ফুল আর অশ্রুতে পিলখানায় নিহতদের স্মরণ

ফুল আর অশ্রুতে পিলখানায় নিহতদের স্মরণ

ঢাকা, ২৫ ফেব্রুয়ারি (জাস্ট নিউজ) : শ্রদ্ধা ও শোকের মধ্য দিয়ে আজ রবিবার পালিত হয়েছে পিলখানা হত্যা দিবস। সকালে বনানী সামরিক কবরস্থানে পিলখানায় নিহত সেনা কর্মকর্তাদের কবরে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

'২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ছেলে আমাকে বলেছিল, মা, তুমি সামিকে দেখে রেখো। এরপর ছেলে আমার ফিরে এলো না। মা বলে ডাকল না। আর কোনো দিন তার মুখ থেকে মা ডাক শুনতে পাব না।' কথাগুলো বললেন পিলখানা হত্যাযজ্ঞের শিকার নিহত মেজর মিজানুর রহমানের বৃদ্ধা মা কোহিনুর বেগম।

রবিবার সকালে বনানী সামরিক কবরস্থানে দুই নাতিকে সঙ্গে নিয়ে ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করেন তিনি দুই হাত তুলে। প্রার্থনা শেষে বললেন, 'মায়ের সামনে সন্তানের কবর। পৃথিবীতে একজন মায়ের কাছে এটাই সবচেয়ে বড় কষ্টের, বেদনার। দুই নাতিকে নিয়ে বেঁচি আছি।' কথাগুলো বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

কোহিনুর বেগম জানান, মিজানুর রহমানের দুই ছেলে। ছোট ছেলে ফারদিন রহমান সামি ও বড় ছেলে তাহসান রহমান রামী। ঘটনার সময় সামির বয়স ছিল সাড়ে তিন বছর। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মিজানুরের বড় ছেলে তাহসান বলেন, 'বাবা মারা যাওয়ার ৯ মাস আগে ব্রেইন স্ট্রোকে মা মারা যান। এখন দাদিই আমাদের সবকিছু।' দাদিকে নিয়ে রবিবার বাবার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় দুই ভাই। তাদের মতো আরো অনেক স্বজন বনানী সামরিক কবরস্থানে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের কবরে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ফুল দিয়ে। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মোনাজাত করেছেন তারা। শোকাবহ পরিবেশ সৃষ্টি হয় এ সময়।

২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি দাবি-দাওয়ার নামে পিলখানায় বিদ্রোহ শুরু করে তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস-বিডিআরের উচ্ছৃঙ্খল জওয়ানরা। এ সময় বুলেটে প্রাণ হারান ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন।

রবিবার ছিল হত্যাযজ্ঞের নয় বছর। এ উপলক্ষে সকাল ৯টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে নিহতদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পক্ষে তার সহকারী সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী ইফতেখার-উল-আলম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল শিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, নৌবাহিনীর প্রধান এডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ, বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল আবু এসরার, বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন। পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়।

বিএনপির পক্ষ থেকেও নিহতদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে ২৫ ফেব্রুয়ারিকে 'শহীদ সেনা দিবস' হিসেবে পালন করা হবে। তিনি বলেন, 'আমি মনে করি পিলখানা হত্যাযজ্ঞের পেছনে ষড়যন্ত্র ছিল। এদেশকে অস্থিতিশীল করতে চেয়েছিল তারা। আঘাত হানতে চেয়েছিল নিরাপত্তায়। সেই ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচিত হয়নি।' এ সময় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'সেদিন যারা গুলি চালিয়েছিল, তাদের হয়তো বিচার হয়েছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের বের করা হয়নি।'

নিহতদের স্বজনরা নির্মম ওই হত্যাযজ্ঞের কারণ ও পরিকল্পনাকারীদের বিচার দাবি করেন। নিহত লে. কর্নেল গোলাম কিবরিয়া মোহাম্মদ নিয়ামতউল্লাহর মেয়ে ইফরিত বলেন, বাবা যখন মারা যান তখন আমি প্রথম শ্রেণিতে পড়ি। শুনেছি বাবা আমাকে খুব আদর করতেন। পরম মায়ায় জড়িয়ে ধরে ঘুমাতেন। কিন্তু আমার তেমন কিছু মনে নেই। নিজের মতো করে বাবাকে অনুভব করি। জানি, তিনি আর কোনো দিন ফিরে আসবেন না। মায়ের কাছে শুনেছি বাবার স্বপ্ন ছিল আমি ব্যারিস্টার হবো। আমিও বাবার সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে লেখাপড়া করে যাচ্ছি।'

ইফরিতের মা শারমিন জাহান মেয়ের কথা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, 'একটি ঘটনা তো আর এমনি এমনি হয় না। অবশ্যই এর পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকে। কিন্তু এত বড় একটা ঘটনা ঘটল, এর কারণ সম্পর্কে এখনও আমরা কেউ কিছু জানি না। মূল হোতাদের খোঁজা হলো না। এত বছর পরও খুব জানতে ইচ্ছা করে কাদের পরিকল্পনায় পিলখানায় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল।'

(জাস্ট নিউজ/একে/২২২৬ঘ.)