একাকীত্ব

একাকীত্ব

নাইম আবদুল্লাহ

সকালে ফজরের আজান হচ্ছে। হালিমা বিছানার উপর উঠে বসে। ক্লিনিকের জানালার সাদা পর্দার ফাঁক দিয়ে রাতের কালো অন্ধকার ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে। দূরে রাত জাগা পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ ভেসে আসছে। পাশের রুমের রুগী সাড়া রাতের ডাক চিৎকার শেষে হয়তো তন্দ্রা দেবীর আশীর্বাদ পেয়ে অচেতন ঘুমে তলিয়ে গেছে। একটু পরেই ওয়ার্ড বয় আয়া আর নার্সদের চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হবে।

সপ্তাহ খানেক আগে হালিমার বুকের ব্যথাটা বাড়াতে ছেলেরা তাকে জোর করে ক্লিনিকে ভর্তি করে দেয়। এখানে তার থাকতে খুব একটা খারাপ লাগছে না। সারাদিন ডাক্তার নার্স আর আয়াদের সাথে কত কথা হয়। আগে শুনেছিলো হাসপাতাল, জেলখানা এসব নাকি ভাল জায়গা না। ক্লিনিকের ডাক্তাররা নাকি গোমরা মুখী আর নার্স-আয়ারা নাকি কানে কালা হয়। কিন্তু এখানকার ইনটার্নী ডাক্তার গুলো বেশ হাসিখুশি। মনে হয় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তাদের চোখে মুখে ঝলমল করছে। অধ্যাপক ডাক্তারদের মনে হয় কোন একটা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে তারা যাচ্ছে। সব কিছুতেই কেমন যেন বিরক্ত।

অবশ্য এই পঁচাত্তর বছর বয়সে সে মাত্র হাতে গোনা কয়েকবার ক্লিনিকে ভর্তি হতে হয়েছে। আজ সকাল ছয়টা থেকে ইনটার্নী ডাক্তার ঝুমুর ডিউটি আছে। এই অল্প কয়েকদিনেই ওর সাথে কিভাবে যেন হৃদ্যতা গড়ে উঠেছে। মেয়েটার কথা ভাবতে ভাবতে সে পর্দা ঠেলে রুমে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলো দাদীমা আজ কেমন আছেন? বলেই তার হাত ধরে পাশে এসে বসলো। ভাল আছি বুবু। তারপর বেডের পাশ থেকে চার্টটা তুলে নিয়ে চোখ বুলাতে বুলাতে বললো প্রেশার পালস সব কিছুই নরমাল আছে। মাথা ঘুরাটা একটু কমেছে?

হ্যাঁ, বুবু এখন নিজে নিজে বাথরুমে যেতে পারি। তারপর টুকিটাকি আরও কিছু কথার পর ঝুমু তার পাকা চুলে হাত বুলিয়ে অন্য ওয়ার্ডে টহল দিতে বেরিয়ে গেল।

তারপর আয়া নাস্তা নিয়ে এলো। পাশের টেবিলে ট্রে নামিয়ে রাখতে রাখতে বললো খালাজী, কেমন আছেন? আজ সাথে করে আপনার জন্য পান সুপারি আনছি। নাস্তা খাওনের পর একটা খিলি মুখে দিয়া দেইখেন। বলেই শাড়ির আঁচলের ভেতর থেকে এক খিলি পান বের করে টেবিলে রেখে বললো একটু আজাইড় হইয়া তয় পরে আমুনে। এখন হগল কেবিনে নাস্তা দেওয়ন লাগবো।

হালিমা একটুকরা পাউরুটি চায়ে ভিজিয়ে নাস্তা শেষ করলো। তারপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও পানের খিলি খুলে একটু পান আর সুপারি ছিঁড়ে নিয়ে মুখে দিলো।

কিছুক্ষণ পরেই নার্স ঔষধ নিয়ে ঢুকলো। ট্যাবলেট গুলোর খোসা ছাড়িয়ে হাতে দিতে দিতে বললো বুড়ীমা কেমন আছেন? আপনার খুব তাড়াতাড়ি এখান থেকে ছুটি হয়ে যাবে।

কিছুক্ষণ পরে হালিমা উঠে গিয়ে জানালার পর্দাটা একটু সরিয়ে দিলো। সকালের উজ্জ্বল আলোয় সাড়া রুম ঝলমল করে উঠলো। এখান থেকে চলে যেতে হবে শুনে মনটা যেন হঠাৎ খারাপ হয়ে গেলো। এই সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই সবাই কেমন যেন চির আপন হয়ে উঠেছে।

হালিমা ও তিন ছেলেকে রেখে তার স্বামী গত হয়েছে বহুকাল আগে। সে ছেলেগুলোকে আগলে রেখে লেখাপড়া শিখিয়ে সবাইকেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বড় ছেলের জন্য নিজের ভাইয়ের মেয়ে বানীকে বৌ করে ঘরে এনেছে। সে বিয়ের পরে লেখাপড়া শেষ করেছে। এইতো খুব বেশীদিন আগের কথা নয়। বানী যখন বাংলায় এমএ পরে তখন একবার ক্লাসে “ তেল সুরুজ জ্বলে নিভু নিভু” বাক্যের সৌন্দর্য বিশ্লেষণ করতে দিয়েছিল। মনে পড়লে এখনও অবাক লাগে সে যেন কিভাবে খুব গুছিয়ে সেটা লিখে দিয়েছিল। বানীদের ক্লাসের ছেলেমেয়েরা সেটা পড়ে খুব অবাক আর মুগ্ধ হয়ে হালিমার সাথে বাসায় দেখা করতে এসেছিল। তার পড়াশুনা বেশিদূর গড়াতে পারেনি। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরপরই তার বিয়ে হয়ে যায়। আর তাদের সেই আমলে হাই স্কুল পর্যন্ত যাওয়াও ছিল ভাগ্যের ব্যাপার।

বড় ছেলের বিয়ের পরে সে আলাদা সংসার শুরু করলো। কিছুদিন পর মেঝ ছেলেরও বিয়ে করে বৌ নিয়ে নূতন সংসার সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তারপর হালিমা ছোট ছেলেটার সঙ্গে থাকতো। বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান, বাচ্চাদের জন্মদিন, ঈদ ইত্যাদিতে হালিমা ছেলেদের বাসায় বেড়াতে যেত। হয়তো বা অনেক আবদার আপত্তির পর এক আধ রাত থেকেও আসতো। কিন্তু বড় দুই ছেলের সংসারে সে কখনো দিনের পর দিনে গিয়ে থাকেনি।

ছোট ছেলের বিয়ে হল বেশ কয়েকবছর পরে। এবারও হালিমার তাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। কারণ মায়ের যে স্নেহ-মমতা ছেলেমেয়েদের উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে তা বিয়ের পর ঢিলেঢালা না হলে স্বামী-স্ত্রী নামক দুটি ভিন্ন সত্ত্বার একত্রে জোড়া লাগার ক্ষেত্রে অন্তরায় দেখা দেয়। হালিমার কাছে মনে হয় মায়ের ভূমিকায় পথ আগলে দাড়িয়ে থেকে বৌকে জায়গা ছেড়ে না দিলে সেখানে সব কিছু দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে।

ছোট ছেলের বৌ ঘরে আনার কিছুদিন পর হালিমা নূতন নীড়ের সন্ধানে নেমে পড়ে। কাউকে আঁকড়ে ধরে তার চলার পথকে বিলম্বিত বা বাধাগ্রস্ত করার কোন মানে হয় না। হালিমা বেড়াতে যাবার নাম করে কয়েকদিনের জন্য তার ভাইয়ের বাসায় এসে ওঠে। ছোট ছেলে কিছুটা আচ করতে পেরে বার বার মাকে তার বাসায় নিয়ে যেতে আসে। হালিমা একথা সেকথা বলে তাকে ফিরিয়ে দেয়। সে ইচ্ছে করলে বড় দুই ছেলের বাসায় গিয়ে নাতি-নাতনী সহ হৈ চৈ করে সময় কাটাতে পারে। কিন্তু নাতি-নাতনীদের জীবনে বাবা মায়ের আদেশ শাসনে তার উপস্থিতি নাজুক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে ভেবে তার ভাইয়ের বাসায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বানীর আম্মা গত হয়েছে এক যুগেরও বেশী সময় হবে। ভাই-বোন বাকী জীবন হেসে খেলে পার করে দিতে পারবে।
হঠাৎ কখন যে ঝুমু তার পাশে এসে বসেছে টেরই পায়নি। সম্বিত ফিরে পেতে দেখে ঝুমু তাকে দু’ হাতে গলা জড়িয়ে ধরে বললো
দাদীমা এত মনোযোগ দিয়ে কি ভাবছেন?

হালিমা পরিবেশটাকে হালকা করার জন্য বলে উঠলো এতক্ষণ মনে মনে বুবুর জন্য একটা শান্তশিষ্ট বরের ধ্যান করছিলাম। ঝুমুর কপট প্রতিবাদের সুরে বললো
ভাল হবেনা কিন্তু দাদীমা। তারপর দুজনে মিলে হাসতে হাসতে লুটোপুটি যাওয়ার অবস্থা।

তখন বাইরে থেকে কড়া নেড়ে বড় ডাক্তার ঢুকে গম্ভীর সুরে বললো,আপনাকে আজ বিকেলে ক্লিনিক থেকে রিলিজ করে দিচ্ছি। আমি কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি। বাসায় গিয়ে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করলে আর নিজের শরীরের যতœ নিলে আশা করি সুস্থ থাকবেন। বড় ডাক্তার বেরিয়ে যাবার পর হালিয়া আর ঝুমুর দুজনেই মনখারাপ করে ফেললো। অবশেষে হালিমাই মুখ খুললো

বুবু আমি তোমাকে আমাদের বাসার ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর সব লিখে দিয়ে যাবো। তুমি যখনই সময় পাবে আমাদের বাসায় চলে আসবে। তারপর পরিবেশ আরও স্বাভাবিক করার জন্য বললো একা একা আসলে কিন্তু আমি দেখা করবো না। তোমার হবু বরকেও সঙ্গে নিয়ে এসে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিও। তখন সবাই মিলে অনেক গল্প আর মজা করবো।

হালিমা ক্লিনিক থেকে বিদায় নেবার সময় ওয়ার্ডের বয়, আয়া, নার্স সবারই খুব মন খারাপ। হালিমা নিজেও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। বাসায় এসে তার বেশ একা একা লাগছে। অনেকদিন পর তার মৃত স্বামীর কথা বার বার মনে পড়ছে। আজ সে বেঁচে থাকলে এভাবে তাকে যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াতে হতো না। তার একটা নিজস্ব ঠিকানা থাকতো, একটা ঘর থাকতো, সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়ার মতো তার পাশাপাশি কেউ থাকতো। এই বয়সে তাকে তার খুব প্রয়োজন ছিল।

সিডনি প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক