দুর্নীতি এখন প্রকাশ্যেই হয়, তাই কয়লাও গায়েব হয়

দুর্নীতি এখন প্রকাশ্যেই হয়, তাই কয়লাও গায়েব হয়

ঢাকা, ২৪ জুলাই (জাস্ট নিউজ) : বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে কয়লা সরিয়ে ফেলায় তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতি এখন প্রকাশ্যেই হচ্ছে, তাই এমন ঘটনা ঘটেছে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন দিনাজপুরের অনেক মানুষ৷ দেড়লাখ টন কয়লা কীভাবে হাওয়া হয়ে যায়, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে৷ কারণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়লাতো পকেটে করে নেয়ার বিষয় নয়, এটা প্রকাশ্যে ট্রাকে করে নিতে হয়েছে৷ তাই প্রশ্ন উঠছে, দুর্নীতি কতটা অপ্রতিরোধ্য হলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে৷

দুর্নীতি দমন কমিশন, দুদকের দিনাজপুরের উপ-পরিচালক বেনজীর আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা স্পষ্ট যে, ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা সরিয়ে ফেলা হয়েছে৷ আর অবাক করা ব্যাপার হলো, কয়লা রাখা হতো তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) অফিসের পাশেই৷ আমরা সোমবার সরেজমিন গিয়ে দেখেছি, কোল ইয়ার্ডে মাত্র এক-দেড় হাজার মেট্রিক টন কয়লা আছে৷ কিন্তু থাকার কথা ছিল ১ লাখ ৪৬ হাজার মেট্রিক৷ অর্থাৎ ১ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লার কোনো হদিস নেই।”

তিনি বলেন, ‘‘কয়লা ধীরে ধীরে সরানো হয়েছে৷ এই সময়ে বাস্তবে না থাকলেও কাগজপত্রে পরিমাণ ঠিকই রাখা হয়েছে৷ বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে কয়লার নিয়মিত সরবরাহ থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনও স্বাভাবিক ছিল৷ ফলে কয়লা সরিয়ে নেয়ার বিষয়টি চাপা থেকেছে৷ তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতিদিন তিন হাজার টন কয়লা লাগে৷ আর কয়লা খনি'র উৎপাদন ক্ষমতাও প্রতিদিন কম বেশি তিন হাজার টন৷ ১৩ মে থেকে খনি শ্রমিকরা ধর্মঘটে যান৷ ২৪ দিন তারা ধর্মঘটে থাকায় কয়লা উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়৷ আর তখনই দুর্নীতি ধরা পড়ে৷ কারণ প্রতিদিনের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কয়লার ঘাটতি দেখা দেয়৷ যেহেতু মজুদ কয়লা বাস্তবে পাচার হয়ে যায় তাই বিদ্যুৎ উৎপাদন আর ঠিক রাখা যায়নি৷ প্রকাশ হয়ে পড়ে কয়লা গায়েব হওয়ার ঘটনা৷”

দুদক কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদ জানান, “আমরা কাগজপত্র জব্দ করেছি৷ সেখানে কয়লার হিসাব ঠিক রাখা হয়েছে৷ কিন্তু বাস্তবে কোল ইয়ার্ডে কয়লা নাই৷ তারা নিজেরা এর আগেই অবশ্য একটি তদন্ত কমিটি করেছেন৷ আর তার ভিত্তিতে কয়েকজন কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে৷ তবে তারা বলছেন সিস্টেম লসের কারণে কয়লা নাই৷”

তিনি বলেন, “সিস্টেম লসের দাবি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ সিস্টেম লসের কারণে ১-২ হাজার টন কয়লার ঘাটতি পড়তে পারে৷ কিন্তু তাই বলে দেড় লাখ টন কয়লা সিস্টেম লস! আমরা এখন কাগজপত্র খতিয়ে দেখছি৷ দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছি৷ এখন আমরা বের করার চেষ্টা করব কীভাবে এই কয়লা পাচার হলো এবং এর সঙ্গে কারা জড়িত, তা চিহ্নিত করব৷”

এই ঘটনায় তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের এমডি হাবিব উদ্দীনসহ তিনজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও ক্ষুব্ধ হয়েছেন৷ মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে৷

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “কয়লা কি পকেটে করে নেয়া যায়? এটাতো ট্রাকে করে দিনের পর দিন বাইরে নিতে হয়েছে৷ সেটা কেউ দেখল না, এটা কি বিশ্বাস করা যায়? আসলে দুর্নীতি এখন প্রকাশ্য হয়ে যাওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷”

তিনি বলেন, “ব্যাংকের টাকা লুট হয়, কোনো বিচার হয়না, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের সোনার মান বদলে যায় (২২ ক্যারেট থেকে ১৮ ক্যারেট) তার নিরপেক্ষ তদন্ত হয়না, কোনো বড় দুর্নীতিবাজ শাস্তি পায়না, কিছু চুনোপুটি ধরা পড়ে মাঝে মধ্যে৷ এই যদি পরিস্থিতি হয় তাহলেতো দুর্নীতি অপ্রতিরোধ্য হবেই৷”

হাফিজউদ্দিন খান বলেন, “দুর্নীতি এতটাই বেড়ে গেছে যে এখন কয়লাও রেহাই পায়না৷ সিকিউরিটি, গেটপাস, নিরাপত্তা কিছুই কি ওখানে নেই? দুর্নীতির কারণে দেড়লাখ টন কয়লাও গেল৷ আর ৫৭৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার পাওয়ার স্টেশনও কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে গেল৷”

খনির শ্রমিকরা ধর্মঘট না করলে এই দুর্নীতির ঘটনা হয়ত জানাই যেতনা, বলে মনে করেন দুদক কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদ৷ তিনি বলেন, “কয়লাতো প্রকাশ্যে দেখা যায়৷ এত কয়লার ঘাটতি হওয়ার পরও এমডির অফিসের পাশেই কোল ইয়ার্ড থাকার পরও তিনি বা দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের চোখে এটা পড়লনা, এটা ভাবা যায়? এমডি মাত্র সাত দিন আগেও প্রতিবেদন দিয়েছেন যে, ১ লাখ ৪৭ হাজার মেট্রিক টন কয়লা মজুদ আছে৷”

টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এটাই এখন আমাদের দেশে দুর্নীতির স্বাভাবিক চিত্র হয়ে গেছে৷ এটা ঠিকমত তদন্ত হলে দেখা যাবে, এরসঙ্গে শুধু কর্মকর্তারাই নয়, অনেক প্রভাবশালী জড়িত৷ কারণ এটাতো এমন না যে, সোনার টুকরো পকেটে করে নিয়ে গেল৷ এটা প্রকাশ্যে করা হয়েছে এবং বেশ কিছুদিন ধরে করা হয়েছে৷ মানে দুর্নীতি এখন প্রকাশ্যেই হয়৷”

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘দুর্নীতিবাজদের যদি বিচার হয়, তাদের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া যায়, তাহলে দুর্নীতি কমবে৷ কিন্তু এখানে দুর্নীতির শাস্তি হয়না৷ মূল হোতারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকেন৷ তাই দুর্নীতি কমছেনা৷ দেখা যাবে এই কয়লা দুর্নীতির ঘটনাও কিছুদিন পর হয়তো ধামাচাপা পড়ে যাবে৷ আর শাস্তি হলেও নীচের দিকের দু'একজনের হবে৷ তাহলে দুর্নীতি বন্ধ হবে কীভাবে?” সূত্র: ডয়চে ভেলে।

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/২১৫৪ঘ.)