‘নানাভাবে বাধা আসে, ভয় আসে’

‘নানাভাবে বাধা আসে, ভয় আসে’

ঢাকা, ৪ নভেম্বর (জাস্ট নিউজ) : দেশের শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেছেন, বিগত ২০ বছরে আমাদের দেশের রাজনীতিতে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। এ কথা বলতে কোন দ্বিধা নেই, বাংলাদেশের সংবাদপত্র যারা সাহস করে সত্য কথা বলতে চায় তাদের জন্য কাজটা খুব সহজ নয়, সহায়ক নয়। নানাভাবে বাধা আসে, ভয় আসে, মামলা-মোকদ্দমা হয়, সাংবাদিকরা পিটুনি খান, আহত হন, জেলে যান। আবার অন্যদিকে এমন পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয় যাতে ভয়ে থাকতে হয়, ভয় পেতে হয়।

প্রথম আলোর ২০ বছর পূর্তিতে চ্যানেল আইয়ের আজকের সংবাদপত্র অনুষ্ঠানে শনিবার রাতে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনায় ছিলেন মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সাম্প্রতিক পরিস্থিতি আর প্রথম আলোর যাত্রার বিষয়ে আলোচনা হয়।

মতিউর রহমান চৌধুরী: শুরুতেই প্রথম আলোর যাত্রার কথা শুনতে চাই।

মতিউর রহমান: ২০ বছরে পা রাখলো প্রথম আলো। আমি ভোরের কাগজ ছেড়ে আসার দুই মাসের মধ্যে প্রথম আলো শুরু করেছিলাম। খুব অল্প সময়ের মধ্যে শুরু করি। অভিজ্ঞতা তেমন বড় ছিল না, অনেক ভয়ের মধ্যে ছিলাম। ১০৪ জন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করে প্রথম আলো, যা প্রথম দিনে ছাপা হয় এক লাখ ২২ হাজার কপি। সেদিন সব কপিই বিক্রি হয়ে যায়। এরকম যাত্রা আমাদের আস্থাশীল করেছিল। আমার সঙ্গে যারা যোগ দিয়েছিলেন তারা ছিলেন বয়সে তরুণ, নবীণ, উদ্যোমী-পরিশ্রমী এবং ভালো কর্মী। এভাবেই আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল, আর একটা কথা বলবো, আমরা একটি মুক্ত-স্বাধীন, গণতান্ত্রিক সংবাদপত্র প্রকাশ করতে চাই। সাহস, স্বাধীন সত্যপ্রকাশ প্রথম আলোর সফলতা-অগ্রযাত্রার পথে প্রধান সহায় বলে আমি মনে করি। তবে আগের সময়ের চেয়ে এটি কম করতে পারছি। আপনি ডিজিটাল আইন বলেন, নতুন করে যেটা হয়েছে, সম্প্রচার নীতিমালা বা হঠাৎ করে গণমাধ্যম কর্মী আইন করা হয়েছে প্রত্যেকটার মধ্যেই নানা আইন নীতি বা কৌশল বা পদ্ধতি আছে যাতে করে কোনো না কোনোভাবে আপনাকে, সংবাদকর্মীকে, একজন ব্যক্তিকে, একজন সম্পাদককে কিংবা সংবাদপত্রকে যথেষ্ট পরিমাণে বিব্রত অবস্থায় ফেলা যেতে পারে, বিপদে ফেলা যেতে পারে। এমনকি তাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, সেটা হবে কি, হবে না, কখন কোনটা কি হবে সেটার আমাদের তো কোনো নিশ্চয়তা নেই, গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। আমি আপনাদের একটু পেছনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো, আপনারা জানেন যে আমি ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নানা ধরণের কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলাম। ১৯৬২ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খানের যে শাসনবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে শুরু হয়েছিল, সেদিন আমাদের স্লোগান ছিল কথা বলার অধিকার চাই। মতপ্রকাশের অধিকার চাই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই। গণতান্ত্রিক অধিকার চাই, নির্বাচন চাই, ভোট চাই, সামরিক শাসন বাতিল চাই। দেখেন ওই যে স্লোগানগুলো, কথা বলার অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অধিকার, সংগঠন করার অধিকার এ বিষয়গুলো কিন্তু ঘুরেফিরে ৫৭ বছর পরও আমাদেরকে বলে যেতে হচ্ছে। আজকে সরকার যত বলুক না কেন, আমাদের তথ্যমন্ত্রী যতই বলুন না কেন সংবাদপত্র স্বাধীন, মুক্ত-গণতান্ত্রিক পরিবেশ কাজ করতে পারছে এটা আসলে সত্য নয়। পদে পদে বাধা নানা ঝামেলা, নানা ভয়ের মধ্যে আমাদের কাজ করতে হয়। আর বিজ্ঞাপন নিয়ে তো প্রতি সরকারের আমলেই আমাদেরকে ঝামেলায় পড়তে হয়। আগে ছিল সরকারি বিজ্ঞাপন নিয়ে সমস্যা, আজকাল তো ব্যক্তিখাতের বিজ্ঞাপনের ওপরও নানা বিধি-নিষেধ দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ কোন কোন ক্ষেত্রে সংবাদপত্র মাধ্যমকে একটু আটকে ফেলার চাপে ফেলে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।

মতিউর রহমান চৌধুরী: প্রথম আলোর এবারে স্লোগান, ভালোর সাথে আলোর পথে এটা নিয়ে কিছু বলবেন?

মতিউর রহমান: প্রথম আলো, আমরা শুরু করেছিলাম আমরা বলেছিলাম, যা কিছু ভালো তার সঙ্গে প্রথম আলো। তো আমরা একটা সংবাদপত্র, সংবাদ দেব, সমাজের নানা রকম সংবাদ দেবো, দুর্নীতি, হত্যা-ধর্ষণ নানা রকম খবর দেবো। আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের সমাজের-রাষ্ট্রের মানুষের যে ভালো দিকগুলি আছে, সফলতার খবর আছে, ভালো বিষয় আছে সেগুলো যেন যথোপযুক্তভাবে আমাদের কাগজে তুলে আনতে পারি। শুধু তাই না, ব্যক্তি মানুষ, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, সরকার যখনই ভালো কিছু করবে যথাযথভাবে দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরবো এটা আমাদের এক ধরনের লক্ষ্য। আমরা ভালোর সঙ্গে থাকবো। একইসঙ্গে আমাদের অর্থনীতি, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাক্ষেত্রে, খেলা আমাদের অগ্রগতি হয়েছে অনেক। ক্রিকেট বলেন, ফুটবল বলেন, ছেলেদের-কিশোর-কিশোরীদের ফুটবল অগ্রগতি হচ্ছে। আমরা এ আলোর পথের যাত্রাকে সহায়তা করতে চাই, সুগম করতে চাই, সহযোগী থাকতে চাই। সেজন্য প্রথম আলোর গত ২০ বছর ধরে নানা কর্মযজ্ঞ করে চলেছে, ভাষা প্রতিযোগিতা, গণিত অলিম্পিয়াড, ফিজিক্স, বিতর্ক উৎসব, প্রোগামিং কম্পিটিশন করে কিশোরদের-তরুণদের উৎসাহিত করতে চাই। তারা যেন আলোর পথে, প্রগতির পথে দেশকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সেদিক থেকে আমরা তাদের অনুপ্রাণিত করতে চাই। তারা যেন দেশকে আলোকিত করে। এসিড সন্ত্রাস, মাদকের বিরুদ্ধে আন্দোলন, দরিদ্র মেধাবীদের সহায়তা এ যে কাজগুলো আমরা করেছি, একই লক্ষ্য আমরা আলোর পথে থাকবো, মানুষকে নিয়ে, সমাজকে নিয়ে, দেশকে নিয়ে এগিয়ে যাবো। আগেও বলেছি, এখনো জোর দিয়ে বলছি, ভালোর সাথে আলোর পথে এ কথাকে আমরা সামনে নিয়ে চলেছি।

মতিউর রহমান চৌধুরী: এ মুহূর্তে দেশে নির্বাচনের একটা হাওয়া আছে, দেশে নির্বাচন, গণতন্ত্র, সংলাপ-এই তিনটি শব্দ সবচেয়ে বেশি আলোচিত। দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে আপনার মূল্যায়ন কি, কোন দিকে যাচ্ছি আমরা?

মতিউর রহমান: আসলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত ২৮ বছর ধরে অনেক উত্থান-পতন, অনেক সংঘাত, অনেক বিরোধ, বলা যায় এক প্রকার যুদ্ধ, রাজপথে এসব আমরা দেখেছি। কিন্তু আমরা সব সময় চাই রাজনীতি শান্তিপূর্ণ হোক, রাজনীতি সমঝোতামূলক হোক। রাজনীতির সমস্যাগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হোক। কিন্তু আসলে গত ২৮ বছরে মানে নব্বইয়ের অভ্যুত্থানের পর ৯১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত সে অর্থে কোন ফলপ্রসূ আলোচনা, কোন সমঝোতা, কোন গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়নি। কারা চেষ্টা করেছেন? স্যার নিনিয়ান চেষ্টা করেছেন, রেহমান সোবহানের নেতৃত্বে ৫-৬ জন বুদ্ধিজীবী তারা সেটা করেছেন। আমাদের দেশে জিমি কার্টার এসে চেষ্টা করেছেন, আমাদের দেশে জাতিসংঘের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি তারানকো চেষ্টা করেছেন। আদতে কোন সময় কোন আলোচনাতে কোন ফল হয়নি। তারপরে এবার একটা শুভ লক্ষণ আমি বলবো কোন বাইরের কারো চেষ্টা বা হস্তক্ষেপ ছাড়া, আমাদের রাজনীতিবিদরা, সরকার ও প্রধান বিরোধী শক্তি তারা নিজ উদ্যোগে বসেছেন। ঐক্যফ্রন্ট চিঠি দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী দ্রুত সম্মতি দিয়েছেন, বৈঠক হয়েছে। এবং প্রথম বৈঠকের আলোচনার পরিবেশ ভালো ছিল কিছু অগ্রগতিও হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছেন জনসভায় বাধা দেয়া হবে না, যে কেউ জনসভা করতে পারবেন। রাজনৈতিক গ্রেপ্তার ইত্যাদি বিষয়ে তিনি তালিকা চেয়েছেন, তিনি দেখবেন বলেছেন। অর্থাৎ অন্তত:পক্ষে কিছুটা হলেও একটা-দুইটা বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে, বসা হয়েছে। আমি মনে করি যে, এটা ভালো পথ, ভালো উদ্যোগ। ভালো পথ, এ পথে এগিয়ে যেতে হবে। আজকের খবর জানেন যে ঐক্যফ্রন্ট আবারো চিঠি দেবে, আবারো তারা স্বল্প পরিসরে বসতে চান, এখন ব্যাপার হয়েছে মাত্র দু’মাস সময় আছে। এর মধ্যে অনেক কিছু করতে হবে। চার তারিখে নির্বাচন কমিশন মিটিং করবে। ঐক্যফ্রন্ট চিঠি দিয়েছে ইসিকে, যেন দ্রুত তফসিল ঘোষণা না করা হয়। যেন আলোচনা আরেক রাউন্ড বা কিছু আলোচনার পর যেন এটা ঘোষণা করা হয়। এসব কিছুর অনিশ্চয়তা আছে। উত্তেজনাকর পরিস্থিতি থেকে কিছুটা শান্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আমরা বলি, আমরা সব সময় নির্বাচন চাই, একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন চাই, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই, যেন ভোটাররা গিয়ে সত্যিকার অর্থে তার পছন্দমত ভোট দিয়ে আসতে পারে। কিন্তু বিগত ৫ বছরে আমাদের বিভিন্ন নির্বাচনের অভিজ্ঞতাগুলো এখানে ভালো হয়নি। সাম্প্রতিক কালে যদি বলেন, বরিশাল, যদি বলেন খুলনা, সিলেটে, গাজীপুরে তার থেকে কিন্তু নির্বাচন প্রক্রিয়া, কমিশনের প্রতি মানুষের কিছুটা অনাস্থা, অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছ। কিছুটা আপত্তিকর অবস্থায় তারা আছে। নির্বাচন কমিশনের ভেতরে খুব ভালো, সুন্দর একটা ব্যবস্থাপনা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। সেটা একটা সমস্যা কিন্তু রয়ে গেছে।

মতিউর রহমান চৌধুরী: কেমন নির্বাচন চান আপনি?
মতিউর রহমান: সকল দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। এ কথা বলতে দ্বিধা নাই, ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপি বিরাট ভুল করেছে। এটা বিএনপির জন্য ক্ষতিকর হয়েছে, দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে। আমি চাইবো, আমরা চাই, নিশ্চয়ই আপনিও চাইবেন সব দল যেন নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। তারা যেন সুষ্ঠু স্বাভাবিক পরিবেশে সব কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। এই যে দেখুন, বিগত কয়েক মাস ধরে বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, শত শত হাজার-হাজার। এবং অনেক মামলা দেয়া হচ্ছে যেগুলার আসলে কোন ভিত্তি নাই। এসব করে করে পরিবেশটাকে আর খারাপ যেন না করা হয়। সুষ্ঠু নির্বাচন, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, ভোটকেন্দ্র যেন শান্তিপূর্ণ থাকে, ভোটাররা যেন ভোট দিতে পারে, নিজ পছন্দের দল বা প্রার্থীর প্রতি সেটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। আমাদের সংবাদপত্র হিসেবে এ কথাটাই বার বার করে আমাদের বলতে হবে যে, নির্বাচনের গণতন্ত্রের চেয়ে আর ভালো কোন ব্যবস্থা দুনিয়াতে নাই। আমাদের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, গণতন্ত্র, নির্বাচন- এই পথেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। সেজন্যই আমাদের এ চেষ্টা উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে।

মতিউর রহমান চৌধুরী: আপনি তো এক সময় সিভিল সোসাইটি আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। সিভিল সোসাইটি আন্দোলন এরকম হলো কেন?

মতিউর রহমান: আসলে আমি আপনি যে কেউ সিভিল সোসাইটির অংশ, সংবাদপত্র সিভিল সোসাইটির একটি অংশ, আমি একজন ব্যক্তি-সাংবাদিক হিসেবেও সিভিল সোসাইটির অংশ। আমাকে যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন, রাজনৈতিক আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আমরা আশি-নব্বইয়ের দিকে আসি। তারপর আমি রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাই। অর্থাৎ সাংবাদিক হিসেবে, সংবাদপত্রের কর্মী হিসেবে, সম্পাদক হিসেবে আমাদের চেষ্টা থাকবে, যাতে করে সাংঘর্ষিক রাজনীতি, দ্বন্দের রাজনীতি, দলাদলির রাজনীতি, একটা বিভেদের রাজনীতি, এ পথে যেন আমাদের রাজনীতিবিদরা না যান। আমরা যেন কোন উৎসাহ তাদের না দেই। তাদের যেন সহায়তা করি, একটা অনুকুল পরিবেশ যেন করতে পারি। আমাদের এখানে সিভিল সোসাইটি অতীতের মত এখন সক্রিয় নয়। আসলে বাংলাদেশের ইতিহাসে- আমি বলবো নাগরিক সমাজ ও সংবাদপত্র এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। ৬২, ৫২’র ছাত্র আন্দোলনে শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, লেখক তাদের একটা বড় অংশগ্রহণ ছিল। ৬২’র ছাত্র আন্দোলন, ৬৬’র আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, প্রতিটি ক্ষেত্রে কিন্তু শিল্পী, সাহিত্যিক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও সংবাদপত্র, সাংস্কৃতিক কর্মী তাদের বড় ভূমিকা ছিল। নব্বইয়ের দশকেও তাই ছিল। এবং এই আন্দোলন, নেতৃত্ব, লড়াই-সংগ্রামগুলো রাজনৈতিক দলের সমান্তরালভাবে গেছে। কিন্তু বিগত এক-দুই দশকে আমাদের দুই প্রধান দলের দুই প্রধান রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাজনৈতিক দলের বাইরে অন্য কারো ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিতে চাননি, গ্রহণ করতে পারেনি, মানতে পারেন না। বা এমন একটা অবস্থা তৈরি করা হচ্ছে, যাতে করে সত্যিকার অর্থে যেটা হয়েছে মন খুলে কথা বলা টক শো তে, আপনারা পত্রিকায় অনেক কিছু লেখেন, আসলে সত্যিকার অর্থে অনেক কিছু বলা যায় না, লেখা যায় না। এটা একটা বাস্তব সত্য, আমি সম্পাদক হিসেবে বলি।

মতিউর রহমান চৌধুরী: আপনি কি বলতে চাচ্ছেন সেলফ সেন্সরশিপ আছে?

মতিউর রহমান: আছে। অবশ্যই আছে। আমিও করি। আমাকেও করতে হয়। আমি এটা করতে বাধ্য। অর্থাৎ উন্মুক্ত, খোলামেলা কথা বলার পরিবেশটার অভাব অনুভব করি। একথা যখন তথ্যমন্ত্রী বা অন্য কোন মন্ত্রীর সাথে আমরা বলি। আর এ কথা তো সত্য তথ্যমন্ত্রী যদি বলেন আমার মন্ত্রণালয় তো কিছু করে না। সরকার এখন অনেক বড়, সরকারের এখন অনেক অংশ। সরকারে এখন অনেক প্রতিষ্ঠান। সকলের ওপরে কার কতটুকু প্রভাব নিয়ন্ত্রণ আছে, কি না আছে, সেটা আমরা ঠিক বলতে পারি না। আমরা এর প্রভাব অনুভবন করি। সেদিক থেকে তারপরেও এটা আমরা বলবো যে কোন দেশেই যে কোন পরিস্থিতিতেই সংবাদপত্রের জন্য স্বাধীন, মুক্ত সাংবাদিকতা করা খুব সহজ নয়। আপনি যদি আজকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলেন, পাশের দেশ ভারতের কথা বলেন, অন্যান্য দেশের কথা বলেন সংবাদপত্রকে একটা চাপের মধ্যে থাকতে হয়, চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এটা একটা আমি বলবো যে মন্দের ভালো, আপনি যদি সবকিছু মিলে মিশে একাকার হয়ে যান, সেটাই হয়তো আমাদের বা অন্য দেশের সরকাররা চায়। তাহলে কিন্তু সংবাদপত্রের স্বাধীনতার যে ভূমিকা তারা পালন করতে পারেন না। সংবাদপত্র, সাংবাদিক সবারই প্রত্যেকেরই কিন্তু একটা স্বাধীন, একটা মুক্তচিন্তার প্রতিফলন তার কাজে থাকা দরকার। আমরা কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় আনার চেষ্টা করি না, বা করবো না। যদি এটা চেষ্টা হয়ে থাকে, তাহলে আমি বলবো সেটা সঠিক নয়।

মতিউর রহমান চৌধুরী: সেটা তো রাজনৈতিক সংবাদপত্রের কাজ হতে পারে।

মতিউর রহমান: হ্যাঁ। রাজনৈতিক দলের কর্মীর কাজ হতে পারে। কিন্তু সংবাদপত্রের কর্মীর কাজ কিন্তু সরকারের ভালো থাকলে ভালো বলা। খারাপ থাকলে খারাপ বলা। এবং বিরোধী দলের খারাপ থাকলে খারাপ বলা। সেজন্য সত্যিকার অর্থে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের আমলেই আমাদের অবস্থা খুব সুখকর ছিল না। বা এখনো ধরেন কোনদিক থেকে কোন শুভকর অবস্থা না। কিন্তু তাতেও আমার কোন আপত্তি নাই। আমরা চাই, আমরা যেন সঠিক কাজটা, সাংবাদিকতার কাজটা ঠিকভাবে করতে পারি, নির্বিঘ্নে, নিশ্চিন্তে, শান্তিপূর্ণভাবে। এর বাইরে আর কোন চাওয়ার কিছু নাই।

মতিউর রহমান চৌধুরী: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আপনারা সংবাদ সম্মেলন করলেন, মানববন্ধন করলেন কিন্তু এরপর আর কোন কার্যক্রম তো দেখিনি।
মতিউর রহমান: আমরা আসলে তিন মন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেছিলাম। আইনমন্ত্রী, আইসিটি মন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রী। তারা বলেছেন, তারা আমাদের সাথে আবার আলোচনা করবেন। মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করবেন, সময় নেবেন, তারা চেষ্টা করবেন যদি আমাদের যৌক্তিক বিষয়গুলা থেকে থাকে তারা সেটা আমলে নেবেন। আমাদের মনে হয়েছিল তারা উদ্যোগ নেবেন, সময় নেবেনে। যৌক্তিক দাবিগুলো সমাধানের চেষ্টা করবেন। কিন্তু আমরা দেখলাম সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত এটা করা হলো, প্রেসিডেন্ট এটাতে দ্রুত সই করলেন। আইন হয়ে গেছে। আমরা তো দেখেছি বাংলাদেশের ইতিহাসে কত আইন, কত কিছুর উদ্যোগ নেয়া হয়, সেটা পরে আবার পরিবর্তনও করা হয়। আমাদের কথা হলো, এখনই এটা হলো না, এটাকে করা গেল না। কিন্তু সংবাদপত্রকে, সাংবাদিকতাকে বিষয়টাকে জোরালোভাবে কথা বলতে হবে, সমাধানে চেষ্টা করতে হবে। এটা এমন একটা আইন, আমাদের সমাজের কোন পক্ষকেই দেখিনি এটাকে সমর্থন করতে। এর সরকারের রাজনৈতিক দল তারা ছাড়া, আর কেউ এটাতে সমর্থন করতে পারেন নাই। কেউ হয়তো পূর্ণাঙ্গ বলেন নাই, কেউ অর্ধ বলেছেন, কিন্তু এটার পক্ষে কেউ জোরালোভাবে দাঁড়াতে পারেননি। আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া, আন্তর্জাতিক সংগঠন, গণমাধ্যম ও মানাবাধিকার সংগঠনগুলো তীব্র বিরোধিতা করেছেন। আমরা বিদেশিদের কথা শুনতে পারি, নাও পারি কিন্তু দেশের ভেতরে এ ব্যাপারে একটা সরকারি দল বা সরকারের সমর্থকদের বাইরে একটা ঐক্যমত তৈরি হয়েছিল। ডিজিটাল আইনটা আমাদের সংবাদপত্র, সাংবাদিকতার জন্য ভয়ের কারণ হয়ে রয়েছে।

মতিউর রহমান চৌধুরী: এবার একটু সোস্যাল মিডিয়াতে আসবো। এখন যেটা প্রিন্ট মিডিয়া এক ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। আপনার কি মনে হয়?
মতিউর রহমান: সারা দেশেই অনলাইন পেপারে পাঠক বাড়ছে। সারা বিশ্বের সব খবর টুইটারে, ইন্স্ট্রাগ্রামে, ফেসবুকে পাওয়া যাচ্ছে। সকালের পত্রিকা পাঠ করার জন্য পাঠক বসে থাকে না। তার হাতে যে মোবাইল ও ট্যাব আছে, তা দিয়ে সংবাদ পেয়ে যাচ্ছে। তারপরও বলতে হয়, এটার সতত্যা কতটুকু তারজন্য পাঠককে সকালের পত্রিকাটা দেখতে হয়। পাঠক দেখতে চান। আমি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে পারবো কিনা, ভালো সংবাদ পাচ্ছি কি না দেখতে হবে। সেটা ছাপা এবং অনলাইন দু’টোতেই করতে হবে। তাহলেই পাঠক আমাদের ধরে রাখবে। সৌজন্যে: মানবজমিন

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/২১২০ঘ.)