জনতা ব্যাংকের ৫ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতিতে সাবেক এমডির হাত!

জনতা ব্যাংকের ৫ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতিতে সাবেক এমডির হাত!

ঢাকা, ৯ আগস্ট (জাস্ট নিউজ) : জনতা ব্যাংকের প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি করেছে ক্রিসেন্ট গ্রুপ। আর এ ঘটনায় যোগসাজশের জন্য ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুস সালামকে দায়ী করেছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। শুধু তাই নয়, সাবেক এই এমডির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দিয়েছে জনতা ব্যাংকের বর্তমান পর্ষদ। জনতা ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

ব্যাংকের এমডির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সরকারি কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সুপারিশ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানোর দৃষ্টান্ত এই প্রথম। অতীতে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের চিঠি পাঠিয়ে এমডিদের অপসারণ করতো। সর্বশেষ অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডি সৈয়দ আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তার আগে বেসিক ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফকরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছিল।

জনতা ব্যাংক থেকে গত সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে সাবেক এমডি ছাড়াও তিন ডিএমডির বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে ব্যাংকটির সাবেক এমডি আবদুস সালামকে কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি। তাকে মোবাইলে এসএমএস দেওয়ার পরও কোনো জবাব দেননি।

এদিকে, বুধবার (৮ আগস্ট) অনুষ্ঠিত ব্যাংকটির বোর্ডসভায়ও অনিয়ম ও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে থাকার ঘোষণা দেওয়া হয়। ব্যাংকের চেয়ারম্যান লুনা শামসুদ্দোহার সভাপতিত্বে বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয়।

বিষয়টি জানতে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান লুনা শামসুদ্দোহা ও বর্তমান এমডি আব্দুছ ছালাম আজাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা ফোন ধরেননি। একইভাবে এসএমএস পাঠালেও তারা কোনও সাড়া দেননি। তবে ব্যাংকটির পর্ষদের কয়েকজন সদস্য জানিয়েছেন, দুপুরে শুরু হওয়া বোর্ড সভা রাত ৮টা পর্যন্ত চলার কারণে তারা ফোন রিসিভ করেননি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ প্রতিবেদককে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ডোবানোর পেছনে অসৎ এমডিরাই অনেকাংশে জড়িত। তিনি বলেন, ‘যেসব এমডির কারণে ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের কেবল অপসারণ করলে হবে না, তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তবেই ব্যাংকে অপরাধপ্রবণতা কমে আসবে।’

এর আগে ক্রিসেন্ট গ্রুপের পাঁচ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনায় পরিচালনা পর্ষদ থেকে একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেই তদন্ত প্রতিবেদনে সাবেক এমডি আবদুস সালাম ও তিনজন ডিএমডির বিরুদ্ধে চরম দায়িত্বহীনতার অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং রীতিনীতি লঙ্ঘন করে পর্ষদকে এড়িয়ে এই তিন কর্মকর্তা ক্রিসেন্ট গ্রুপকে বেআইনিভাবে ঋণ সুবিধা দিয়েছেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রিসেন্ট গ্রুপকে ঋণ হিসেবে দেওয়া অর্থের প্রায় সবই নগদ তুলে নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখার ভল্টে নগদ টাকার ধারণক্ষমতা তিন কোটি টাকা। এ কারণে গ্রাহককে ঋণের টাকা দিলকুশা স্থানীয় কার্যালয় শাখা ও মোহাম্মদপুর শাখা থেকে তোলার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ ব্যাংকের পর্ষদকে জানানো হয়নি। শুধু তা-ই নয়, সীমাতিরিক্ত ঋণ বিতরণ করলেও পর্ষদকে জানায়নি, এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনও নেওয়া হয়নি।

এদিকে প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুস সালাম, সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) জাকির হোসেন ও ইসমাইল হোসেনের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে। অবশ্য পর্ষদের কাছে সাবেক এমডি আবদুস সালাম যে জবাব দিয়েছেন তা পর্ষদ গ্রহণ করেনি বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ক্রিসেন্ট গ্রুপ ২০১৩ সাল থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেওয়া শুরু করে। ২০১৪ সালে এসে ব্যাপকতা বাড়তে থাকে। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে গ্রাহককে সবচেয়ে বেশি ঋণ দেওয়া হয়।

উল্লেখ্য, আবদুস সালাম জনতা ব্যাংকের এমডি পদ থেকে গত বছরের ২৭ অক্টোবর অবসরে যান। ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর এমডি পদে যোগ দিয়েছিলেন আবদুস সালাম।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চামড়া খাতের কোম্পানি ক্রিসেন্ট লেদারের রফতানির অর্থ দেশে না আসলেও নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে একের পর এক বিল কিনেছে জনতা ব্যাংক। ভুয়া রফতানি বিল কিনে গ্রুপটির হাতে নগদে টাকা দিয়েছে জনতা ব্যাংক। এখন রফতানির টাকা ফেরত আসছে না। এর বাইরে সরকারের নগদ সহায়তা তহবিল থেকেও ক্রিসেন্ট গ্রুপ নিয়েছে এক হাজার ৭৫ কোটি টাকা। বিদেশে রফতানির এক হাজার ২৯৫ কোটি টাকা আটকা রয়েছে। সব মিলিয়ে গ্রুপটি সরকারি ব্যাংক ও সরকারের তহবিল থেকে ২০১৩ সাল থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত পাঁচ বছরে নিয়ে নিয়েছে পাঁচ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির রফতানির বিপরীতে সৃষ্ট ৫৭০টি বৈদেশিক বিনিময় বিল ক্রয় (এফডিবিপি) করে গ্রাহককে এক হাজার ১৩৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়। আগের বিল মেয়াদোত্তীর্ণ থাকা অবস্থায় পরের বিল কেনার নিয়ম না থাকলেও তা কেনা হয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারপ্রেস নেটওয়ার্কের (আইপিএন) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ব্যাংকের অধিকাংশ অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের এমডির জ্ঞাতসারে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এমডির প্রভাবেও শাখার কর্মকর্তারা অসৎ পন্থা অবলম্বন করেছেন। ২০১৬ সালে প্রতিবেদনটি তৈরি করে আইপিএন। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ৫ ব্যাংকসহ বেসরকারি খাতের খেলাপিতে শীর্ষে থাকা ১০ ব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। এই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকের কোনো না কোনো কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার কারণেই নামসর্বস্ব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

(জাস্ট নিউজ/একে/২২০৪ঘ.)