রোহিঙ্গা সঙ্কট শেষ হয়ে যায়নি, এখনও আসছে তারা

রোহিঙ্গা সঙ্কট শেষ হয়ে যায়নি, এখনও আসছে তারা

ঢাকা, ২০ ফেব্রুয়ারি (জাস্ট নিউজ) : ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। এ সময় থেকে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বাংলাদেশে এসেছেন। এর আগের সহিংসতা থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেয়া আরো বেশ কয়েক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন তারা। আমি এক্ষেত্রে সবচেয়ে যে বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দিয়েছি তা হলো পরিস্থিতির ভয়াবহতা। কি বিপুল পরিমাণ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে অল্প সময়ে। তা প্রায় ছয় মাসে। প্রকৃতপক্ষে এখনও তারা আসছেন।

এখন যারা আসছেন তাদের সংখ্যা বিশাল নয়, যেমনটা দেখা গেছে সঙ্কট শুরুর সময়ে। তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এখনও নাফ নদী পাড়ি দিয়ে প্রতি সপ্তাহে দু’একশত রোহিঙ্গা আসছেন। নতুন আসা উদ্বাস্তুরা বলছেন, তারা মিয়ানমারে অনিরাপদ। তাদেরকে হুমকি দেয়া হয়েছে। বাড়িতে, গ্রামে তাদেরকে হয়রান করা হয়েছে। তাদের গ্রামগুলো এখন পরিত্যক্ত। তাই তাদের যেসব সম্পদ বা পণ্য ছিল তা যেকোনো দামে বিক্রি করে দিয়েছেন বা দেয়ার চেষ্টা করেছেন, যাতে তারা নৌকার ভাড়া মিটাতে পারেন। সেই নৌকায় চড়ে চলে আসতে পারেন বাংলাদেশে, যেখানে তাদেরকে থাকার জন্য বিশাল ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং তা অব্যাহত আছে। তারা এসে আশ্রয় নিচ্ছেন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা কক্সবাজারে তৈরি করা অস্থায়ী আবাসনে। এগুলো অত্যন্ত জনবহুল। গাদাগাদি করে সেখানে থাকতে হয় তাদেরকে। তাদের এসব আবাসন তৈরি করা হয়েছে বেশির ভাগই প্লাস্টিক, বাঁশ দিয়ে। একটি ঘরের সঙ্গে আরেকটি ঘর লেগে আছে। এখানে রয়েছে অপর্যাপ্ত পানি। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নাজুক।

সব বসতিতে আমাদের মেডিকেল কনসালটেশনদের মাধ্যমে দেখতে পেয়েছি, রোহিঙ্গারা এরই মধ্যে মিয়ানমারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন এবং তাদেরকে বের করে দেয়া হয়েছে। তাদের স্বাস্থ্যসেবা নেই বা নেই বললেই চলে। সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে তাদেরকে টিকা দেয়া হয় না নিয়মিত। তাই তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যন্ত নিম্ন।

আমাদের চিকিৎসকরা অনেক মানুষকে ডায়রিয়া ও শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের চিকিৎসা দিয়েছেন। এসব রোগ উদ্বাস্তু শিবিরে বসবাসের পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমরা তাদের শরীরে ক্ষত দেখেছি। যথাযথ চিকিৎসার অভাবে সেগুলো মারাত্মক সংক্রমণে রূপ নিয়েছে। দেখা দিয়েছে জটিল রোগ হিসেবে। তাদের এসব রোগের বিষয় কখনো যথাযথভাবে চিহ্নিত করা হয় নি।

আমরা এমন অনেক পরিবার দেখেছি। যেসব পরিবারের শিশু বা বিকলাঙ্গ মানুষকে দেখাশোনা করতে হয় অন্যদের। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের যোগান দিতে হয় অথবা তাদের আশ্রয় তাদেরকেই নির্মাণ করতে হয়। বিপুল সংখ্যক মানুষের চাপ, অত্যধিক গাদাগাদি হরে বসবাস, অপর্যাপ্ত আবাস, দৃশ্যত অত্যন্ত কম মাত্রার টিকা ব্যবস্থা- এসব ফ্যাক্টর মিলে জনস্বাস্থ্যে একটি প্রকৃত ঝড়ো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এটা একটা অত্যন্ত ভঙ্গুর পরিস্থিতি। এ বিষয়ে আমাদের স্টাফ ও অন্য যেসব সংগঠন মাঠপর্যায়ে কাজ করছে তাদের সবার অব্যাহতভাবে দৃষ্টি দেয়া দরকার।

আসন্ন চ্যালেঞ্জ বর্তমান অবস্থার মধ্যে নতুন করে এক জরুরি অবস্থা এগিয়ে আসছে। এটা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আসন্ন বর্ষা মৌসুমে প্রচুর বৃষ্টিপাত ও মৌসুমী ঘূর্ণিঝড় হয়। আর এসব উদ্বাস্তু শিবির যে এলাকায় অবস্থিত তা প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় প্রবণ। সেখানে ডায়রিয়া সহ পানিবাহিত রোগের বড় ধরনের ঝুঁকি রয়েছে।

আমরা এরই মধ্যে দেখেছি, কিভাবে মানুষের বিপদ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে আমরা হাম ও ডিপথেরিয়ার চিকিৎসা দিচ্ছি। সব সময়ই এমন সব রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে, যা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ প্রস্তুত নন ত্রাণকর্মী ও স্বাস্থ্য বিভাগ। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, সব পক্ষের এ সঙ্কটে সাড়া দেয়ার একটি সুযোগ রয়েছে। তা হলো টার্গেটেড মানুষদেরকে টিকার আওতায় আনা। উদ্বাস্তু শিবিরে যানবাহন প্রবেশের সুযোগ আছে, এমন শিবির বা ঘর নেই বললেই চলে। তাই অসুস্থ কাউকে স্থানান্তর করতে হয় পায়ে হেঁটে। আশ্রয় শিবিরের ধরনের বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন, এসব আশ্রয়শিবির ভারি বর্ষণে টিকে থাকতে পারবে কিনা।

আমরা সম্ভাব্য ভূমিধসের আশঙ্কা করছি। অথবা এমনও হতে পারে বৃষ্টির কারণে পথগুলো অত্যন্ত কর্দমাক্ত হয়ে পড়বে। এতে অধিক সংখ্যক মানুষ পড়ে গিয়ে আহত বা হাতপা ভেঙে যেতে পারে। বর্তমানে আমরা আমাদের জরুরি সেবা দেয়ার চেষ্টা করছি। আমরা স্বাস্থ্য বিষয়ে আমাদের অবকাঠামোর ক্ষতি ঠিকঠাক করার চেষ্টা করছি।

চিকিৎসা সেবা চলছে
কয়েক মাসে বিপুল পরিমাণ মানুষের ঢলের পরে এখন আমাদের অগ্রাধিকার হলো মেডিকেল সেবা সংহত করা। সেকেন্ডারি স্বাস্থ্য সার্ভিসের দিকে দৃষ্টি দেয়া। যদি ইে সঙ্কটের কথা ভুলে যাওয়া হয় তাহলে কিভাবে সাড়া দিতে হবে সে জন্য আমাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

প্রাথমিক পর্যায়ের দিনগুলোতে পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ছিল আমাদের জন্য অগ্রাধিকার। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের লোকজন এসব কাজ করছেন। তবে হাসপাতাল সার্ভিসগুলোতে এখনও ফারাক রয়ে গেছে।

উপরন্তু, যেসব মানুষ ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হয়েছেন তাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সেবা এখনও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যখন আমরা জরুরি বিষয়ে সাড়া দিই তখন কর্তৃপক্ষের সহযোগিতার মাধ্যমে তা করি। এর মধ্য দিয়ে আমাদের কাজকে গ্রহণযোগ্যতার গুরুত্ব নিশ্চিত করা হয়। মানবিক গুরুত্বপূর্ণ কাজের বিষয়ে বোধোদয় হয়।

রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় গ্রহণের স্থানগুলোতে মানুষের সংখ্যা ভয়াবহভাবে বাড়ছে। এতে স্থানীয় অর্থনীতি, পরিবেশ ও স্থানীয় মানুষের নিত্যদিনের জীবনযাত্রা ও দেশের ওপর বড় একটি চাপ পড়ছে।

(কেট নোলান, বাংলাদেশে মেডিসিন সান ফ্রন্টিয়ের্স-এর ইমর্জেন্সি কোঅর্ডিনেটর। সংস্থাটির নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তার লেখার অনুবাদ)

সৌজন্যে : মানবজমিন

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/১৮৫৩ঘ.)