পুলিশের অভিযানে তরুণ নিহত

পুলিশের  অভিযানে তরুণ নিহত

 

চট্টগ্রাম, ২৬ জানুয়ারি (জাস্ট নিউজ) : নিজেদের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা ছেড়ে সাদাপোশাকে ২০ কিলোমিটার দূরের গ্রামে গত বুধবার রাতে আসামি ধরতে যান সীতাকুণ্ড থানার এক উপপরিদর্শক, কনস্টেবল ও আনসার সদস্য।
তাঁদের এই অভিযানের কথা জানতেন না থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। সেখানে গিয়ে এক ব্যক্তিকে ইয়াবা বড়ি দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন তাঁরা। একপর্যায়ে জনতার প্রতিরোধের মুখে গুলি ছুড়ে পালিয়ে আসেন তাঁরা। সেই গুলিতে স্থানীয় এক তরুণ নিহত হন, গুলিবিদ্ধ হন আরও দুজন।

এ ঘটনার পরপরই বুধবার রাত পৌনে ১১টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড অংশে অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হলে ওই অভিযানে যাওয়া সীতাকুণ্ড থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নাজমুল হুদা, কনস্টেবল আবুল কাসেম ও আনসার সদস্য ইসমাইল হোসেনকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়।

বিষয়টির তদন্তে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মশিউদ্দৌলা রেজাকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সীতাকুণ্ড সার্কেল) রেজাউর রহমান ও সহকারী পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) শাহজাহান ভূঁইয়া। তদন্ত কমিটি তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বুধবার রাত সোয়া ১০টার দিকে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারি ইউনিয়নের তেলিবাজার গ্রামে সাদাপোশাকে আসামি ধরতে যান ওই দুই পুলিশ ও আনসার সদস্য। তাঁরা একটি মাইক্রোবাসে সেখানে যান। পুলিশ বলছে, গাড়িটি ভাড়া করা। সরকারি কাজের জন্য এটি ভাড়া করা হয়নি। ওই তিনজন ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য গাড়িটি ভাড়া করেছিলেন।

বুধবারের ওই ঘটনার বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চোধুরী বলেন, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কাজে পুলিশকে ব্যবহারের কারণে বাহিনীর অনেক সদস্য নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন না করে অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকায় ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন তাঁরা। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় তেলিবাজার গ্রামে গিয়ে এই প্রতিবেদক ঘটনার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলেন। তেলিবাজার গ্রামের বাসিন্দা ও জাহাজভাঙা কারখানার (সীতাকুণ্ডে ৫০টির বেশি জাহাজভাঙা কারখানা রয়েছে) শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার ঠিকাদার মো. ফারুক হোসেন বলেন, বুধবার রাতে শ্রমিকদের মজুরি দিতে তিনি ও তাঁর ভাই মোহাম্মদ পারভেজ এলাকায় একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় সাদাপোশাকে থাকা ওই তিন ব্যক্তি তাঁর কাছে ইয়াবা আছে বলে দাবি করেন। তাঁর ভাই পারভেজ এর প্রতিবাদ করলে তাঁকে মারধর করে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করেন। তাঁদের চিৎকারে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এসে সাদাপোশাকধারীদের পরিচয় জানতে চান। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে এসআই নাজমুল হুদা নিজেকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে সবাইকে চলে যেতে বলেন। এ নিয়ে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে গ্রামবাসীর কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে সাইফুল আলমের (নিহত তরুণ) শার্টের কলার ধরে খুব কাছ থেকে তাঁর কাঁধে গুলি করেন নাজমুল। তখন গ্রামবাসী ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার শুরু করলে নাজমুলসহ তিনজন গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যান।

তেলিবাজার গ্রাম থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক আধা কিলোমিটার দূরে। গ্রাম থেকে মহাসড়কে ওঠার রাস্তা রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, যে দোকানের সামনে সাদাপোশাকধারী তিনজন এসেছিলেন, তার কিছুটা দূরে তাঁদের মাইক্রোবাস রাখা ছিল। চালক গাড়িতে বসে ছিলেন।

এ ঘটনার বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার নুরেআলম মিনা বলেন, তিনি জেনেছেন পুলিশ সদস্যরা তাঁদের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা ছেড়ে দূরের একটি গ্রামে ইয়াবা সেবনকারী ও আসামি ধরতে যান। কিন্তু তাঁরা বিষয়টি থানার ওসিকে জানাননি। শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তাঁদের পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে। ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত হবে। কারও ব্যক্তিগত অপরাধের দায় পুলিশ বিভাগ নেবে না।

এদিকে বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় তেলিবাজার গ্রামে নিহত সাইফুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় লোকজন সেখানে জড়ো হয়েছেন। বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যও তখন ছিলেন। পুত্র হারানোর শোকে ঘরে বিলাপ করছিলেন সাইফুলের মা মরিয়ম খাতুন। তাঁর বাবা শামছুল আলম ছিলেন বাক্‌রুদ্ধ। তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার ছোট সাইফুল স্থানীয় একটি জাহাজভাঙা কারখানার শ্রমিক ছিলেন। তাঁর বড় দুই ভাই মা-বাবার সঙ্গে থাকেন না। তাঁদের দেখাশোনা করতেন তিনি।

বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নুরেআলম মিনা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মশিউদ্দৌলা রেজা ও সীতাকুণ্ড সার্কেলের পুলিশ সুপার রেজাউর রহমান।

রেজাউর রহমান বলেন, বুধবার রাতের ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি আছে কি না, তা খুঁজে বের করা হচ্ছে। গাফিলতির প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এদিকে দুই পুলিশ ও আনসার সদস্যকে নজদারিতে রাখা হয়েছে বলে জানান সীতাকুণ্ড থানার ওসি ইফতেখার হাসান। তিনি বলেন, বুধবার রাতে পৌর সদরের ফকিরহাট থেকে বাড়বকুণ্ডের চাড়ালকান্দি পর্যন্ত টহলের দায়িত্বে ছিলেন ওই তিনজন। কিন্তু নিজেদের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা ছেড়ে থানায় কোনো তথ্য না দিয়ে তাঁরা প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের তেলিবাজার গ্রামে গেলে ঘটনাটি ঘটে। নিহত যুবকের পরিবার মামলা করবে বলে তাঁদের জানিয়েছে। তখন ওই তিনজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে। প্রথম আলো।

(জাস্ট নিউজ/ওটি/১০৪২ঘ.)