ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা

‘রোহিঙ্গা সংকট নিরসন না হলে হুমকিতে পড়বে বাংলাদেশ’

‘রোহিঙ্গা সংকট নিরসন না হলে হুমকিতে পড়বে বাংলাদেশ’

ঢাকা, ২ এপ্রিল (জাস্ট নিউজ) : সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সঙ্কটকে মারাত্মক উদ্বেগের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিষেশজ্ঞরা বলেছেন, সংকটের দ্রুত সমাধান না হলে গুরুতর মানবিক বিপর্যয়ে পড়বে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। পাশাপাশি বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত মারাত্মক হুমকিতে পড়বে। এজন্য বড় ধরনের আসন্ন মানবিক বিপর্যয় ঠেকানো ও ঝুঁকি এড়াতে জাতিসংঘসহ বিশ্বকে খুব দ্রুত কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে।

সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে একশনএইড বাংলাদেশ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট: টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে’ বিষয়ক দু’দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন।

সম্মেলনে অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, নেদারল্যান্ডস্, সিঙ্গাপুর, সুইডেন, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরা বিশ্লেষণ ও গবেষণাপত্র উপস্থাপন ধরেন। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পর্যালোচনাপত্র ও আলোচনার উপর ভিত্তি করে ‘ঢাকা ঘোষণা’ উপস্থাপন করা হবে।

অনুষ্ঠানে আয়োজকদের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সংকটের প্রেক্ষাপটে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণপত্র উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, রোহিঙ্গা ইস্যুটি এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার বিষয়। এখন পর্যন্ত ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমার থেকে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। ২০১৭ সালে মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রস্থানের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে, যা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট হিসেবে পরিগণিত। রোহিঙ্গাদের প্রতি নিপীড়নের বাস্তবতা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমান। আবার নিরাপদ প্রত্যাবাসন রোহিঙ্গাদের অধিকার। তবে তা এখনো দৃশ্যমান না।

সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক বলেন, রোহিঙ্গা সংকট মিয়ানমার ও জাতিগত সমস্যার ফসল। এখন এটি শুধু বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ইস্যু না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে মাঠ পর্যায়ে পরিস্থিতি বুঝে দ্রুত এই সংকটের টেকসই সমাধান করতে চাই আমরা। আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের আগে মিয়ানমার সরকারকেও প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, রাখাইন রাজ্যে আর কখনো সহিংসতা চালানো হবে না। অনতিবিলম্বে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এবং শর্তহীনভাবে আনান কমিশনের প্রতিবেদনের বাস্তবায়ন করা হবে। আর এক্ষেত্রে মিয়ানমারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গা সংকটের বর্তমান প্রেক্ষাপটে পাঁচটি ঝুঁকি নিয়ে একটি বিশ্লেষণপত্র তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিয়ে জাতিগত যে বিদ্বেষ ও মিয়ানমারের অবস্থান এই সমস্যা সমাধানে বড় প্রতিবন্ধকতা। চীন ও ভারতের মত দেশ এই সমস্যা সমাধানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আর জাতিসংঘ যদি আন্তর্জাতিক আইন ও বড় রাষ্ট্রগুলোর সম্মতি নিয়ে এগিয়ে না আসে তবে সমস্যা সমাধান কঠিন হবে। তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধান না হলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হবে। মানবিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমস্যা প্রকট হবে। সর্বহারা রোহিঙ্গাদের উপর যে গণহত্যা ও নিপীড়ন চালানো হয়েছে তার বিচার হওয়াটাও জরুরি।

এরপর দেশ ও দেশের বাইরের বিশেষজ্ঞরা রোহিঙ্গা সংকটের ঝুঁকি ও সমাধান নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচকরা বলেন, এই সংকট নিরসনে বিলম্ব হলে বৈশ্বিক নজর রোহিঙ্গা ইস্যু থেকে সরে যেতে পারে। অতএব, মানবিক, রাজনৈতিক, জেন্ডার এবং নিরাপত্তা বিষয়সহ বৈশ্বিক নীতিমালা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক যে আইনগত দিক রয়েছে, সেগুলো নিয়ে কাজ করে সমাধানে আসাটা খুবই জরুরী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মিয়ানমারের জন্য কানাডা সরকারের বিশেষ দূত রবার্ট কেইথ-এর একটি লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন বাংলাদেশে নিযুক্ত কানাডার হাইকমিশনার বেনয়েট প্রিফন্টেইন বলেন, মিয়ানমার সরকার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই বুঝতে হবে যে রোহিঙ্গারাও মানুষ। সহিংসতার কারণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাই তাদের সহায়তায় এবং অধিকার নিশ্চিত করতে আমাদের সকলকে জাগ্রত হতেই হবে।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘের উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা ইউএনডিপি-র কান্ট্রি ডিরেক্টর সুদীপ্ত মুখার্জী বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ একটি জটিল মূহুর্তে আছে। তাই খুব দ্রুত সম্মানের সাথে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের প্রত্যাবাসনে সকলের সহযোগিতা কামনা করে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের সংকট সমাধানে বিপুল পরিমাণ আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র ও ব্যক্তিদের।

অনুষ্ঠানের অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টর ফর পিস এন্ড জাস্টিস-এর নির্বাহী পরিচালক মনজুর হাসান, একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির প্রমুখ।

রোহিঙ্গা সংকটে একটি দূরদর্শী ও টেকসই সমাধানের জন্য আমরা ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট: টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে’ দুই দিনব্যাপী এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এর উদ্দেশ্য, পরবর্তী সময়ে সহিংসতা প্রতিরোধ, শান্তিপূর্ণ অবস্থার পুনর্বহাল এবং রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের উপায় বের করা। কৌশলগত আলোচনার মাধ্যমে মানবিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, আইনগত, অর্থনৈতিক, জেন্ডার, সুরক্ষা, অধিকার এবং নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে দুই দিনের এই সম্মেলনে। দ্বিতীয় দিনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বহুমাত্রিক কন্ঠস্বর
একত্রীকরণ এবং সুপারিশসমূহ কার্যকরের লক্ষ্যে ‘ঢাকা ঘোষনা’ উপস্থাপন করা হবে। সেখানে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী। এছাড়া দেশ ও বিশ্বের বিভন্ন দেশে কাজ করা কূটনৈতিক এবং গবেষকরাও উপস্থিত থাকবেন।

(জাস্ট নিউজ/একে/২২১৩ঘ.)