছে।

আমাকে অনেকেই বলেছিল সাইফুল ভাই তো ৬ষ্ঠ ব্যাচের হয়ে ৫ম ব্যাচের নিজের ডিপার্টমেন্টের বড় আপুর কাছে থাপ্পড় খাইছিল। তুই এটা বলিস না কেন। আমি কেন এগুলো বলব? কি লাভ আমার এতে?

আমাকে অপ্রীতিকর অবস্থায় পায় নি,বরং আমাকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে গেছে নব নির্মিত মহিলা হলের ঐদিকে। পুলিশের কাছে এটার ফুটেজও আছে।

যারা আমার নামে মিথ্যা নিউজ ছাপিয়েছে তাদের নামেও মামলা করব আমি। স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে এতটুকু করার অধিকার ত আমার আছে।

ওরা মারতে পারবে,আর আমরা বলতেও পারব না। বলতে গেলেই গুম করে দিবে। সাগর-রুনির বিচার হয় নাই,আমার জন্যও নাকি ২দিন মাঠ গরম থাকবে বড়জোর। তারপর সব ভুলে যাবে। বিশ্বজিৎ এর মত হয়তো আমাকে মেরে ফেললেও কয়দিন লেখালেখি হবে।

পরবর্তীতে যারা পলাতক থাকবে তাদের ফাঁসি দিবে,আর যারা আটক থাকবে, তাদের কেউ কেউ মুক্তি পাবে,আর বাকিরা জেলে থাকবে।এমনই হবে হয়তোবা। অথবা পকেটে ইয়াবা/মাদক ঢুকিয়ে বলবে আমি নেশাখোর। আমি কোনদিন একটা সিগারেটও মুখে দেই নাই,আমার ব্লাড টেস্ট করে দেখিয়েন।

আমি নিয়মিত রক্ত দেই। এমনও হতে পারে কোন মেয়েকে ভয় দেখিয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে বলবে। ক্যাম্পাসে আমার বিপক্ষে মিছিল করাবে। অথচ আমি আমার মরা বাবার কসম খেয়ে বলছি, আমি কোনদিন কারো কোন ক্ষতি করি নাই। বরং চেষ্টা করেছি উপকারের।

বনানী থেকে ফার্মগেট হেঁটে এসে কোচিং করেছি। মেস থেকে ১০টাকার ভাড়া বাঁচাতে টিউশনে দেড় ঘন্টা পথ হেঁটে গিয়েছি। নিজে না খেয়ে পার্কের ছোট ছেলেমেয়েদের খাওয়াইছি। টিউশন ম্যানেজ করে দিয়ে আবার পকেটে ৫০/১০০টাকা ঢুকিয়ে দিয়েছি।

সকাল ৮টায় মেস থেকে বের হয়ে টিউশন কোচিং শেষ করে রাত ১১টায় মেসে ফিরেছি।আর বিবেকের তাড়না থেকে, আবগের জায়গা থেকে হল আন্দোলন, মেডিকেলের প্রশ্নফাঁস আন্দোলন, কোটা আন্দোলন, নাসির স্যারের আন্দোলনগুলো করেছি।

এই আন্দোলনগুলো কারো বিপক্ষে ছিল না, এগুলো ছিল সাধারণদের পক্ষের আন্দোলন।

আমি সাধারণ, সাধারণের পাশে দাঁড়াব। আমি না খেয়ে থেকেছি, আমি না খাওয়াদের খাওয়াব। আমার যেখানে দিনকে দিন এবং রাতকে রাত বলারই অধিকার নেই,সেখানে যারা দিনকে রাত এবং রাতকে দিন বানায় তাদের বিরুদ্ধে আমি কেন দাঁড়াব? কি লাভ আমার এতে?

আমাকে যারা মেরেছে,হুমকি দিয়েছে এরা সবাই পলিটিক্স করে। তরিকুল ভাই,রাসেল ভাই বলেছেন ব্যবস্থা নিবেন।

আপনারা আমার ভাইয়ের মত। ভাই,আমি এতিম একটা ছেলে।

আমার বাবা নেই,আমার ভাই পিয়নের কাজ করে বাসায় টাকা দিত,আর আমি কাজের টাকা নিয়ে দুইভাই ঢাকা শহরে থাকতাম। ভাইয়া এখন গ্রামে চলে গেছে। অন্যের জমিতে চাষ করে। আমার ভাইটা অনেক সুন্দর ছিল।

আজ সকালে দেখি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।আমার ভাই ঠিকমত কথা বলতে পারে না। খালি কাঁদে,আমার বিধবা মা ও কাঁদে। ছোটভাইটাও কাঁদে।আমার ছোটভাইটার পড়াশোনার খরচ আমি দেই, জানি না ওকে আর পড়াতে পারব কি না। আমার পরিবারের সবাই কাঁদছে।

আপনারা যারা রাজনীতি করেন,যারা করেন না, যারা আমার বন্ধু,যারা আমার ভাল চান,যারা আমার খারাপ চান,সবার কাছে করজোড়ে মিনতি আমাকে বাঁচতে দিন। আমাকে আর মাইরেন না।

আমার বিধবা মায়ের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে দেন। আমার আব্বা নাই। আমিই আমার পরিবারের সব। প্লিজ,আমাকে বাঁচতে দিন,আমাদের নিরাপত্তা দিন। আমরা আপনাদের সন্তান। আমরা বাংলাদেশের সন্তান।

আমরাও বাঁচতে চাই,বিধবা মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। ভাইয়ের কান্না দেখতে চাই না।

আরেকটা কথা বলি,হাসপাতালে আজ ইফতারের সময় আমরা সবাই যখন ইফতার করি,তখন আসামী ভাইদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ ভাইরা এক বেডে বসে ছিল। হিন্দু ধর্মের।

আমি উনাদের এক প্লেট ইফতার দেই।পরে উনারা নিবেন না। আমি যদিও এখন আর তেমন হাসতে পারি না,উনাদের অনুরোধ করি। উনারা খুব সুন্দর একটা হাসি দিয়ে ইফতারের প্লেটটা নিয়েছেন।

হাসপাতালে থেকে সেই মুহুর্তটা আমার মনেই হয় নি যে আমি অসুস্থ। আমার খুব ভাল লেগেছিল।

আমি খুব কষ্ট করে প্রায় ৮/৯ ঘন্টা ধরে থেমে থেমে লেখাটা লিখলাম। আমার জন্য সবাই দোয়া করিয়েন। আমি যদি কারো কাছে কোন ভুল করে থাকি,আমাকে মাফ করে দিয়েন।

আমি চাই আমার মত কারো মা-ভাই যেন এভাবে না কাঁদে। আমাকে যারা মেরেছে তাদের পরিবারেরও কেউ যেন না কাঁদে। আমার পরিবারের জন্য দোয়া করিয়েন, আর আমার যদি কিছু হয় তাহলে আমার পরিবারটাকে একটু দেখিয়েন।

(জাস্ট নিউজ/এমআই/০৯৫২ঘ.)