ধরে নিয়ে যেতে দেখল সবাই, ‘কিনারা পায়নি’ পুলিশ

ধরে নিয়ে যেতে দেখল সবাই, ‘কিনারা পায়নি’ পুলিশ

ঢাকা, ২৫ অক্টোবর (জাস্ট নিউজ) : নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে মহাসড়কের পাশে চারজনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের ঘটনায় বার বার পুলিশের দিকে দিকে অভিযোগের আঙুল উঠলেও তা অস্বীকার করেই দায় সারছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা।

লাশ উদ্ধারের পর চার দিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ জানাতে পারেনি কারা, কেন, কীভাবে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

ওই চারজনের মধ্যে আড়াইহাজার উপজেলার পুরিন্দা পশ্চিমপাড়া এলাকা থেকে গত শুক্রবার ফারুক হোসেন, সবুজ সরদার ও জহিরুল ইসলামকে কারা তুলে নিয়ে গিয়েছিল, ঢাকার মাইক্রোবাস চালক লুৎফর রহমান মোল্লা কীভাবে নিরুদ্দেশ হলেন- এসব প্রশ্নের উত্তর বৃহস্পতিবারও পুলিশের কাছ থেকে মেলেনি।

সবুজ ও জহিরুলের সঙ্গে তাদের খালোতো ভাই লিটনকেও সেদিন ফারুকের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে স্বজনরা অভিযোগ করেছেন।পুলিশ এখনও তার কোনো সন্ধান দিতে পারেনি।

অথচ ওই বাড়ির আশপাশের বাসিন্দাদের অনেকেই বলেছেন, সেদিন চারজনকে হাতকড়া পরিয়ে, চোখ বেঁধে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যেতে দেখেছেন তারা। যারা ধরে নিয়ে গেছে, তাদের গায়ে সাধারণ পোশাক থাকলেও সঙ্গে অস্ত্র ছিল। নিজেদের ডিবি পুলিশ বলে পরিচয় দিয়েছিল তারা।

আর ফারুকের স্ত্রী তাসলিমা আক্তার বলেছেন, ধরে নিয়ে যাওয়ার পর শনিবার তিনি ভুলতা পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে স্বামীকে খাইয়ে আসেন। সে সময় পুলিশ তাকে বলেছিল রোববার সকালে আদালতে চালান করে দেওয়া হবে। কিন্ত তার বদলে তিনি ফারুকসহ চারজনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের খবর পান।

তাসলিমার অভিযোগ অস্বীকার করে ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক রফিকুল হক বলেছেন, ‘ওইরকম’ কোনো আসামি তার ফাঁড়িতে ছিল না, কোনো নারীও তার ফাঁড়িতে যাননি।

আর ফারুকের বাড়ির এলাকায় সেদিন জেলা পুলিশ বা ডিবি পুলিশের কোনো অভিযান চালানো হয়নি দাবি করে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেছেন, তদন্ত শেষে এই ঘটনার রহস্য তারা উদ্ঘাটন করতে পারবেন।

রোববার ভোরে আড়াইহাজারের পাঁচরুখী গ্রামে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের যে জায়গায় ফারুক, সবুজ, জহিরুল ও লুৎফরের লাশ পাওয়া যায়, সেখান থেকে ফারুকের বাড়ির দূরত্ব দুই কিলোমিটারের মত। স্থানীয় বাসিন্দারা রাতে গুলির শব্দ পাওয়ার পর সকালে লাশ দেখে পুলিশে খবর দেন।

সেদিন বিকালে লাশের ময়নাতদন্তের পর নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আরএমও মো. আসাদুজ্জামান বলেছিলেন, চারজনেরই মৃত্যু হয়েছে মাথার পেছনে শটগানের গুলিতে।

আর ঘটনাস্থলে এক রাউন্ড গুলিসহ দুটি পিস্তল এবং একটি মাইক্রোবাস পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়ার তথ্য দিয়ে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আবদুল্লাহ আল মামুন সেদিন বলেছিলেন, ডাকাত বা সন্ত্রাসীদের ‘কোন্দলে’ ওই চারজন নিহত হয়েছেন বলে তারা ধারণা করছেন।

নিহত চারজনের মধ্যে ঢাকার লুৎফর ছাড়া বাকি তিনজনেরই বাড়ি পাবনা সদরের আতাইকুলা থানার ধর্মগ্রাম মধ্যপাড়ায়। আতাইকুলা থানার ওসি মাসুদ রানা এ প্রতিবেদককে বলেছেন, তার থানায় ওই তিনজনের নামে কোনো অভিযোগ নেই। নারায়ণগঞ্জের পুলিশও নিহত চারজনের বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা থাকার কথা জানাতে পারেনি।

ওই হত্যাকাণ্ডের কারণ খতিয়ে দেখতে পুলিশ যে তিন সদস্যের কমিটি করে দিয়েছে, তাতে সদস্য হিসেবে আছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মামুন।

তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, তারা কেবল কাজ শুরু করেছেন, অগ্রগতি বলতে এখনও তেমন কিছু নেই।

“যারা মারা গেছেন তাদের পূর্ববর্তী পেশাসহ বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য নারায়গঞ্জের বিভিন্ন থানায় এবং তাদের গ্রামের বাড়ির সংশ্লিষ্ট থানা থেকে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের সাথে কথা বলা হয়েছে। আমরা পর্যায়ক্রমে পরিবারের সদস্যদের সাথেও কথা বলব।”

ক্রসফায়ার?

নিহত ফারুক ভুলতা-গুলিস্তান রুটে গ্লোরি পরিবহনের বাস চালাতেন। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি থাকতেন আড়াইহাজারের পুরিন্দা পশ্চিমপাড়া এলাকার এক বাড়ির দোতলায়। তবে গ্রামের বাড়ি পাবনার আতাইকুলাতেও তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল।

সবুজ, জহুরুল আর লিটন পাবনার আজাদ বেকারিতে কাজ করতেন। পেশা বদলের আশায় দিন দশেক আগে তারা নারায়ণগঞ্জে গিয়ে ফারুকের বাসায় ওঠেন। ওই বাসা থেকেই গত ১৯ অক্টোবর ডিবি পুলিশ পরিচয়ে চারজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বলে ফারুকের স্ত্রী তাসলিমা এবং প্রতিবেশীদের ভাষ্য।

বুধবার দুপুরে পুরিন্দা পশ্চিমপাড়ায় ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দোতলার ঘর তালাবন্ধ। বাসার লোকজন কোথায় জানতে চাইলে প্রতিবেশী এক নারী বলেন, ঘটনার পরদিন ফারুকের স্ত্রী তাসলিমা তার এক বছরের ছেলেকে নিয়ে টেকপাড়ায় বোনের বাড়িতে চলে গেছেন।

সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমেনা বেগম এ প্রতিবেদককে বলেন, একটি নোয়া মাইক্রোবাসে করে পুলিশের পোশাকে একজন এবং সাধারণ পোশাকে তিনজন এসেছিলেন সেদিন। বাসা থেকে বের করে চারজনকে গাড়িতে তোলার আগে ফারুক হোসেনকে প্রচণ্ড মারধর করতে দেখেছেন তিনি। সে সময় দুজনের হাতে হাতকড়া ছিল।

“তখন ওই মহিলা (তাসলিমা) বাসায় কান্নাকাটি করছিল। অনেক মানুষ ভিড় করছিল। কিন্তু কেউ কথা বলতে সাহস পায়নি।”

স্থানীয় ইলেকট্রিশিয়ান আবু সুফিয়ান জানান, শুক্রবার বিকালে ওই সময় তিনি ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন তৃতীয় তলায় বিদ্যুতের লাইনের কাজ করতে। তিনিও চারজনকে ওই বাসা থেকে বের করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যেতে দেখেছেন।

পুরিন্দা পশ্চিমপাড়া আহলে হাদিস জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল্লাহ বলেন, সেদিন মাগরিবের একটু আগে চারজনকে যারা গাড়িতে তুলছিল, তাদের কাছে অস্ত্রও দেখেছেন তিনি।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেরই ধারণা, ফারুকদের আসলে ‘ক্রসফায়ারে’ দেওয়া হয়েছে। পরে রাস্তার পাশে লাশ ফেলে মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়েছে, যাতে মানুষ দুর্ঘটনা বলে মনে করে।

ফাঁড়িতে ছিলেন ফারুকরা?

নিহত ফারুক হোসেনের স্ত্রী তাসলিমা আক্তার টেকপাড়া এলাকায় তার বোন মাকসুদা আক্তারের বাসায় বসে সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করেন এ প্রতিবেদকের কাছে।

তিনি বলেন, গত শুক্রবার বিকালে তাদের পুরিন্দা পশ্চিমপাড়ার আসায় কয়েকজন লোক এসে দড়জায় ধাক্কা দেয়। ফারুক দরজা খুলতেই তাকে মারধর শুরু করে তারা। পরে তাকে হাতকড়া পরিয়ে দেওয়া হয়, বেঁধে ফেলা হয় চোখ।

“আমি বাধা দিতে গেলে বলে তারা ডিবির লোক। আমাকেও মারধর করে। বাসায় গ্রাম থেকে আসা আত্মীয়রা ছিল। ওদেরও ধরে নিয়ে যায়।”

তাসলিমা বলেন, যারা এসেছিল, তাদের পরনে ছিল গেঞ্জি আর প্যান্ট। ‘সিলভার কালারের’ একটি মাইক্রোবাসে চারজনকে তুলে নিয়ে যায় তারা। যাওয়ার সময় ফারুকের মোবাইল ফোনও নিয়ে যায়।

“আমি পরে আড়াইহাজার থানায়, রূপগঞ্জ থানায় খোঁজ করছি। অনেককে বলছি সহযোগিতা করার জন্য। কিন্তু কেউ খোঁজ দিতে পারেনি।”

তাসলিমা বলেন, শনিবার দুপুরে ফারুকের ফোন থেকে যোগাযোগ করে তাকে জানানো হয়, তার স্বামী আছে ভুলতা পুলিশ ফাঁড়িতে। ওই খবর পেয়ে তিনি ফাঁড়িতে যোগাযোগ করেন। জানতে পারেন, ফারুকের পাশাপাশি বাকি তিনজনকেও সেখানেই রাখা হয়েছে।

“আমি সেখানে তাদের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে প্রথমে বাধা দেয়। পরে অনেক অনুনয় করে দেখা করার সুযোগ পাই। ওখানে আমার স্বামীর সঙ্গে কথা হয়। আমি খাবার নিয়ে গেছিলাম, মেঝেতে বসে সেই খাবার খায়।”

কোলের ছেলে বিল্লালকে দেখিয়ে তাসলিমা বলেন, “ও তো এতিম হয়ে গেল। কীভাবে আমাদের দিন চলবে? ওরে কীভাবে মানুষ করব? যার আমার স্বামীরে মারল, চারজন মানুষরে মারল, আমি তাদের শাস্তি চাই। আমি বিচার চাই।“

তাসলিমার বড় বোন মাকসুদা আক্তার বলেন, চারজনকে যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তিনি ওই বাসাতেই ছিলেন।

“ডিবি পুলিশের লোকজন ফারুক ভাই আর আমাদের গ্রাম থেকে বেড়াতে আসা তিনজনকে ধরে নিয়ে গেল। ফারুক ভাইকে ওরা অনেক মারধর করল। আমার বোন বাঁচাতে গেছিল, ওকেও মারল। পুলিশের লোকজন আমার মোবাইল ফোনও নিয়ে গেছে।”

পুলিশ যা বলছে

ফারুকের স্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রূপগঞ্জ থানার ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক রফিকুল হক এ প্রতিবেদককে বলেন, “এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমার এলাকার ঘটনাও এটা না।”

এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, যেদিনের কথা বলা হচ্ছে, সেদিন তিনি ব্যস্ত ছিলেন তিন বছরের এক শিশুকে অপহরণের পর হত্যার এক মামলা নিয়ে। কিন্তু ফারুকের স্ত্রী যা বলেছেন, তেমন কোনো আসামিকে সেদিন ফাঁড়িতে নেওয়া হয়নি।

“কোনো মহিলাও আমার ফাঁড়িতে আসেনি। আপনারা যদি কিছু জানেন, তাহলে আমাদের সিনিয়র অফিসারদের বলেন। তারা যাচাই করে দেখবেন।”

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম বলেন, “লাশ উদ্ধারের ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ওই দিন পুলিশের কোনো অভিযান চালানো হয়নি। অতিরিক্ত ডিআইজির নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেখানেই রহস্য উদঘাটন হবে।” সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/২৩৫৪ঘ.)