বাস্তবায়নই বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ

বাস্তবায়নই বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ

ঢাকা, ৭ জুন (জাস্ট নিউজ) : প্রতিবছর যে বাজেট ঘোষণা করা হয়, সংশোধিত বা প্রকৃত বাজেট তার চেয়ে গড়ে ২০ ভাগের মতো কম৷ এবারের বাজেট সবচেয়ে বড় বাজেট৷ কিন্তু অর্থবছরের শেষ দিকে বোঝা যাবে প্রকৃত বাজেট কত টাকার৷ তাই বাজেট বাস্তবায়নই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ৷

এবারের প্রস্তাবিত বাজেট চার লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার৷ এরমধ্যে উন্নয়ন বাজেট ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকার৷ আর অনুন্নয়ন বা রাজস্ব বাজেটে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮২ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা৷

বাজেটে প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, যা চলতি বাজেটের চেয়ে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ বেশি৷ চলতি বাজেটের চেয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির গড়হার বেশি ধরা হয়েছে, ৫ দশমিক ৬ শতাংশ৷

প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারি অনুদানসহ আয়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা৷ এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর আয় ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা৷ মোট ঘাটতি ১ লাখ ২১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা৷

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি)-তে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা৷ চলতি বাজেটে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা৷ প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা থেকে ঋণ ধরা হয়েছে ৭১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা৷ এর মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হবে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া হবে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা৷ বাকি তিন হাজার কোটি টাকা অন্যান্য উৎস থেকে৷

চলতি অর্থবছরের মূল বাজেট ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার হলেও সংশোধিত বাজেট ৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকার৷ সংশোধিত বাজেটের সঙ্গে তুলনা করলে প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৯৩ হাজার কোটি টাকা বেশি, যা শতকরা হিসেবে ২৫ ভাগ বড়৷

এবারে প্রস্তাবিত বজেটে করমুক্ত আয়সীমা আগের মতোই বছরে আড়াই লাখ টাকা রাখা হয়েছে৷ এ বাজেটে ফেসবুক, ইউটিউব ও গুগলকে করের আওতায় আনার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী৷ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৩৫ শতাংশ উৎসে কর প্রস্তাব করা হয়েছে৷

লিপস্টিক, ক্রিমের মতো আমদানি করা প্রসাধন সামগ্রীর ওপর কর বাড়ানো হলেও কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ আমদানি, দেশে উৎপাদিত মোবাইল ফোন, মোটর সাইকেলের ওপর কর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে৷ সিগারেটের ওপর কর বেড়েছে সামান্য৷ কর্পোরেট কর কমানো হয়েছে ব্যাংকিং খাতের জন্য৷ খরচ বাড়বে অনলাইন কেনাকাটায়৷ এতদিন অনলাইনে (ই-কমার্স) কেনাকাটায় ক্রেতাকে কোনও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) দিতে হতো না৷ প্রস্তাবিত বাজেটে ভার্চুয়াল ব্যবসায় বা অনলাইন কেনাকাটায় ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী৷ দরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনিতে বরাদ্দ বাড়ছে৷ মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিবছর পাঁচ হাজার টাকা করে ‘বিজয় দিবস ভাতা’ পাবেন৷ দরিদ্র মায়েদের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে৷ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে নতুন করে প্রায় ১১ লাখ দরিদ্র মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় আনার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী৷ আর এবারই সার্বজনীন পেনশনের উদ্যোগ নেয়া হবে৷

এটি দেশের ৪৭তম, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৮তম এবং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের দ্বাদশ বাজেট৷ ‘সমৃদ্ধ আগামী পথযাত্রায় বাংলাদেশ’ নাম দিয়ে এবারের বাজেট সংসদে উত্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী৷

বাংলাদেশ সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-র অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ডয়চে ভেলেকে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটের কাঠামোর দিকে তাকালে দেখা যায় বাজেটের আকার জিডিপির ১৭-১৮ শতাংশের একটা বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে৷ কিন্তু এই বাজেটের অর্থায়ন গত বছরের মতোই অংকের হিসেবে মেলানোর চেষ্টা আছে৷ যেমন, রাজস্ব খাতে প্রস্তাবিত বাজেটে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৩ শতাংশ৷ কিন্তু চলতি বাজেটের শেষে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা হলো ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ৷ বাজেটে এই দ্বিগুন রাজস্ব আদায়ের কাঠামোগত পরিকল্পনা আমরা দেখছি না৷ তাহলে এখানে তো বড় ধরনের ঘাটতি থেকে যাওয়ার কথা৷ সরকার কিভাবে সেটা পুরণ করবে৷ সরকার বলছে সঞ্চয়পত্র নয়, এবার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঘাটতি মেটানো হবে৷ কিন্তু ব্যাংকিং খাতের এখন যা অবস্থা, তাতে তারা কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারকে সেই সাপোর্ট কি দিতে পারবে?

তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির খাতে প্রস্তাবিক বাজেটে ইতিবাচক পদক্ষেপ আছে৷ আর সার্বজনীন পেনশন কাঠামো এবার ঘোষণা করা হবে৷ কর্পোরেট করহার কমানোর যে দাবি ছিল তা শেষ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে কর কমানোয় সীমবদ্ধ হলো৷ ফলে এর বাইরের ব্যবসায়ীরা এর থেকে কোনো সুবিধা পাবেন না৷ তবে সরকার ফার্মাসিউটিক্যালসহ দেশীয় শিল্পের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে৷

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, প্রতিবছরই বাজেট বাস্তবায়নে যে ঘাটতি তা কাটানোর কোনো উদ্যোগ নাই৷ বাজেটে এ নিয়ে নতুন আইনের তালিকা দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু যারা বাস্তবায়ন করবেন, তাদের সক্ষমতার জায়গা একই রয়ে গেছে৷

এদিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, অর্থমন্ত্রী এ যাবৎ কালের সবচেয়ে বড় বাজেট প্রস্তাব করলেন৷ কিন্তু এটার বাস্তবায়ন নির্ভর করবে আমাদের জানা দুর্বলতাগুলো কিভাবে কাটিয়ে উঠতে পারি কিনা তার ওপর৷ করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো দরকার ছিল, তা হলো না৷ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি বাড়ানো হলেও এটার সঠিক বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করছে দরিদ্র মানুষের কল্যাণ৷ এটা নির্বাচন বা যে কারণেই করা হোক, আমি মনে করি ইতিবাচক৷ দেশীয় শিল্পের জন্য প্রণোদনা আছে৷ কিন্তু নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা কিছু নাই৷ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ আগের মতোই৷ এই খাতে বরাদ্দ বড়ানো দরকার৷

তিনি বলেন, এবারের বাজেটে একান্ন হাজার কোটি টাকা শুধু সুদের জন্যই ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে৷ এটা সঞ্চয়পত্রের সুদ৷ অভ্যন্তরীণ ঋণের কারণে এই সূদ দিতে হবে৷ এটা চলতে থাকলে অর্থনীতিকে এর ফল ভোগ করতে হবে৷

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এই বাজেটে অনেক দিক ব্যালেন্স করার চেষ্টা করা হয়েছে৷ কিন্তু অতীতের দুর্বলতা দূর না হলে এই বাজেট বাস্তবায়নই হবে বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ৷ সূত্র: ডয়চে ভেলে।

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/২১৪৬ঘ.)