চলতি মাসের বেতন হবে না ফারমার্স ব্যাংকে

চলতি মাসের বেতন হবে না ফারমার্স ব্যাংকে

ঢাকা, ২৪ ডিসেম্বর (জাস্ট নিউজ) : নগদ টাকা না থাকায় প্রায় দুই মাস ধরে ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ বিতরণ বন্ধ। অন্যদিকে জমা অর্থ তুলে নিতে মরিয়া আমানতকারীরা। প্রায় প্রতিদিনই ব্যাংকটিতে ভিড় করলেও খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে তাদের। এমন পরিস্থিতির মধ্যে এবার অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে নজিরবিহীন অর্থ সংকটে থাকা ব্যাংকটির কর্মীদের বেতন পরিশোধ। চলতি মাসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির পর্ষদ সদস্যরাই।

ফারমার্স ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যাত্রা শুরুর মাত্র তিন বছরের মধ্যেই দেড় হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। এ জনবলের বেতন বাবদ প্রতি মাসে ব্যাংকটির ব্যয় হয় ৫ কোটি টাকার বেশি।

বিপুল সংখ্যক এ কর্মীর বেতন পরিশোধে সংকট হবে বলে স্বীকার করেছেন ফারমার্স ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির (ইসি) নতুন চেয়ারম্যান আজমত রহমানও। গতকাল বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, নগদ টাকার সংকটের কারণে আমানতকারীদের টাকাই এ মুহূর্তে পরিশোধ করতে পারছি না। ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বেতন দেব কোথা থেকে?

আর্থিক অনিয়মের পাশাপাশি ফারমার্স ব্যাংকে লোকবল নিয়োগেও নজিরবিহীন দুর্নীতি হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক পরিদর্শনে উঠে এসেছে। আগ্রাসী মনোভাবের কারণে মাত্র তিন বছরেই ৫৬টি শাখা খুলেছে ব্যাংকটি। আর্থিক লেনদেন, রাজনৈতিক ও আত্মীয় পরিচয়ে ২০১৬ সালের মধ্যেই ফরমার্স ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৩৮৯। বর্তমানে এ সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়েছে বলে ব্যাংকটি সূত্রে জানা গেছে।

প্রয়োজনের অতিরিক্ত এ জনবলের বেতন-ভাতা বাবদ ২০১৬ সালেই ব্যাংকটিকে ব্যয় করতে হয়েছে সাড়ে ৫৩ কোটি টাকা। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় চলতি বছরের জুনে এসে ১৩ কোটি টাকা লোকসানে পড়েছে ফারমার্স ব্যাংক। একই সময়ে ৫৪টি শাখার মধ্যে ব্যাংকটির ২৮ শাখাই লোকসানে চলে যায়। এরপর থেকে আর্থিক বিপর্যয় আরো বেড়েছে ফারমার্স ব্যাংকের।

এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধে বিলম্ব হবে জানিয়ে আজমত রহমান বলেন, শাখাগুলোকে দ্রুতগতিতে বিতরণকৃত ঋণের টাকা আদায় করতে বলা হয়েছে। যে শাখা লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী টাকা আদায় করতে পারবে, সে শাখার কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা দ্রুত পরিশোধ করা হবে।

অতিরিক্ত জনবলের বিষয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন কারণে ফারমার্স ব্যাংকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর নতুন পর্ষদ ব্যাংকটিকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে। আশা করছি, গ্রাহকদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে এনে ব্যাংকটিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে পারব।

এদিকে তারল্য সংকট উত্তরণে ৫০০ কোটি টাকার বন্ড ছাড়ার অনুমোদন পেয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। যদিও এ বন্ড কেনার আগ্রহ নেই বাজারে। এ অবস্থায় বন্ডের সুদহার বাড়ানোর আবেদন করেছে ব্যাংকটি। এছাড়া তারল্য সংকট কাটাতে ব্যাংকের পরিচালকদের ২০০ কোটি টাকা জমা দিতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গতকাল পর্যন্ত তারা জমা দিয়েছেন মাত্র ১৭ কোটি টাকা।

খেলাপি ঋণসহ বিভিন্ন কারণে এরই মধ্যে ৭৫ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে ব্যাংকটি। কার্যক্রম শুরুর এত অল্প সময়ে এত বড় অংকের মূলধন ঘাটতির ঘটনা বাংলাদেশে এই প্রথম। আইন অনুযায়ী, প্রচলিত ধারার যেকোনো ব্যাংক ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করলে সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা ঋণ দিতে পারে। কিন্তু আগ্রাসী মনোভাবের কারণে ফারমার্স ব্যাংক ৯০ শতাংশের বেশি ঋণ দিয়েছে।

ব্যাংকটির ঋণ কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য চলতি বছর কয়েক দফায় নোটিস দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। তারল্য সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমা সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়ে আসছিল ফারমার্স ব্যাংক। এ কারণে চলতি বছর ব্যাংকটিকে প্রায় ১৯ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে গত ২৭ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের পর্ষদ সভায় মহীউদ্দীন খান আলমগীর পদত্যাগে বাধ্য হন। ওই বৈঠকেই ব্যাংকটির পরিচালক মোহাম্মদ মাসুদ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ব্যাংকটির এ অবস্থার বিষয়ে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দায়িত্বগ্রহণের আগে ফারমার্স ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ছিলাম। কারণ যাত্রা শুরুর পর থেকে ২৭ নভেম্বরের আগ পর্যন্ত ব্যাংকের সবকিছুই মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও মাহাবুবুল হক চিশতী নিয়ন্ত্রণ করতেন। পর্ষদের বৈঠকে সর্বোচ্চ ছয়-সাতজন পরিচালক অংশগ্রহণ করতেন। বয়োজ্যেষ্ঠতার কারণে সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আমরা কিছু বলতে পারিনি। ব্যাংকটিকে এভাবে ধসিয়ে দেয়া হয়েছে, সেটিও আমরা বুঝিনি। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই ফারমার্স ব্যাংকের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ব্যাংক গ্রাহকদের আস্থা ও বিশ্বাসে ভর করে চলে। সেটিতে কিছুটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। তবে আমানতকারীদের কোনো টাকাই খেয়ানত হবে না, সেই প্রতিশ্রুতি আমি দিচ্ছি।

ব্যাংকটির বর্তমান পর্ষদের একাধিক সদস্য জানান, ২০১৩ সালের জুনে যাত্রা শুরুর পর থেকেই ফারমার্স ব্যাংকের একক নিয়ন্ত্রক ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তার সহযোগী হিসেবে দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন ব্যাংকটির ইসি কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক চিশতী। পর্ষদে ২০ জন পরিচালক থাকলেও শুরু থেকে ফারমার্স ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করেছেন মাত্র পাঁচ-সাতজন পরিচালক। ব্যাংকটির পর্ষদ সভায় কখনই আটজনের বেশি সদস্য উপস্থিত থাকতেন না। ব্যাংকটির উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। রাজনৈতিকভাবে সবাই মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে অন্য চোখে দেখতেন। ফলে ব্যাংক পরিচালনায় তার সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত।

২৭ নভেম্বর মহীউদ্দীন খান আলমগীরের পাশাপাশি ফারমার্স ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করেন ব্যাংকটির অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক চিশতীও। আরেক পরিচালক ড. মোহাম্মদ আতাহার উদ্দিন ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর বৈঠকে ব্যাংকের পরিচালক মোহাম্মদ মাসুদকে চেয়ারম্যান ও মারুফ আলমকে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। নতুন করে ব্যাংকটির সবক’টি কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত এ পর্ষদকে ঘুরে দাঁড়াতে তিন মাস সময় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

(জাস্ট নিউজ/জেআর/৯২০ঘ.)