‘পুলিশ পাহারায়’ মাদকের হাট

‘পুলিশ পাহারায়’ মাদকের হাট

ঢাকা, মে ২৪ (জাস্ট নিউজ): রাজধানীর সবচেয়ে বড় মাদকের হাট তেজগাঁও রেললাইন বস্তি। এখানে প্রতিদিন প্রকাশ্যে বিক্রি হয় ইয়াবা, গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক। এক সময় ডালায় মাদক সাজিয়ে বিক্রি করা হলেও এখন সতর্কতার সঙ্গে চলছে এ ব্যবসা। নারীরা শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় লুকিয়ে রাখেন ইয়াবা ট্যাবলেট। আর কোমরের সঙ্গে বাঁধা কাপড়ের বিশেষ ব্যাগে রাখেন কাগজে মোড়ানো গাঁজার পুঁটলা। বস্তির খুপরি ঘরে রাখা হয় ফেনসিডিল, হেরোইন। ক্রেতার চাহিদামতো মাদকের জোগান দেয় বিক্রেতারা।

দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান চললেও তেজগাঁও রেললাইন বস্তিতে ‘পুলিশি প্রহরায়’ মাদক ব্যবসা চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কারওয়ান বাজার, এফডিসি রেলগেট ও তেজগাঁও এলাকায় বুধবার পুলিশকে সাইরেন বাজিয়ে চলতে দেখা গেছে। সাইরেনের আওয়াজ পেয়েই সতর্ক হয়ে যায় মাদক বিক্রেতারা।

অভিযোগ রয়েছে- মোটা অঙ্কের মাসোয়ারা পাওয়ায় পুলিশ তাদের দেখেও না দেখার ভান করছে। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে এসব তথ্য।

বুধবার বিকাল সাড়ে ৫টা। কারওয়ান বাজার রেললাইনে উঠতেই দেখা গেল শুঁটকি মার্কেটের পাশের রেললাইনে বসে আছেন ৩ নারী। তাদের মতো একটু দূরে দূরে বিভিন্ন স্থানে বসে আছেন আরো ১০-১২ জন। রেললাইন দিয়ে হেঁটে যেতেই একজন বললেন, ‘মামা কয় টাকার? ৫০ টাকার না ১০০ টাকার?’ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখা গেল লোকজন আসছে, ওই নারীদের কাছ থেকে মাদক কিনে দ্রুত সরে যাচ্ছে।

মাদক বিক্রেতা এক নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আগে তো ডালা সাজিয়ে বসতাম। এখন পুলিশ আর খোলামেলা বসতে দেয় না। বলেছে, কিছুদিন এভাবে সতর্ক হয়ে বিক্রি করতে।’

‘পুলিশে ধরলে তো ঝামেলায় পড়বেন?’- এমন প্রশ্নের জবাবে ওই নারী বলেন, ‘না বিশেষ কোনো বাহিনী আসার আগেই খবর পেয়ে যাব। পয়েন্টে পয়েন্টে পুলিশের লোক পোশাক ছাড়া দাঁড়ানো আছে। তারাই খবর দিয়ে দেবে।’

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে তেজগাঁও থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘গত ডিসেম্বর থেকে তেজগাঁও রেললাইন এক্কেবারে মাদকমুক্ত। অনেক কষ্টে মাদকমুক্ত করেছি। টুকটাক দু’চার পুঁটলা গাঁজা বিক্রি হয়। সালমা, শিল্পী, পারুলসহ বেশ কয়েকজনকে ধরে আমরা কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছি। ডিসেম্বরের পরে আমার এসআই-দারোগারা কথা দিয়েছে তারা মাদকের সঙ্গে জড়িত হবে না।’ তিনি পুলিশি পাহারায় তেজগাঁওয়ে মাদক ব্যবসার অভিযোগ অস্বীকার করেন।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। মাদকের চালান বেশির ভাগ সময় রেলপথে আসে। এটি একটি বড় সমস্যা। আমরা আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে মাদকবিরোধী অভিযান অব্যাহত রেখেছি। তেজগাঁও এলাকায় আগের মতো মাদক বিক্রি হয় না বলেও দাবি করেন তিনি।

কারওয়ান বাজারে মিন্তির কাজ করেন রংপুরের আবদুল জলিল। বুধবার রাত পৌনে ৮টায় বস্তি সংলগ্ন রেললাইনে তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি ৫০ টাকায় এক পুরিয়া গাঁজা কেনার কথা স্বীকার করেন। জলিল বলেন, রাত জেগে পরিশ্রমের কাজ করি তো; তাই সিগারেটে ভরে একটু-আধটু খাই। এতে শরীরের বিষব্যথা একটু কাটে।

তিনি বলেন, তেজগাঁও রেললাইন বস্তিতে অধিকাংশ মাদক বিক্রেতাই নারী। তারা পাইকারি দামে মাদক কিনে এখানে আমাদের মতো মানুষের কাছে খুচরা বিক্রি করে।

কারওয়ান বাজার থেকে বাজার করে রেললাইন দিয়ে হেঁটে পার হচ্ছিলেন বেগুনবাড়ি এলাকার বাসিন্দা জাকির হোসেন। তিনি বলেন, এখন তো একটু সহনীয় অবস্থা। রোজার আগে মাদক ব্যবসায়ীরা এতটাই বেপরোয়া ছিল যে, রেললাইনে উঠলেই মেয়েরা ঘিরে ধরত, মামা কোনটা নিবেন, শুকনা (গাঁজা) না গুটি (ইয়াবা)। তিনি বলেন, যারা মাদক নিয়ে আসে অর্থাৎ আড়তদার তারা কখনও ধরা পড়ে না। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। এরা পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে চলে।

স্থানীয় এক কাঁচামাল ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখানে গভীর রাত পর্যন্ত মাদক ব্যবসা চলে। রাতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মালামাল নিয়ে পরিবহন শ্রমিকরা কারওয়ান বাজারে আসেন। তাদের কেউ কেউ মাদক কিনে পান করে। রাতে সবজির বাজার জমে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মাদকের বাজার আরো জমে ওঠে।

বুধবার রাত ৯টায় দেখা যায় রেললাইনে তিন নারী জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এক যুবক রেললাইন দিয়ে হেঁটে তাদের কাছে যেতেই একজন নিজের বুকে হাত দিয়ে কি যেন বের করে দিলেন। যুবক ১ হাজার টাকার একটি নোট দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে সে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে- বাবা কিনেছি, আপনার এত জানার দরকার কি? কিনবেন? না কিনলে কেটে পড়েন। এরপর অন্ধকার থেকে এ প্রতিবেদককে লক্ষ্য করে পানির বোতল ছুড়তে থাকেন কে বা কারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারী মাদক ব্যবসায়ীরা গাঁজা ও হেরোইনের পুরিয়া, ইয়াবা কোমরে গুঁজে বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। মাদকসেবীরা এসব মহিলাকে চেনে। তারা এসে মিনিটের মধ্যে মাদক কিনে কেটে পড়ে।

স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাদকের এ বড় বাজারটি দীর্ঘ দুই যুগ ধরে চলে আসছে। সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, তেজগাঁওয়ের এই রেলপথ ঘিরে প্রতিদিন ৫০ লাখ টাকার মাদকের লেনদেন হয়।

এফডিসি গেট এলাকার এক চা দোকানি বলেন, দেখতেই তো পাচ্ছেন রেললাইনের দু’পাশে রয়েছে কয়েক হাজার খুপরি ঘর। এসব বস্তিঘর ব্যবহার হয় মাদক বাণিজ্যে। এসব বস্তি ঘরে ইয়াবা থেকে শুরু করে সব রকম মাদক পাওয়া যায়। এখানে মাদক আসে ট্রেনে করে। সাদা পোশাকের পুলিশ ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন জায়গায়। তারা মাদক বিক্রেতাদের সহযোগিতা করে। বড় রেইড (অভিযান) শুরুর আগে তারা খবর জানিয়ে দেয় মাদক বিক্রেতাদের।

তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড এলাকায় গিয়ে কথা হয় আজিজুল ইসলাম নামে এক ট্রাকচালকের সঙ্গে। আজিজুলের বাড়ি মাগুরায়। তিনি বলেন, এখানে মাদক চলবে না তো চলবে কোথায়? ট্রাকস্ট্যান্ডেই তো প্রায় ৫০ হাজার পরিবহন শ্রমিক আসা-যাওয়া করে। তাদের অনেকেই কোনো না কোনো নেশায় সম্পৃক্ত। এরা রেললাইন থেকে মাদক কেনে।

তিনি বলেন, মাদক কেনাবেচার জন্য কারওয়ান বাজার সংলগ্ন রেললাইন বস্তিটি বেশ সুবিধার। এফডিসি রেলক্রসিং ও কারওয়ান বাজারের দিকে একাধিক রাস্তা থাকায় এখানে সহজে গা ঢাকা দেয়া যায়। তাই মাদকের ক্রেতাও বেশি। তা ছাড়া মাদকবিরোধী অভিযান হলে বিক্রেতারা বস্তিঘরে লুকিয়ে পড়তে পারেন। ধাওয়া খেয়ে কারওয়ান বাজারের পথচারীদের মধ্যেও মিশে যেতে অসুবিধা হয় না তাদের। তেজগাঁও এফডিসি ক্রসিং থেকে শুরু করে কারওয়ান বাজারের শুঁটকিপট্টি পর্যন্ত রেললাইনে মাদকের ব্যবসা চলে তুলনামূলক বেশি। বিকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নানা বয়সের নারী হাতে প্যাকেট নিয়ে রেললাইনের ওপর হেঁটে বেড়ায়। পথচারী দেখলেই তারা ইশারায় ডাকেন। মুহূর্তেই মাদক বিক্রি করে সরে পড়েন।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, তেজগাঁও এলাকায় প্রতিদিন গড়ে এক মণ গাঁজা বিক্রি হয়। ময়মনসিংহ, হালুয়াঘাট, কুমিল্লা, বি-বাড়িয়া থেকে ট্রেনে আসে গাঁজা, ফেনসিডিল ও ইয়াবার চালান। অন্যদিকে টেকনাফ থেকে ইয়াবার চালানগুলো চট্টগ্রাম হয়ে ট্রেনে করে রাজধানীতে আনা যায়। এসব কারণে কারওয়ান বাজারের কাছের রেলপথকে বেছে নিয়েছে মাদক বিক্রেতারা। পাশে শুঁটকির বাজারও মাদক ব্যবসায়ীদের আরেকটি বাড়তি সুবিধার কারণ। টেকনাফ থেকে শুঁটকির চালান এখানকার দোকানে আসে। এ চালানের ভেতরে করে ইয়াবার চালান আসে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে।

রেললাইনের বস্তিতে সাহিদা, মাহমুদা, নীলা, জরিনা, মিনা ও কুট্টি মাদকের পাইকারি আড়তদার। আর খুচরা বিক্রি করেন জরিনা, পারভিন, আকলিমা, লীলা, দুলাল, গাঁজা সেন্টু, বাবু, সোহেল, তজুসহ অন্তত ৫০ জন। সুত্র: যুগান্তর।

(জাস্ট নিউজ/এমআই/১০০০ঘ)