পরিবারটি নো-ম্যান্স ল্যান্ডের, প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি

পরিবারটি নো-ম্যান্স ল্যান্ডের, প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি

ঢাকা, ১৫ এপ্রিল (জাস্ট নিউজ) : বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া একটি রোহিঙ্গা পরিবার ফেরত গেলেও প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি৷ পরিবারটি নো-ম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থান করছিল এবং সেখান থেকেই ফেরত গেছে বলে বাংলাদেশের দাবী৷ তাই এটি প্রত্যাবাসনের আওতায় পড়ে না৷

ফেরত যাওয়া পরিবারের গৃহকর্তার নাম মোহাম্মদ আকতার আলম৷ তার পরিবারের ৬ সদস্যের মধ্যে ৫ জন ফেরত গেছেন৷

জানা গেছে, আকতার আলমের বাড়ি মিয়ানমারের তুমব্রু এলাকায় এবং তিনি ওই এলাকার চেয়ারম্যান৷ শনিবার (১৪ এপ্রিল) গভীর রাতে মিয়ানমার সীমান্তের ঢেঁকিবুনিয়া পয়েন্ট দিয়ে তারা ফেরত গেছেন৷ আর এ কাজে সহযোগিতা করেছে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)৷ তিনি সেখানে গিয়ে পরিচয় শনাক্তকরণ কার্ড বা ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) সংগ্রহ করেছেন বলে নোম্যন্স ল্যান্ডে বসবাসরত কয়েকজন রোহিঙ্গা জানিয়েছেন৷

গত বছরের ২৪ আগস্ট রাতে রাখাইনে সহিংস ঘটনার পর অন্যান্য রোহিঙ্গার সঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন আকতার৷ বাংলাদেশের কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ খালেদ একসময় নো-ম্যান্স ল্যান্ডে ছিলেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আকতার আলম বাংলাদেশের মধ্যেই নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু এলাকায় এক ইউপি সদস্যের বাড়ি ভাড়া করে পরিবার নিয়ে ছিলেন৷ কিন্তু ওই পরিবারটি নো-ম্যান্স ল্যান্ডে আশ্রয় নেয়া হিসেবেই তালিকাভুক্ত ছিল৷ পরিবারটি নো-ম্যান্স ল্যান্ডে আশ্রয় নেয়া হিসেবেই রেশন পেতেন৷”

মিয়ানমারের ফেরত যাওয়া আকতার আলমের ২ ছেলে, ২ মেয়েসহ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৬ জন৷ এরমধ্যে এক মেয়েকে রেখে ৫ জনকে নিয়ে মিয়ানমারে ফেরত গেছেন৷ তবে এক সন্তানকে রেখে যাওয়ার কারণ জানা যায়নি৷

খালেদ বলেন, “ওই পরিবারটিকে আমি চিনি৷ কিন্তু তারা কেন গেছেন এবং কিভাবে গেছেন তা জানিনা৷ সবার অজান্তে গেছেন এবং যাওয়ার পর আমরা খবর পেয়েছি৷”

কক্সবাজার শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার আবুল কালাম ডয়চে ভেলেক বলেন, ‘‘ওই পরিবারটি জিরো লাইনের৷ সেই হিসেবে তারা মিয়ানমারেই ছিলেন৷ আরো অনেকে আছেন৷ এর সঙ্গে প্রত্যাবাসনের কোনো সম্পর্ক নেই৷ তাঁরা নোম্যান্স ল্যান্ডের সবাইকে ফেরত নিতে পারে৷”

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমার চুক্তি সই করলেও প্রত্যাবাসন কবে থেকে শুরু হবে নিশ্চিত নয়৷ চুক্তি সইয়ের পর প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশ আট হাজার ৩২ হন রোহিঙ্গার তালিকা দেয়৷

তাদের মধ্যে মাত্র আটশ' রোহিঙ্গা মিয়নমারের বলে নিশ্চিত করেছে দেশটি৷ বাকিদের তথ্য ‘ত্রুটিপূর্ণ' বলে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি৷

চুক্তি অনুযায়ী ২০১৬ সালের অক্টেবরের পর থেকে এ পর্যন্ত যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছেন তাদের ফেরত নেয়ার কথা বলা হয়েছে৷ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা এসেছে সাত লাখের বেশি এবং ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্টের আগ পর্যন্ত এসেছেন ৮৭ হাজার৷ সব মিলিয়ে আট লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়ার কথা বলছে মিয়ানমার৷ তবে কবে থেকে শুরু হবে এবং শুরু হলে কতদিন লাগবে তা অনিশ্চিত৷ এরা ফেরত গেলে আগে থেকে বাংলাদেশে অবস্থানরত আরো চার লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে আরেকটি চুক্তি হওয়ারও কথা রয়েছে৷

গত সপ্তাহে মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ড. উইন মিয়ায়ে বাংলাদেশ সফর করেছেন৷ তিনি কক্সবাজারে কতুপালং শরনার্থী ক্যাম্পও পরিদর্শন করেন৷ সেখানে তিনি রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন৷

সিনিয়র কূটনৈতিক প্রতিবেদক শেখ শাহরিয়ার আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “তিনি বাংলাদেশ সফরকালে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টি আবারো বলেছেন৷ কিন্তু তাদের নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়টি নাকোচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, যাদের ফেরত নেয়া হবে তাদের প্রথমে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড দেয়া হবে৷ পরে মিয়ারমারের আইন অনুযায়ী নাগরিকত্বের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে৷”

প্রত্যাবাসন কবে শুরু হবে তা তিনি জানিয়েছেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে শাহরিয়ার জামান বলেন, “আমরা মিয়ানমারের মন্ত্রীকে এ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম৷ কিন্তু তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট সময় জানাননি৷ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারাও আমাদের বলেছেন, মিয়ানমারের মন্ত্রী প্রত্যাবাসন কবে শুরু হবে তা তাদের জানাননি৷”

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক চাপ কমাতেই তিনি বাংলাদেশ সফর করেছেন৷ কক্সবাজারে তিনি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷ কিন্তু রোহিঙ্গারা তার কথায় ভরসা পাননি, এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমারে ফিরতে আগ্রহ দেখাননি৷”

এদিকে, বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল একটি মাত্র রোহিঙ্গা পরিবারকে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘটনাকে ‘হাস্যকর' বলে মন্তব্য করেছেন৷ রবিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “যে পরিবারকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে, তারা থাকতো নো-ম্যানস ল্যন্ডে৷ বাংলাদেশের ক্যাম্পে তারা আসেইনি৷”

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বলেন, “নো-ম্যানস ল্যান্ডে অন্তত ছয় হাজার পরিবার এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছে৷ তাদের মধ্য থেকে হাজারের মধ্যে মাত্র একটি পরিবারকে ফেরত নেওয়া হাস্যকর৷ আমরা আশা করি, তাদেরকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফেরত নেবে মিয়ানমার সরকার৷”

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এসেছে৷ তাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন হয়েছে৷ এসব রোহিঙ্গার তথ্য আমরা মিয়ানমার সরকারের কাছে দিয়েছি৷”

বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় এখন জাতিসংঘও সম্পৃক্ত হয়েছে৷ গত শুক্রবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ইউএনএইচসিআরের সদর দফতরে বাংলাদেশের সঙ্গে স্মারক সই হয়৷ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক এবং ইউএনএইচসিআরের মহাপরিচালক ফিলিপো গ্র্যান্ডি নিজ নিজ পক্ষে এই সমঝোতা স্মারকে সই করেন৷

বাংলাদেশ মনে করে, এই সমঝোতা স্মারক সইয়ের ফলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি সহজ হবে৷ রোহিঙ্গারা যে স্বেচ্ছায় নিজ দেশে ফেরত গেছেন, এর মাধ্যমে সেটিও নিশ্চিত হওয়া যাবে৷

সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, রোহিঙ্গাদের তথ্য সরবরাহ, কাঠামো তৈরির জন্য জমি দেওয়া ও অন্যান্য সুবিধা নিয়ে কাজ করবে সরকার৷ অন্যদিকে, রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া, তাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া, চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার পর রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবে ইউএনএইচসিআর৷

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার আবুল কালাম বলেন, “একটি পরিবারকে ফেরত নেয়ার সঙ্গে প্রত্যাবসানের কোনো সম্পর্ক নেই৷ কারণ তারা নোম্যান্স ল্যান্ডের৷ আমরা যে রোহিঙ্গাদের তালিকা করেছি সেই তালিকায় এরা নেই৷ এরা মিয়ানমারেই আছে৷”

এটা প্রত্যাবাসন শুরুর ইঙ্গিত কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি এবং কবে শুরু হবে তাও এখন বলা যাচ্ছে না৷ ওই পরিবারটি ফিরে যাওয়ার সঙ্গে প্রত্যাবাসন শুরুর কোনো ইঙ্গিত থাকে কিভাবে৷” সূত্র: ডয়চে ভেলে

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/২২০৮ঘ.)

 

(