প্রফেসর ইউনূসকে অভ্যর্থনা জানালেন ইতালীয় পার্লামেন্ট স্পীকার

প্রফেসর ইউনূসকে অভ্যর্থনা জানালেন ইতালীয় পার্লামেন্ট স্পীকার

ঢাকা, ২২ মে (জাস্ট নিউজ) : নোবেল লরিয়েট প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক রোম সফরকালে ইতালির নতুন পার্লামেন্টের নব নির্বাচিত স্পীকার রবার্টো ফিকো তাকে স্বাগত জানান। তারা সামাজিক ব্যবসা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ইতালির সাম্প্রতিক জাতীয় নির্বাচনে রবার্টো ফিকোর দল জয়ী হবার প্রেক্ষিতে দেশটির অর্থনীতি পরিচালনার ও তরুণদের কর্মসংস্থানের দায়িত্ব এসে পড়েছে তার দলের উপর।

উল্লেখ্য যে, ইতালির তরুণ জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশই এখন বেকার। বেকারদেরকে উদ্যোক্তায় পরিণত করার প্রফেসর ইউনূসের তত্ত্বে বিশেষভাবে আগ্রহ প্রকাশ করেন স্পীকার। তাদের এই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে তারা ইতালির অর্থনীতির সমস্যাগুলোর বাস্তবসম্মত বিভিন্ন উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। তাদের আলোচনার একটি বিষয়বস্তু ছিল বেকার তরুণদেরকে একটি ন্যুনতম আয় যোগান দেয়া। প্রফেসর ইউনূস তার অবস্থান এভাবে ব্যাখ্যা করে বলেন যে, রাষ্ট্রীয় ভরতুকি বড়জোর সমস্যাটি চাপা দিতে পারে, কিন্তু এটা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। তিনি যুক্তি দেখান যে, মূল সমাধানটি নিহিত তরুণদের সৃষ্টিশীল সক্ষমতার বিকাশের উপর। স্পীকার আগামী মাসগুলোতেও এই সংলাপ চালিয়ে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি ইতালীয় পার্লামেন্টের একটি প্রতিকৃতি প্রফেসর ইউনূসকে উপহার দেন।

প্রফেসর ইউনূসকে আরো অভ্যর্থনা জানান রোমের নবনিযুক্ত তরুণী মেয়র। ঊনচল্লিশ বছর বয়সী মেয়র ভার্জিনিয়া এলেনা রাজ্জি প্রফেসর ইউনূসের সাথে তার বৈঠকে রোমের তরুণ ডেপুটি মেয়র লুকা বারগামোকেও আলোচনায় অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানান।

মেয়র ভার্জিনিয়া প্রফেসর ইউনূসকে বলেন যে, প্রফেসর ইউনূস উদ্ভাবিত ক্ষুদ্র ঋণের সাথে তিনি পরিচিত। তিনি ইতালির বিশেষ করে রোমের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা নিয়ে প্রফেসর ইউনূসের সাথে আলাপ করেন। তিনি বলেন যে, তিনি রাজনীতিবিদ নন; তার অধিকাংশ বন্ধুর মতোই তিনি আগে কখনোই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না এবং কোনো সরকারী পদের জন্য প্রতিযোগিতা করার কথা কখনো ভাবেননি। কিন্তু তিনি “ফাইভ স্টার” আন্দোলনে যোগ দেন ও মেয়র পদের জন্য প্রতিযোগিতা করেন কেবল এটা বোঝাতে যে, ইতালির সমস্যাগুলোর সমাধান, যেমনটা রাজনীতিবিদরা বিশ্বাস করেন, প্রচলিত পদ্ধতিতে সম্ভব নয়; এজন্য প্রয়োজন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপন্থা। সনাতনী রাজনীতিবিদরা তাদের সমস্যাগুলোর কোনো সমাধান দিতে পারেননি। প্রফেসর ইউনূস উপস্থাপিত সমাধানগুলো নিয়ে তারা বিশদ আলোচনা করেন।

তিনি সামাজিক ব্যবসার ধারণাটি পছন্দ করেন এবং বলেন যে, তিনি এটা নিয়ে কাজ করবেন। এছাড়াও তিনি রোমকে “সামাজিক ব্যবসা নগরী”তে রূপান্তরিত করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। পৃথিবীর যেসকল দেশ এরই মধ্যে নিজেদেরকে সামাজিক ব্যবসা নগরী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে তিনি তাদের ব্যাপারে আরো জানতে চান।

২০১৯ সালে রোম নগরীর আয়োজনে একটি “সোশাল বিজনেস মেডিটারেনিয়ান সামিট” করার সম্ভাব্যতা নিয়েও তাদের মধ্যে আলোচনা হয়। তার রোম সফরের সময় প্রফেসর ইউনূস বাসিলিকাতা স্থানীয় সরকারের সাথে এই অঞ্চলে সামাজিক ব্যবসা অর্থায়নের লক্ষ্যে একটি সামাজিক ব্যবসা তহবিল সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ইউনূস সেন্টারের একটি দুই সদস্যর অগ্রগামী প্রস্তুতিমূলক প্রতিনিধিদল এই প্রক্রিয়া শুরু করতে এমাসের শেষেই বাসিলিকাতা সফর করবে।

প্রফেসর ইউনূস রোম থেকে দু’ঘন্টার দুরত্বে অবস্থিত আসিসি নগরী পরিদর্শন করেন। এই নগরীর এক প্রান্তে অবস্থিত ক্যাথলিক ভিক্ষু সান ফ্রান্সিস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত অষ্টম শতাব্দীর বিখ্যাত সান ফ্রান্সিস মঠ। মঠের কার্ডিনাল লোরেনজো বালদিসসেরি সেখানে আয়োজিত একটি ইয়ুথ ফোরামে ভাষণ দিতে প্রফেসর ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানান। সান ফ্রান্সিকান ক্যাথলিক তরুণরা ইতালির তরুণদের মধ্যে ব্যাপক বেকারত্ব সৃষ্টিকারী অর্থনৈতিক দুর্দিন থেকে পরিত্রা পেতে একটি বড় ভূমিকা নিতে আগ্রহী।

অষ্টম শতাব্দীর প্রখ্যাত ভিক্ষু সান ফ্রান্সিসের জন্ম এই আসিসি নগরীতে। নগরীটির দারিদ্র দুর করতে তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তার প্রতি সম্মান জানাতেই বর্তমান পোপ ফ্রান্সিস পোপ নিযুক্ত হবার পর তার নাম ধারণ করেন।

প্রফেসর ইউনূসকে আমন্ত্রণ করা হয় ভিক্ষুদের সাথে মধ্যাহ্নভোজ করতে, যারা বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। তাকে ভিক্ষুদের আলাদা স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে প্রধান ভিক্ষু একটি আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের মাধ্যমে প্রফেসর ইউনূসকে স্বাগত জানান। এরপর প্রফেসর ইউনূস ২৯টি দেশের ৭৬ জন ভিক্ষুর সাথে একটি সাধারণ মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। প্রধান ভিক্ষু এরপর প্রফেসর ইউনূসকে মঠের একেবারে ভেতরে অবস্থিত সান ফ্রান্সিসের সমাধিস্থলে সেখানে নিয়ে যান। তার সমাধিকে নিরাপদ রাখতে সেটা দীর্ঘদিন গোপন রাখা হয়েছিল।

আসিসির আর্চবিশপ মহামান্য সোররেন্তিনো তরুণদেরকে জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেতে কীভাবে সাহায্য করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করতে প্রফেসর ইউনূসের সাথে একটি পৃথক বৈঠক করেন।

ফাদার এনজো ফরতুনাতো একটি জাতীয় টেলিভিশন গ্রোগ্রামের জন্য প্রফেসর ইউনূসের একটি সাক্ষাৎকার নেন। তার ইতালি সফরকালে ১৮ থেকে ২১ মে প্রফেসর ইউনূস ইতালির তিনটি প্রধান নগরী তুরিন, মিলান ও রোম সফর করেন।

উল্লেখ্য যে, ইতালির রাজনৈতিক নেতা, সিভিল সোসাইটি নেতা, সমাজকর্মী ও শিক্ষাবিদদের মধ্যে সামাজিক ব্যবসা নিয়ে ব্যাপক আগ্রহের প্রেক্ষিতে এ বছর ইতালিতে এটি তার দ্বিতীয় সফর।

প্রফেসর ইউনূসের এই ইতালি সফরে ইতালির জাতীয় ও নগর পর্যায়ের বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে তার পৃথক পৃথক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তার সফরের শুরুতে তিনি তুরিনের ৩৩ বছর বয়সী নারী মেয়র কিয়ারা আপপেন্দিনোর সাথে কমিউনিটির উন্নয়নে সামাজিক ব্যবসাকে কাজে লাগাতে প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের মধ্যকার সহযোগিতাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায় সে বিষয়ে আলোচনা করতে একটি বৈঠক করেন। এই বৈঠকের পর মেয়র কিয়ারা প্রফেসর ইউনূসের সাথে তার বৈঠক নিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে টুইট করেন।

তার ইতালি সফরে প্রফেসর ইউনূস তিনটি নগরীতে জন-বক্তৃতা প্রদান করেন। এগুলো হচ্ছে তুরিনের ইন্তেসা সান পাওলো অডিটোরিয়াম, মিলানের গিয়ানগিয়াকোমো ফেলত্রিনেল্লি অডিটোরিয়াম এবং রোমের ম্যাক্সি মিউজিয়াম অডিটোরিয়াম। এই অনুষ্ঠানগুলোতে তিনি “তিন শূন্য” অর্থাৎ একটি শূন্য দারিদ্র, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য নীট কার্বন নিঃসরণের ভবিষ্যত পৃথিবী নিয়ে কথা বলেন। প্রতিটি অডিটোরিয়ামই ছিল ব্যাংকার, ব্যবসায়ী নেতা ও সামাজিক ব্যবসায়ে আগ্রহী শ্রোতাতে পূর্ণ। তারা প্রফেসর ইউনূসের একটি “তিন শূন্য”র নতুন অর্থনীতি গড়ে তোলার প্রস্তাব ও এই পৃথিবী গড়ে তোলার কর্মপন্থা বিপুল আগ্রহ নিয়ে শোনেন।

মিলানে গিয়ানগিয়াকোমো ফেলত্রিনেল্লি অডিটোরিয়ামের বই উপস্থাপনা অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন ৯২ বছর বয়সী বিখ্যাত ইতালীয় চিত্রগ্রাহক, পরিচালক ও প্রকাশক ইনগে ফেরতিনেল্লি যিনি প্রফেসর ইউনূসের একজন পুরোনো বন্ধু। তিনি তার পারিবারিক প্রকাশনা সংস্থা গিয়ানগিয়াকোমো ফেলত্রিনেল্লি এডিটোরে-র অন্যতম প্রধান। প্রতিষ্ঠানটি প্রফেসর ইউনূসের নতুন গ্রন্থ-এর ইতালীয় অনুবাদ প্রকাশ করেছে। প্রফেসর ইউনূসের শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন ইতালির প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও লমবারদির প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রবার্তো মারোনিসহ বেশ কয়েকজন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, ব্যবসায়ী নেতা, সমাজকর্মী এবং গিয়ানগিয়াকোমো ফেলত্রিনেল্লি ফাউন্ডেশনের অংশীদারগণ।

এছাড়া প্রফেসর ইউনূস সুরকার পাওলো সামোজ্জিয়া ও তার প্রোডাকশন টিমের সাথে সাক্ষাত করেন। উল্লেখ্য যে, পাওলো গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ইউনূসের জীবন ও দারিদ্র বিমোচনে তার সংগ্রাম নিয়ে পূর্ণ দৈর্ঘ অপেরা “২৭ দলারি” তৈরী করেছেন। এই অপেরাটি তৈরী করতে তিনি গত আট বছর ধরে কাজ করেছেন। তিনি এখন অপেরাটি জনসমক্ষে প্রচার করতে প্রস্তুত যার অর্থায়ন ও দৃশ্যগ্রহণ সবই এই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। তিনি তার অপেরাটি প্রদর্শনী উদ্দেশ্যে একটি “উদ্বোধনী রজনী”র জন্য প্রফেসর ইউনূসের নিকট সময় চেয়েছেন।

তার ইতালি সফরকালে প্রফেসর ইউনূস ইতালির বেশ কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় মিডিয়ার নিকট সাক্ষাৎকার দেন। এদের মধ্যে ছিল স্কাই আরতে, ইটালিয়ান ফাইনান্সিয়াল টাইম্স, ইল সোলে ২৪ অরে, রাই টিজি রিজিওনালে, টিভি২০০ ও রেডিও ২৪। এছাড়াও তিনি রাই টিভি-তে ফাবিও ফাজি-র সঞ্চালনায় লেট নাইট শো “কে তেমপো কে ফা”-তে যোগ দেন।

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/২১৪৫ঘ.)