ধর্ষণ মামলার আসামিকে ‘ক্রসফায়ারে' দেয়া কি সমাধান?

ধর্ষণ মামলার আসামিকে ‘ক্রসফায়ারে' দেয়া কি সমাধান?

ঢাকা, ২৫ এপ্রিল (জাস্ট নিউজ) : বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে৷ গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী গত কয়েক সপ্তাহে ধর্ষণের মামলার বেশ কয়েকজন আসামি ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন৷ মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বিচার নিশ্চিত না করে ক্রসফায়ার মানবাধিকারের লঙ্ঘন৷

রবিবার (২৪.০৪.১৮) ভোররাতে চট্টগ্রামের বাঁশখালী-পেকুয়া এলাকায় র‌্যাব-এর সঙ্গে ক্রসফয়ারে আব্দুল হাকিম মিন্টু (৩০) নামে শিশু ধর্ষণ মামলার এক আসামি নিহত হয়৷ র‌্যাব জানিয়েছে, ঐ এলাকায় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে প্রথমে তাদের গোলাগুলি হয়৷ পরে আব্দুল হাকিম মিন্টুর লাশ পাওয়া যায়৷ র‌্যাব-এর কথা অনুযায়ী, ঘটনাস্থল থেকে একটি ওয়ান শুটার গান, পাঁচ রাউন্ড গুলি ও দু'টি গুলির খোসা উদ্ধার করে তারা৷

নিহত আব্দুল হাকিম মিন্টু গত ১৮ এপ্রিল বাঁশখালীর শেখেরখীল ইউনিয়নে এলাকায় তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী ১০ বছরের একটি শিশুর ধর্ষণ মামলার আসামি৷

গত ২১ এপ্রিল রাতে সাতক্ষীরা কলারোয়ায় শিশু ধর্ষণ মামলার আসামি সোহাগ হোসেন পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হয়৷ সে কলারোয়া উপজেলার কেড়াছাগাছি ইউনিয়নের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী ন'বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণ করেছিল বলে জানায় পুলিশ৷

৯ এপ্রিল যাশোরে র‌্যাব-এর ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে শিশু ধর্ষণ মামলার আরেক আসামি আল আমিন ওরফে বাবু৷ যশোর সদর উপজেলার খোলাডাঙ্গা এলাকায় বন্দুকযুদ্ধের পর তার মরদেহ উদ্ধার করা হয় বলে জানায় ব়্যাব৷ তার বিরুদ্ধে গত ৩০ মার্চ আট বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণ করার অভিযোগে মামলা আছে৷ ঘটনাস্থল থেকে একটি ওয়ানশুটার গান, এক রাউন্ড গুলি ও একটি ছোরা উদ্ধার করা হয় বলে খবর৷

গত ৯ মার্চ ভোর রাতে আশুলিয়ায় ক্রসফায়ারে ধর্ষণ মামলার আসামি রুবেল নিহত হয়৷ রুবেল সাভারে একটি বাসে তরুণী ধর্ষণ ও চালক হত্যা মামলার প্রধান আসামি বলে জানিয়েছে পুলিশ৷

গত বছরের ১৭ অক্টোবর ভোর রাতে কক্সবাজারে শিশু ধর্ষণ মামলার আসামি সেলিম র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়৷ র‌্যাব জানায়, সেলিম ঐ বছরের ২৩ আগস্ট কক্সবাজার বিমানবন্দর রোডের ফিশারিঘাট এলাকায় তিন বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করেছিল৷ সেলিমকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযোন চালালে গোলগুলিতে সে নিহত হয়৷ ঘটনাস্থল একটি বিদেশি পিস্তল ও একটি ওয়ান শুটার গানও উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানায় ব়্যাব৷

এদিকে বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য ধর্ষণকারীদের ক্রসফায়ারে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন খোদ সংসদেই৷ জাতীয় পার্টির সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ গত ১০ এপ্রিল সংসদে এই দাবি জানান৷ তিনি সংসদ অধিবেশনে অনির্ধারিত আলোচনায় দেশে সম্প্রতি ‘গণধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার’ বিষয়টি তুলে ধরেন৷ এরপর গত মার্চ মাসে আশুলিয়ায় বন্দুকযুদ্ধে ধর্ষণের আসামি নিহত হওয়ার উদাহরণ দিয়ে বলেন, “ন'বছরের একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে পালিয়ে গিয়েছিল সে৷ সেই ধর্ষণকারীর সাথে র‌্যাব-এর বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে৷ র‌্যাব-এর দু'জন আহত হয়েছে৷ ধর্ষক নিহত হয়েছে৷ এটাই জনগণ দেখতে চায়৷”

তিনি বলেন, “প্রতিদিনই বাসে ধর্ষণ হবে আর আপনি আইনের আশ্রয় নেবেন? এভাবে চলতে পারে না৷ মানুষ দেখতে চায়, এই মুহূর্তে বিচার হবে কি হবে না৷” তিনি অবশ্য একইসঙ্গে ধর্ষণ মামলার বিচারের জন্য সংক্ষিপ্ত আদালতের কথাও বলেন৷

তবে ধর্ষণের মামলার আসামিদের ক্রসফায়ারে দেয়ার বিরোধিতা করেছেন মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজ্ঞরা৷ তারা বলছেন, ‘‘একটা অপরাধ কমাতে গিয়ে আরেকটা অপরাধ করা হচ্ছে৷ কোনো ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাই অগ্রহণযোগ্য৷ তাছাড়া এতে ধর্ষণ কমবে না৷ বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করে অপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে তবেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে৷”

মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, “ধর্ষণের মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার ও তদন্তে অনীহা দেখতে পাই আমরা৷ বিচারেও তেমন অগ্রগতি নেই৷ শতকরা মাত্র তিনভাগ মামলায় আসামির শাস্তি হয়৷ নানা পর্যায়ে প্রভাবশালীদের ছাড়ও দেয়া হয়৷ বাস থেকে নেমে এক নারী যৌন হয়রানির অভিযোগ করলেন৷ অথচ পুলিশ বললো, তদন্ত ছাড়া তাকে আটক করা যাবে না৷ এছাড়া মামলা প্রমাণেও আছে নানা জটিলতা৷ এ সব কারণে ধর্ষকরা পার পেয়ে যায়৷ ফলে ধর্ষণ বেড়ে চলেছে৷ ধর্ষক অপ্রতিরোধ হয়ে উঠছে৷ তাই একমাত্র বিচার নিশ্চিত করা গেলে এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে৷”

তিনি বলেন, “ধর্ষণের মামলার আসামিদের ক্রসফায়ারে দেয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না৷ একটি অপরাধ দমনে আরেকটি অপরাধ করা হচ্ছে৷ আমরা এটাকে হত্যাই বলি৷ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন৷ এর মাধ্যমে ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ কমবে না৷ কমার কোনো কারণও নেই৷ আর ধর্ষণের বিচার যে হয় না, তার প্রমাণ হলো ক্রসফায়ার৷ বিচার নিশ্চিত করতে হবে৷ ধর্ষণ বন্ধে ক্রসফায়ার কোনো সমাধান নয়৷”

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ হলো অপরাধ শনাক্ত করা, তদন্ত করা এবং অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করা৷ বিচারকের কাজ তাদের নয়৷ বিচারকের কাজ বিচারকের৷ তাই কোনোভাইে ক্রসফায়ার গ্রহণযোগ্য নয়৷ এটা অব্যাহত থাকলে মনে হাতে পারে যে বিচারালয়ের প্রয়োনীয়তা ফুরিয়ে যাচ্ছে৷ তাছাড়া এতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এতটা জবাবদিহিতার বাইরে চলে যায় যে তারা নিজেরাই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে৷”

তিনি বলেন, “বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে৷ সমাজে যারা রাজনৈতিক, আর্থিক বা অন্য কোনোভাবে শক্তিশালী, তারা বিচার এড়াতে পারে৷ ফলে সমাজে যে কোনো অপরাধ করে পার পাওয়া যায় এই ধারণা গড়ে উঠেছে৷ তাই ধর্ষণসহ সব ধরনের অপরাধ বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করার পথ হলো বিচার ব্যবস্থাকে কার্যকর করা৷” সূত্র: ডয়চে ভেলে

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/২১৫০ঘ.)