মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা

'একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে'

'একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে'

ঢাকা, ৩ মে (জাস্ট নিউজ) : বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস যখন পালিত হচ্ছে, তখন বাংলাদেশে সাংবাদিক মহল এবং তাদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীদের একটি বড় অংশ মনে করছে, দেশটিতে স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে হুমকি দিন দিন বেড়েই চলেছে।

বিবিসির সাথে আলাপকালে সাংবাদিক এবং তাদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীদের কয়েকজন বলেছেন, সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থার চাপের পাশাপাশি বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ, ধর্ম নিয়ে কট্টরপন্থী এবং জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তিসহ নানান পক্ষ থেকে বাধা আসছে।

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সে কারণে গণমাধ্যমে সেলফ সেন্সরশিপের প্রবণতাও বাড়ছে বলে তাঁরা মনে করেন।

বাংলাদেশ সরকার বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল,রেডিও,পত্রিকা বা অনলাইনের সংখ্যা বাড়ার বিষয়কে স্বাধীন সাংবাদিকতার উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে থাকে।

তবে সাংবাদিকদের অনেকে মনে করেন, স্রোতের মতো সংখ্যা বাড়িয়ে সেখানে অপসাংবাদিকতাকে সামনে এনে গণমাধ্যমকে দূষিত করার ভিন্ন কৌশল নেয়া হচ্ছে।

কুষ্টিয়ার একজন সাংবাদিক মওদুদ রানা ৫৭ ধারায় মামলার কারণে এলাকা ছাড়া হয়ে এখন আরেক জেলা রাজশাহীতে বসবাস করছেন। রাজশাহী থেকেই তিনি সাংবাদিকতা করছেন।

এই সাংবাদিক জানিয়েছেন, তিনি কুষ্টিয়ায় একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করার সময় স্থানীয় পুলিশ এবং প্রভাবশালী রাজনীতিকদের দুর্নীতির খবর প্রকাশ করে তাদের আক্রোশে পড়েছিলেন।

এর জের ধরে গত বছর ৫৭ ধারায় মামলা করা হলে তাকে বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়। সাংবাদিক মওদুদ রানা ঢাকায় উচ্চ আদালত থেকে মামলায় জামিন পেলেও আর কুষ্টিয়ায় যেতেই পারেননি।

তিনি যে বেসরকারি টেলিভিশনে কাজ করতেন, সেই টেলিভিশন তাকে স্টাফ রিপোর্টার করে রাজশাহীতে তার বসবাস এবং সেখান থেকে কাজের সুযোগ করে দিয়েছে।

সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী সংগঠন 'আর্টিক্যাল নাইনটিনে'র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত পাঁচ বছরের তুলনামূলক চিত্রে প্রতি বছর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

এই সংগঠনের পরিচালক তাহমিনা রহমান জানিয়েছেন, গত বছরেই ৭৬টি ফৌজদারি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলার সংখ্যাই বেশি।

দেশের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে ৭০টিরও বেশি মামলা হয়েছিল মানহানির অভিযোগে এবং ৫৭ ধারায়।

তাঁকে ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জেলায় গিয়ে আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছিল। মি: আনাম বলছিলেন, একটা 'ভয়ের পরিবেশের কারণে' স্বাধীন সাংবাদিকতার অবনতি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

তার কথায়, “সামগ্রিকভাবে অসহিষ্ণুতার একটা পরিবেশ। এটা সরকার থেকে অসহিষ্ণুতা, বিভিন্ন সংস্থা থেকে অসহিষ্ণুতা। ব্যক্তিগতভাবে ধরেন, বড় বড় এমপিরা কিছু হলেই মামলা করে দেবে। মানহানির মামলা নাহলে আইসিটি মামলা।”

“এই সবকিছু মিলে একটা ইনটিমিডেশনের পরিবেশ হয়ে গেছে। ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতার অবনতি হয়েছে।”

দেশে এখন ২৭টি টেলিভিশন চ্যানেল চালু আছে। আরো কয়েকটি সম্প্রচারে আসার অপেক্ষায় আছে। এত চ্যানেলের ভিড় ... কিন্তু তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

বাংলাভিশন নামের বেসরকারি টিভির বার্তা বিভাগের প্রধান মোস্তফা ফিরোজ বলছিলেন, নানামুখী চাপের কারণে তাদের মধ্যে সেলফ সেন্সরশিপের প্রবণতা বেড়েছে।

“নানা ধরণের বাধা অক্টোপাসের মতো গণমাধ্যমকে চেপে ধরে আছে। একদিকে সরকারের একটা রোষাণলে পড়ার বাধা, এছাড়া ক্ষমতাশালী যারা, সেটা বিরোধীপক্ষ, তারপরে ধর্মীয় পক্ষ, জঙ্গী পক্ষ, সাম্প্রদায়িক পক্ষ ... এসব নানান পক্ষের বাধার কারণেই বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হয়েছে।”

মোস্তফা ফিরোজ আরো বলেছেন, “আপনি বলতে পারেন, বাংলাদেশে তো অনেক টেলিভিশন আছে, অনেক সংবাদপত্র আছে। কিন্তু সংখ্যা বাড়লেই যে তারা স্বাধীনভাবে সবকিছু চর্চা করতে পারে, তা কিন্তু না!”

“এমন কী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকে মুক্তভাবে লিখতে গিয়ে বিপদের মধ্যে পড়েছে। এসব ঘটনার কারণে কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই একটা সেলফ সেন্সরশিপ তৈরি হয়ে যায়। অনেক হিসাব নিকাশ করে লিখতে বা বলতে হয়।”

বেসরকারি টেলিভিশনের সংখ্যা যেমন বেড়েই চলেছে, তেমনি নতুন নতুন পত্রিকাও বের হচ্ছে। আর অনলাইন নিউজ পোর্টাল রয়েছে শত শত।

এই সংখ্যাকেই সরকার উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে। কিন্তু মাহফুজ আনাম মনে করেন, গণমাধ্যমের সংখ্যা বাড়ানোর সাথে স্বাধীন সাংবাদিকতার সম্পর্ক নেই।

“এক সময় ছিল না, অপ্রেস দ্য প্রেস (গণমাধ্যমের উপর দমননীতি)। এখন আন্তর্জাতিকভাবে অপ্রেসিং দ্য প্রেস ইজ নট এ্যাকসেপটেবল। সো হোয়াট ডু ইউ ডু, পলিউটেড দ্য প্রেস!”

“তো আপনি যাকে খুশি তাকেই লাইসেন্স দিচ্ছেন। তারা কেন খবরের কাগজ বের করছে? কেন টেলিভিশন বের করছে? আসলেই তাদের এখানে আন্তরিকতা আছে কিনা, এগুলো বিচার না করে আপনি এমন লোককে দিচ্ছেন, যাদের এই পেশায় কোনো আগ্রহ থাকার কথা না।”

মি: আনাম আরো বলেছেন, “আপনি যখন স্রোতের মতো অনুমতি দেন, তখন নিশ্চয়ই সাংবাদিকতার মানের অবনতি হয়। তখন আপনি অপসাংবাদিকতাকে দৃষ্টান্ত ধরে আপনি বলতে পারেন, এই তো সাংবাদিকতা।”

“এই দেখো না ঐ কাগজে কী লিখেছে, এই দেখো না, ঐ অনলাইনে কী লিখেছে, তো সাংবাদিকতাই খারাপ। এভাবে সাংবাদিকতা নিয়ে ঢালাওভাবে জনমনে সন্দেহ তৈরি করা হয়।”

স্বাধীন সাংবাদিকতা বিষয়কে সরকার আদৌ গুরুত্ব দিচ্ছে কিনা, ফলে এটা নিয়ে সাংবাদিকদের অনেকের মধ্যেই সন্দেহ রয়েছে।

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/২২২৩ঘ.)