রুপালী গিটার ছেড়ে চলে গেলেন আইয়ুব বাচ্চু

রুপালী গিটার ছেড়ে চলে গেলেন আইয়ুব বাচ্চু

ঢাকা, ১৮ অক্টোবর (জাস্ট নিউজ): নিঃসঙ্গ রুপালি গিটার টুং টাং ভুলে বিরহী আজ। সে বিরহে শোকার্ত কোটি ভক্ত, না বলেই যে চুপ চাপ চলে গেলেন সুরের যাদুকর আইয়ুব বাচ্চু (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রাজিউন)।

আচমকা এ বিদায়ে শুধু সাংস্কৃতিক অঙ্গন নয় কাঁদছে পুরো দেশ। চা দোকান, অফিস কিংবা গলি সর্বত্রই এ বেদনা যেন ছুঁইয়ে পড়েছে। গণমাধ্যম ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অগণিত ভক্তদের বেদনা আর হারানোর অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছে রুপালি গিটারের এ যাদুকরকে কতটা ভালোবাসতো এ দেশের মানুষ।

জনপ্রিয় এই সংগীত শিল্পীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনিপর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

আইয়ুব বাচ্চু নেই এ সংবাদ শুনার পরপরই সংগীত তারকারা ভীড় করেন স্কয়ার হাসপাতালে।ভক্তদেরও কে থামিয়ে রাখে, একবার প্রিয় শিল্পীকে দেখতে তারাও ভীড় জমান সেখানে।

কণ্ঠশিল্পী সামিনা চৌধুরী, দলছুট ব্যান্ডের বাপ্পা মজুমদার, উপস্থাপক হানিফ সংকেত, অভিনেতা শংকর সাঁওজাল, আর্টসেল ব্যান্ডের লিংকন, অভিনেত্রী বন্যা মির্জা, নির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ, কণ্ঠশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎসহ হাজার মানুষের ঢল নেমে যায় হাসপাতাল প্রাঙ্গণে।

জানা যায় গত ১৬ অক্টোবর রাতে রংপুরে একটি কনসার্ট শেষ করে ১৭ অক্টোবর দুপুরে ঢাকায় ফিরেন আইয়ুব বাচ্চু। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বাসায় হার্ট অ্যাটাক করেন তিনি। তড়িঘড়ি তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটের দিকে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঠিক যেন তাঁর সুরে গান গাওয়া কথা গুলোর মতো করেই চলে গেলেন-"এই রুপালি গিটার ফেলে/একদিন চলে যাবো দুরে, বহুদূরে/সেদিন চোখে অশ্রু তুমি রেখো গোপন করে ।"

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী,বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের শোক

আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান।

আলাদা এক শোকবার্তায় আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন সৌদি সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাঁর শোক বার্তায় বলেন, জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী হিসেবে আইয়ুব বাচ্চু’র গাওয়া গান এদেশের তরুণ ছেলে-মেয়েদের যেভাবে উদ্বেলিত করতো তা অতুলনীয়। তার মৃত্যু সঙ্গীতপ্রিয় মানুষদের জন্য অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ও বেদনার। তার মৃত্যুতে দেশ হারালো অসাধারণ একজন গুণী শিল্পীকে।

সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোক

আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার ভক্ত, অনুসারি ও বিভিন্ন অঙ্গনের অনেক তারকাই শোক প্রকাশ করেছেন। মৃত্যুর খবর শোনার পর সঙ্গীত শিল্পী রবি চৌধুরী বলেন, ‘আমি এতো সকালে ঘুম থেকে উঠি না। বেশ কয়েকজন ফোন করে জানালেন আইয়ুব বাচ্চু আর নেই। বিশ্বাসই করতে পারিনি। হাসপাতালে ছুটে এসেছি। বুঝলাম বাচ্চু আর নেই। অঝোরে কাঁদছি।’

আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান নায়ক ফেরদৌস। তার সঙ্গে নিজের শেষ স্মৃতির কথা জানিয়ে ফেরদৌস বলেন, ‘আমার একটা সিনেমাতে তার প্লেব্যাক ছিল। শেষ যেদিন তার সঙ্গে দেখা হয় তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, হিরো এত সুন্দর একটা গান গেয়ে দিলাম, আর সিনেমাতে এটা কী করলা। যদি পারো গানটি নিয়ে আবার কাজ কইরো, ফুটিয়ে তুইলো।’

হাসপাতালে ছুটে যান দেবাশীষ বিশ্বাস। তিনি বলেন, উনাকে (আইয়ুব বাচ্চু) নিয়ে আজ এভাবে মিডিয়ার সামনে দাঁড়াতে হবে ভাবিনি। উনার সঙ্গে অনেক স্মৃতি রয়েছে। অনেক গভীর সম্পর্ক ছিল। অনেক পুরনো। ছোটবেলা থেকেই উনার গান শুনে, গিটার শুনে, গান দেখে অনুভব করেই বড় হওয়া। অনেক সময়ই বলেছি, শরীরের দিকে একটু যত্নশীল হন। একটু সাবধানে থাকেন। উনি বলতেন, ধুর দেবো, আমি তোর থেকেও ইয়াং।

সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিত বলেন, ‘খবরটা শুনে আমি আসলে ঠিক নেই। গত পরশু দিন ও (বাচ্চু) রংপুরে ছিল। এর মধ্যে ওর সঙ্গে আমার কথাও হয়নি। এদিকে ওর মুঠো ফোনও বন্ধ পাচ্ছি। কার সঙ্গে যে যোগাযোগ করব বুঝতেছি না।’

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল জানান, ‘বাচ্চু বড় হওয়ার পর ওর সঙ্গে কাজ করেছি কিন্তু সেসব স্মৃতির চেয়ে ছোটবেলার স্মৃতিগুলো বার বার আমাকে নাড়িয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলার সময়গুলোর গভীরতা অনেক বেশি। যা আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না। ও আমার গানের সঙ্গে গিটার বাজাত। একসঙ্গে বসে আড্ডা, গল্প চলত। এসবই এখন স্মৃতি। এসবের অনুভূতি অন্যরকম।

এক স্মৃতির কথা স্মরণ করে এবং একটি ছবি পোস্ট করে ফকির আলমগীর তার ফেসবুকে লেখেন, ‘যমুনার পাড়ে কোন এক সিটিসেল মিউজিক অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে আমরা। ছবির মাঝ থেকে সংগীতের কিংবদন্তী মোহাম্মদ আব্দুল জব্বারকে হারিয়েছি ২০১৭ তে। আর এবার হারালাম রুপালি গিটার আর ব্যান্ড সংগীতের কিংবদন্তী আইউব বাচ্চুকে। তাদের আত্মার শান্তি কামনা করি।’

ক্রিকেটারদের শোক

প্রিয় শিল্পীর আকস্মিক মৃত্যু মেনে নিতে কষ্ঠ হয়েছে টাইগারদের। কিছুক্ষণের জন্য থমকে গিয়েছিল তাদের অনুশীলন।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে যখন জিম্বাবুয়ে সিরিজের অনুশীলনে ব্যস্ত ছিল টিম টাইগার, ঠিক তখনই আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর সংবাদটি আসে তাদের কাছে।

প্রিয় শিল্পীর জন্য শোক জানিয়েছেন সবাই। ব্যান্ড সংগীত প্রিয় বাংলাদেশ ক্রিকেটার দল। এ কথা সবারই জানা। ব্যান্ড দলের সেরা সব গান প্রায় সবারই ঠোঁটস্থ।

তবে আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, মাইলস সবারই প্রিয়। আইয়ুব বাচ্চু মিশে আছেন তাদের অনুপ্রেরণায়। অনুশীলনের ফাঁকে, আড্ডাতে আইয়ুব বাচ্চু, জেমসের গান গেয়ে নিজেদের চাঙ্গা করেন ক্রিকেটাররা।

মাশরাফি মুর্তজাদের বেড়ে ওঠার অনেকটা সময় কেটেছে জেমস, আইয়ুব বাচ্চুর গান শোনে। আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর সংবাদে মাশরাফি নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিজেন্ডের সেই গানটি লিখেছেন- ‘সবাইকে একা করে চলে যাব অন্ধ ঘরে, এ শহরে গাড়ি-বাড়ি কিছুই রবে না’। আইয়ুব বাচ্চুর এমন আকস্মিক মৃত্যুতে শোক, ও ভালোবাসা জানিয়েছেন বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের এ অধিনায়ক।

শোক জানিয়ে ব্যক্তিগত ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করেছেন মুশফিকুর রহিম। প্রয়াত শিল্পীর জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছেন তিনি। আইয়ুব বাচ্চুর একজন বড়মাপের ভক্ত জানিয়ে ফাস্টবলার রুবেল হোসেন বাচ্চুর সঙ্গে তার একটি ছবি দিয়েছেন ফেসবুকে।

তিনি লিখেছেন, ‘ইন্নাইলাহি ওয়া ইন্না ইলাহির রাজিউন। সত্যি মানতে পারছি না আমি ছোটবেলা থেকেই জেমস ভাই, বাচ্চু ভাই- এদের গান শুনি। আমি বাচ্চু ভাইয়ের বিশাল বড় একজন ফ্যান, সেদিনও টিভিতে তার কনসার্ট দেখছিলাম- আল্লাহ এটি কি হয়ে গেল! আসলে সবাইকে চলে যেতে হবে একদিন এটিই বাস্তবতা তার জন্য সবাই দোয়া করবেন... আল্লাহ যেন প্রিয় শিল্পীকে বেহেশত নসিব করেন আমিন।’

মায়ের কবরের পাশে শায়িত হবেন আইয়ুব বাচ্চু

গুণী এ শিল্পীর নামাজে জানাজা আগামীকাল শুক্রবার বাদ জুমা জাতীয় ঈদগাহে অনুষ্ঠিত হবে। আইয়ুব বাচ্চুর প্রতি সর্বসাধারণের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত তার মরদেহ রাখা হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ নেওয়া হবে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে। সেখানে জানাজা শেষে আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ নেওয়া হবে চট্টগ্রামের পৈতৃক নিবাসে। সেখানে শনিবার মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন আইয়ুব বাচ্চু।

একনজরে

১৯৬২ সালে ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আইয়ুব বাচ্চু। ১৯৭৮ সালে ফিলিংস ব্যান্ডের মাধ্যমে সংগীত জগতে তার পথচলা শুরু হয়। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সোলস ব্যান্ডে লিড গিটারিস্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন তিনি।

১৯৯১ সালে এলআরবি ব্যান্ড গঠন করেন আইয়ুব বাচ্চু। এর প্রথম অ্যালবাম ‘এলআরবি’ বাজারে আসে ১৯৯২ সালে। এটাই দেশে প্রথম ডাবল অ্যালবাম। এলআরবির অন্য অ্যালবামগুলো হলো ‘সুখ’ (১৯৯৩), ‘তবুও’ (১৯৯৪), ‘ঘুমন্ত শহরে’ (১৯৯৫), ‘ফেরারি মন’ ও ‘স্বপ্ন’ (১৯৯৬), ‘আমাদের’ (১৯৯৮), ‘বিস্ময়’ (১৯৯৮), ‘মন চাইলে মন পাবে’ (২০০১), ‘অচেনা জীবন’ (২০০৩), ‘মনে আছে নাকি নাই’ (২০০৫), ‘স্পর্শ’ (২০০৮), ‘যুদ্ধ’ (২০১২) এবং সর্বশেষ ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’ (২০১৬)।

১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ‘রক্তগোলাপ’ হলো তার প্রথম প্রকাশিত একক অ্যালবাম। তার সাফল্যের শুরুটা হয় দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ময়না’র (১৯৮৮) মাধ্যমে। ১৯৯৫ সালে বাজারে আসে তার তৃতীয় একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। এর প্রায় সব গানই জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে ‘কষ্ট কাকে বলে’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘অবাক হৃদয়’, ‘আমিও মানুষ’ গানগুলো।

তার অন্য একক অ্যালবামগুলো হলো ‘সময়’ (১৯৯৮), ‘একা’ (১৯৯৯), ‘প্রেম তুমি কি’ (২০০২), ‘দুটি মন’ (২০০২), ‘কাফেলা’ (২০০২), ‘রিমঝিম বৃষ্টি’ (২০০৮), ‘বলিনি কখনো’ (২০০৯), ‘জীবনের গল্প’ (২০১৫)।

(জাস্ট নিউজ/এমজে/জিএস/২১০০ঘ)