পাক-নির্বাচনে পিপিপি’র পুনরুত্থান

পাক-নির্বাচনে পিপিপি’র পুনরুত্থান

ঢাকা, ৬ জুন (জাস্ট নিউজ) : আসন্ন নির্বাচনে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি ও সমর্থকদের আকর্ষণ কুড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে পাকিস্তানের একমাত্র প্রধান বাম-পন্থী দল পাকিস্তান পিপল’স পার্টি(পিপিপি)। নতুন করে পুনরুত্থানের চেষ্টা চালাচ্ছে জুলফিকার আলি ভুট্টোর দল। বর্তমানে দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভুট্টো পরিবারের তরুণ বংশধর বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। দলটির পুনরুত্থান নিয়ে একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

রয়টার্সের প্রতিবেদন বলা হয়, আর কয়েক সপ্তাহ পরই পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনে নিজেদের জায়গা দখলের চেষ্টায় নেমেছে পিপিপি। পিপিপি’র নেতা হিসেবে বিলাওয়ালের প্রথম নির্বাচনী প্রচারণা এটি। তার মা ও পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর সময়কালে পিপিপি যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল তা পুনরায় অর্জনের চেষ্টা করছেন বিলাওয়াল। উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে বেনজির নির্বাসন থেকে ফিরে আসার পর আততায়ীর হাতে খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত পিপিপি’র জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়।

মায়ের মতো বিলাওয়ালও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। দলের কর্মীদের বিশ্বাস, ২৯ বছর বয়সী এই তরুণ নেতা দলের ভেতর প্রাণ সঞ্চার করেছে। ২৫ জুলাইয়ের নির্বাচনের আগে দলটি তাদের জনপ্রিয় দিনগুলো পুনর্জীবিত করতে পারবে বলে প্রত্যাশা করছে।

পিপিপি সিনেটর শেরি রহমান বলেন, আমাদের প্রচারণার নেতৃত্বে বিলাওয়াল থাকায় আমরা প্রত্যাশা করছি যে, চরমপন্থীতা, অব্যবস্থাপনা ও গণতন্ত্র-বিরোধী ধারার প্রবাহ পাল্টে দিতে আমাদের যে যাত্রা, তরুণদের একটি বিশাল অংশ সে যাত্রার সঙ্গী হবে। বিলাওয়ালের বাবা, আসিফ আলি জারদারি পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট। তিনি পিপিপি’র জন্য সৌভাগ্য হবেন না দুর্ভাগ্য বয়ে আনবেন সে বিষয়ে অবশ্য অনেক বিতর্ক রয়েছে।

কয়েকজন বিশ্লেষকের ও পিপিপি’র অভ্যন্তরের কর্মীদের ধারণা, জারদারির কলঙ্কিত ভাবমূর্তির কারণে দলটি বেশ কিছু দুর্নীতির অভিযোগের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এতে করে নির্বাচনে দলটির ক্ষতি হতে পারে। আর সেটা সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের(পিটিআই) পক্ষে কাজ করবে।

অন্যদিকে, অনেকের ধারণা, পুনরায় শীর্ষ দল হিসেবে নিজের অবস্থান শক্ত করার জন্য পিপিপি’র জন্য সবচেয়ে ভাল রাস্তা হচ্ছে পিটিআই’য়ের সঙ্গে জোট গঠন করা। কেননা গত পাঁচ বছরে পিটিআই’য়ের জনপ্রিয়তা পিপিপি’কে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু জোট গঠনের জন্য জারদারি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।

এক সময় পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল ছিল পিপিপি। কিন্তু বর্তমানে দেশের জনগণের কাছে আগের আকর্ষণ খুইয়েছে দলটি। জাতীয় পর্যায়ে দলটির তেমন কোন প্রভাব নেই। সেক্ষেত্রে বিশ্লেষকদের মতে, জোট গঠনের জন্য দলটির সবচেয়ে সক্ষম ব্যক্তি হচ্ছেন বিলাওয়ালের বাবা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক আমির আহমেদ খান বলেন, জারদারি নিজেকে একজন নির্বাচন- পূর্ববর্তী মধ্যস্ততাকারী হিসেবে দেখছেন। প্রকৃত নির্বাচনী যুদ্ধে কোন শীর্ষ খেলোয়াড় হিসেবে নয়। পিপিপি ও পিটিআই, উভয় দলের কর্মকর্তারাই কোন জোট গঠনের সম্ভাবনা নিয়ে বেশ অনিচ্ছুক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। তবে কোন দলই সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেননি।

‘মি. টেন পার্সেন্ট’
হত্যা ও দুর্নীতির অভিযোগে ১১ বছর কারাগারে কাটিয়ে এসেছেন জারদারি। যদিও তার বিরুদ্ধে আনা কোন অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি। তিনি নির্দোষ ব্যক্তি হিসেবে তার অবস্থান ধরে রেখেছেন। প্রথমে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। পরবর্তীতে আবার ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত। ২০০৪ সালে কারাগার থেকে তাকে মুক্ত করে দেয়া হলেও পাকিস্তানে ফেরেননি তিনি। তিন বছর আত্ম-নির্বাসনে থাকার পর ২০০৭ সালে বেনজিরের সঙ্গে দেশে ফেরেন সাবেক পাক-প্রেসিডেন্ট।

বেনজির আর জারদারির উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সামরিক শাসনের সমাপ্তি ঘটানো। কিন্তু পরবর্তীতে নির্বাচনী প্রচারণার সময় আততায়ীর হাতে খুন হন বেনজির। এই ঘটনায় ভুট্টো পরিবারের অবস্থান ভারতের গান্ধী পরিবার ও আমেরিকার কেনেডি পরিবারের সমপর্যায়ে চলে আসে।

১৯৭৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের পর বেনজিরের বাবা পিপিপি’র প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকারকে ফাঁসিতে ঝোলানোর নির্দেশ দেন জেনারেল জিয়াউল-হক। বেনজিরের ভাই মুর্তজাকে করাচিতে ১৯৯৬ সালে গুলি করে হত্যা করা হয়। মুর্তজা হত্যার অভিযোগ আনা হয় জারদারির বিরুদ্ধে। কিন্তু আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হন তিনি।

বেনজির ভুট্টো পাকিস্তানে ফেরত যাওয়ার পর দেশজুড়ে পিপিপি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তার মৃত্যুর পরও সে জনপ্রিয়তার বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় আসেন জারদারি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ব্যাপক ক্ষমতার ব্যবহার করেন তিনি।

জারদারির বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলোর একটিতেও তিনি দোষী প্রমাণিত না হলেও,তার ভাবমূর্তিতে কলঙ্কের দাগ লেগে যায়। তাকে অনেকে ‘মি. টেন পার্সেন্ট’ নামে ডাকা শুরু করে।

পিপিপি সিনেটর ফারাতুল্লাহ বাবার বলেন, আমার মনে হয় আসিফ জারদারি তার বিরুদ্ধে চালানো ব্যাপক নেতিবাচক অপপ্রচারের শিকার। এসব অপপ্রচারের একটিও যদি সত্য হতো, তাহলে তিনি দোষী সাব্যস্ত না হয়েও ১১ বছর কারাগারে কাটাতেন না।



‘কিংমেকার’
পাকিস্তানের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে অনেকের অভিযোগ রয়েছে যে, দেশটির শক্তিশালী সামরিক বাহিনী সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের দল, ক্ষমতাসীন পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজকে(পিএমএল-এন) অস্থিতিশীল করে ইমরান খানের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ সুগম করে দিচ্ছে।

পিপিপি সিনেটর বাবার বলেন, আমরা নির্বাচনের আগে অনেক ধরণের কৌশলের ব্যবহার দেখতে পাচ্ছি। অনেক দলের কর্মীরা একটি নির্দিষ্ট দলে যোগ দিচ্ছে।

তবে সামরিক বাহিনী বেশ কয়েকবার রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। ইমরান খানও সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের সঙ্গে কোন ধরণের পরিকল্পনা করার কথা অস্বীকার করেছেন। উল্লেখ্য, পাকিস্তানের ইতিহাসের অর্ধেক সময় সামরিক বাহিনী দেশটি শাসন করেছে।

ভুট্টো-জারদারি পরিবারের নেতৃত্বাধীন দল হওয়ার কারণে পিপিপি এক ধরণের জনপ্রিয়তা ও সমর্থন পাবে। তবে সম্প্রতি সে বিষয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটনা দেখা গেছে। পিপিপি’র শক্ত ঘাটি সিন্ধ প্রদেশে পিটিআই’য়ের কাছে মার্চ মাসের নির্বাচনে হেরেছে দলটি। সেখানে পিপিপি পেয়েছে ১৭ শতাংশ ভোট, পিটিআই পেয়েছে ২৪ শতাংশ ভোট ও পিএমএল-এন পেয়েছে ৩৬ শতাংশ ভোট।

এই হিসেব থেকে এটা বোঝা যায় যে, পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো যদি ক্ষমতায় আসতে চায় তাহলে অবশ্যই তাদেরকে জোট গঠন করতে হবে। ইসলামাবাদের কেউ কেউ মনে করেন জারদারি গোপনে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছেন। মার্চ মাস থেকে এ সন্দের আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। কেননা সেসময় পিপিপি’র কাছে সিনেটের নেতৃত্বের সুযোগ থাকলেও দলটি সে সুযোগ ব্যবহার করেনি। তার বদলে, সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন প্রার্থীকে সিনেট চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে সহায়তা করেছিল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক আমির আহমেদ খান বলেন, জারদারির বিশ্বাস, যখন জোট সরকার গঠনের সময় আসবে তখন দলগুলোর তার মতন একজনকে দরকার হবে। আর তখন তিনি হবেন ‘কিংমেকার’।

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/২২৩৫ঘ.)