২০১৭ সালে ৭৫ জন গুম

থামছে না গুম খুন অপহরণ

থামছে না গুম খুন অপহরণ

ঢাকা, ৩০ ডিসেম্বর (জাস্ট নিউজ) : থামছে না গুম, খুন, অপহরণ। ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে এ তালিকা। আগে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ নির্মম ঘটনার শিকার হতেন সন্ত্রাসী বা রাজনীতিবিদরা। বর্তমানে এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, রাষ্ট্রদূত, শিক্ষকসহ নানা শ্রেণীর মানুষ।

এসব ঘটনায় দীর্ঘদিন নিখোঁজের পর মিলেছে কারও লাশ। কেউ কেউ নিখোঁজ রয়েছেন বছরের পর বছর। আবার ফিরে এসেছেন অনেকে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও দেখানো হয়েছে।

নিখোঁজ অবস্থা থেকে যাদের মুক্তি মিলছে তাদের ফিরে আসার ধরনও অভিন্ন। চোখ বেঁধে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়। পরে বাসায় ফেরেন। যারা ফিরেছেন তাদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায় না। কেউ কথা বলেন না।

গণমাধ্যমকে এড়িয়ে যান তারা। শুধু তাই নয়, নিখোঁজের পর স্বজনরা যেভাবে সরব থাকেন, উদ্ধারের পর তারাই আবার রহস্যজনক কারণে অস্বাভাবিকভাবে হয়ে যান নীরব। তাই কারা তাদের অপহরণ করেছিল, নিখোঁজের দিনগুলোতে তারা কোথায় ছিলেন, কেনইবা অপহরণের পর ছেড়ে দেয়া হচ্ছে- এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর মিলছে না।

যদিও প্রায় প্রতিটি ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সংশ্লিষ্টদের তুলে নেয়া হয়েছে বলে ঘটনার পরপরই অভিযোগ করেছেন নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজনরা। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নয় বলে দাবি করে আসছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তবে স্বামী রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়া ও ফেরার প্রায় তিন বছর পর চলতি বছরের আগস্টে এক সেমিনারে মুখ খোলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

সেখানে তিনি বলেছেন, যদি একটা অপহরণের ঘটনাই হতো শেষ অপহরণের ঘটনা, তাহলে অবশ্যই যারা অপহৃত হয়েছেন, তারা এবং তাদের পরিবার কথা বলতেন।

নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, একটা অপহরণের ঘটনার রেশ শেষ হতে না হতেই যদি দেখেন সাত জন অপহরণ হয়েছেন, তা-ও আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে তখন এটা বলা যায় যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কালচারের ভেতরে বিষটি ঢুকে গেছে।

বিদ্যমান পরিস্থিতি আর কিছুদিন অব্যাহত থাকলে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। সরকারকেই এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গুমের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ৭৫ জন। তাদের মধ্যে ৩৫ জন দীর্ঘদিন নিখোঁজের পর ফিরে এসেছেন। এর মধ্যে ১৬ জনকে বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে উপস্থাপন করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

যেদিন আদালতে উপস্থাপন করা হয় তার আগের দিন সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। যদিও অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট স্বজনদের দাবি, আরও আগে থেকেই তারা নিখোঁজ ছিলেন। এছাড়া নিখোঁজদের মধ্যে মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে ৭ জনের। এখনও হদিস মেলেনি ৩৩ জনের। এছাড়া গত পাঁচ বছরে নিখোঁজ হয়েছেন ৫২০ জন।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, যারা ফিরে এসেছেন তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে কোনো তথ্য দিচ্ছে না। তাই তারা আত্মগোপনে ছিলেন, নাকি বেড়াতে গিয়েছিলেন তা স্পষ্ট নয়।

তাদেরকে যে অপরহণ করা হয়েছে তাও প্রমাণিত হয়নি। এ কারণে অপহরণকারীদেরও চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক ২৩ ডিসেম্বর রাতে যুগান্তরকে বলেন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা এবং সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

যারা ফিরে এসেছেন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রকৃত ঘটনা বের করার দায়িত্ব সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। অপহরণকারীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে পারলেই এ ধরনের অপরাধ কমবে বলে তিনি মনে করেন।

মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, রাষ্ট্রের জন্য হুমকি এমন যে কারও প্রতি একটা ভীতিকর বার্তা দিতেই এগুলো করা হচ্ছে।

২০১৬ সালে দেয়া আদালতের নির্দেশনার বরাত দিয়ে নিখোঁজ বা গ্রেফতার হওয়ার স্বজনরা অভিযোগ করেন, কাউকে গ্রেফতার করতে হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যকে অবশ্যই পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে। গ্রেফতারের ১২ ঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই স্বজনদেরকে বিষয়টি জানাতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আদালতের এ নির্দেশনা প্রতিপালন করা হচ্ছে না।

এ বিষয়ে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি সহেলী ফেরদৌস বলেন, র‌্যাব-ডিবিসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সব ইউনিটকে আইন মেনে অভিযান চালানোর নির্দেশনা দেয়া আছে। কেউ যদি আইনবহির্ভূত কাজ করে তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হবে।

তিনি বলেন, কারো নিখোঁজের সংবাদ পেলে পুলিশ তাকে উদ্ধারে সর্বাত্মক চেষ্টা করে। যারা ফিরে আসেন তারা পুলিশকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেন না। তাই গুম বা নিখোঁজের ক্লু মিলছে না। এ কারণে অপহরণকারীদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। এখনও যারা নিখোঁজ আছেন তাদের উদ্ধারে পুলিশের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরের শেষ চার মাসে অন্তত ২০টি চাঞ্চল্যকর নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে নিখোঁজ সাংবাদিক উৎপল দাস, শিক্ষক মোবাশ্বের হাসান সিজার, ব্যাংক এশিয়ার এভিপি শামীম আহমেদ, বাংলাদেশ জনতা পার্টির (বিজেপি) সভাপতি মিঠুন চৌধুরী ও দলটির কেন্দ্রীয় নেতা অসিত ঘোষ অসিত, জামালপুরের সরিষাবাড়ির মেয়র রুকনুজ্জামান রুকন, নকিয়া-সিমেন্সের সাবেক প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান আসাদ, অ্যাভেনটিস-স্যানোফির ফার্মাসিস্ট জামাল রহমান, শাহজাহানপুরের ফল ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন এবং ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায় ফিরে এসেছেন।

রাজনীতিক এসএম আমানুর রহমানসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সম্প্রতি নিখোঁজ হওয়া যেসব ব্যক্তির সন্ধান এখনও মেলেনি তাদের মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, বিএনপি নেতা সৈয়দ সাদাত আহমেদ এবং কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ইশরাক আহমেদও রয়েছেন।

সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো তথ্য-প্রমাণসমৃদ্ধ। তারপরও সংশ্লিষ্টরা আইনের শাসনের দিকে না তাকিয়ে ঘৃণিত এ কাজটি করে চলেছে।

গুম নিখোঁজের ঘটনা রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ উল্লেখ করে অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, যত দিন পর্যন্ত অগণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষমতা খর্ব করা না যাবে ততদিন এসব চলবেই।

এসব বন্ধ করতে হলে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে জনমত গড়ে তুলতে হবে। গুম নিখোঁজের নেপথ্যে পুলিশের ওপর সরকারের অতিনির্ভরতাও কাজ করছে। নিখোঁজ অবস্থা থেকে ফিরে আসা মানুষগুলো ভয় এবং ট্রুমাটাইজড হওয়ার কারণেই কথা বলছেন না। অপহরণকারীদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই নিতে হবে। যুগান্তর

(জাস্ট নিউজ/ওটি/১১১৭ঘ.)