খুলনায় প্রহসনের নির্বাচন

মেরুদণ্ডহীন ইসির ‘চমৎকার’ রসিকতা

মেরুদণ্ডহীন ইসির ‘চমৎকার’ রসিকতা

ঢাকা, ২৫ মে (জাস্ট নিউজ) : রকিব উদ্দিন নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড তথা রকিব মার্কা নির্বাচনের চিত্র দেশের মানুষ আজও ভোলেননি। রকিব কমিশনের বিদায় হলে নানা নাটকীয়তার পর গঠিত হয় বর্তমান নুহু (নুরুল হুদা) কমিশন। কিন্তু বর্তমান ‘নুহু কমিশন’ খুলনায় যা করেছে রকিব কেলেঙ্কারিকেও হার মানিয়েছে। অবশ্য রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে ওএসডি হওয়া এক সময়ের ‘হাফ’ সেক্রেটারি নুহুকে নিয়ে শুরুতেই বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। তৈরি হয়েছিল ইসির ইমেজ সংকট। এটি কাটিয়ে উঠতে নিজেকে নিরপেক্ষ প্রমাণের চেষ্টা চালান। মাঝে মধ্যে ভিন্নধর্মী কথাবার্তা বলে চলছিলেন। কিন্তু মুখে যা বলছিলেন বাস্তবে এর কোনোই প্রতিফলন ঘটাতে পারেননি। বরং প্রতিটা নির্বাচনেই চরম মেরুদণ্ডহীনতার পরিচয় দিয়েছে এই কমিশন। যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে রকিব কমিশনকেও হার মানিয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান কমিশন কথাবার্তায় মাঝে মধ্যে নিজেদেরকে নিরপেক্ষ প্রমাণের চেষ্টা করলেও তাদের কর্মকাণ্ডে আশার কিছু দেখাতে পারেনি। এ নির্বাচনে ৯৯.৯৪ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়েছে। এটি জালিয়াতির জাজ্বল্য প্রমাণ। এতবড় ভোট জালিয়াতির পরও কারচুপিকে বৈধতা দেয়ার জন্য ‘চমৎকার’, ‘সুন্দর’ বলে দাবি করেছে ইসি। যা জাতির সঙ্গে ইসির এক ধরনের তামাশা ছাড়া কিছুই নয়। সাধারণ মানুষ এটাকে ইসির ‘রসিকতা’ বলেই মনে করছেন।

সূত্র বলছে, খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগের দিন ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে বাছাইকৃত রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাডার আমদানি হয় নগরীতে। ওই রাতে খুলনার সব হোটেল বহিরাগত ক্যাডারে পরিপূর্ণ ছিল। এমনকি সাংবাদিকরাও হোটেলে থাকার জায়গা পাননি। এ ক্যাডারদের নেতৃত্বে নির্বাচনের দিন ভোটারদের নৌকায় ভোট দিতে জোর-জবরদস্তি করা হয় ব্যাপকভাবে। ২৮৯ ভোট কেন্দ্রের অন্তত ১৫০ কেন্দ্র দখল করে নেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু ক্যাডারদের প্রতিরোধে কমিশন কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়। উল্টো খুলনায় সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণে ‘নুহু কমিশন’ বাড়তি বিধি-নিষেধ আরোপ করে। আর ‘চমৎকার ও সুন্দর ভোট’ বলে কেন্দ্র দখল, ব্যালট বই ছিনতাই, সিল মারা, মারধর করে অন্য এজেন্টদের বের করে দেয়াসহ নানা অপকর্মকে সমর্থন করেছে ইসি। এমন পরিস্থিতিতে ইসি পুনঃগঠনের দাবি তুলেছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে দলীয় প্রতীকে খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনটি ক্ষমতাসীন ও বিরোধী জোটসহ সবার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ কারণে খুলনায় কেমন ভোট হয়, তার প্রতি দৃষ্টি ছিল পুরো দেশবাসীসহ আন্তর্জাতিক মহলের। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একপেশে আচরণসহ নানা কারণে শুরু থেকেই আশঙ্কা ছিল সুষ্ঠু ভোট নিয়ে। বহু প্রতীক্ষার পর ভোটের দিন বাস্তবেও সেই আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হলো। সরকারি দলের নেতাকর্মীদের জালভোটের মহোৎসব দেখেছেন দেশবাসী। ভোট শুরুর আগে কেন্দ্র দখল, ব্যালট বই ছিনতাই করে নৌকায় সিল মারা, বিএনপি প্রার্থীর এজেন্টদের ভোট কেন্দ্রে ঢুকতে না দেয়া, কেন্দ্র থেকে মারধর করে বের করে দেয়া, হামলা, ভাঙচুর কিছুই বাদ যায়নি খুলনা সিটির নির্বাচনে। সবচেয়ে মজার ব্যাপর হলো- এবারই প্রথম আওয়ামী লীগের নারী কর্মীরাও কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মারার নতুন রেকর্ড তৈরি করেছেন। যা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে এমনটি কেউ দেখেননি বা শোনেনওনি। খুলনার আওয়ামী লীগের নারী কর্মীরা সেটাই করে দেখিয়েছেন। এটাকে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ‘সিম্বল’ হিসেবেই দেখছেন কেউ কেউ। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, সরকারি দলের বিজয়ী মেয়র, নির্বাচন কমিশন (ইসি), রিটার্নিং কর্মকর্তা ও খুলনার পুলিশ কমিশনার- সবাই একই সুরে সব অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন। তারা দাবি করেছেন, ‘সুষ্ঠু, সুন্দর ও চমৎকার ভোট হয়েছে’। কিন্তু গণমাধ্যমের সুবাদে খুলনাসহ পুরো দেশবাসী ‘চমৎকার’ ভোটের প্রকৃত রূপ দেখেছেন। যদিও অজ্ঞাত কারণে কিছু ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।

এখন রাজনৈতিক সচেতন মহলের প্রশ্ন হলো- সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনার পর আগামী মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোটও কি তাহলে খুলনার মতো ‘চমৎকার’ হবে? তারা বলছেন, সেই আশঙ্কা তৈরি হওয়াও অযৌক্তিক নয়। কারণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সব সময়ই ক্ষমতাসীন দলের আনুগত্য প্রদর্শন করে আসছে। আর ইসির তো নিজস্ব কোনো জনবল নেই। সরকারের ইচ্ছার উপরই নির্ভরশীল থাকে ইসি। যদিও নির্বাচনের বিষয়ে ইসিকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়া আছে সংবিধানে কিন্তু ইসি ‘সাহস’ করে কখনো সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে না।

অবশ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ আবার বলছেন, সরকার খুলনার মতো গাজীপুরে ভোট ‘ছিনতাইয়ের’ তেমন বেশি সুযোগ পাবে না। কারণ গাজীপুরে বিএনপির মেয়র প্রার্থী আওয়ামী লীগের প্রার্থীর তুলনায় শক্তিশালী। তাছাড়া গাজীপুরে আওয়ামী লীগের কোন্দল বেশি। ফলে এখানে বিএনপি প্রার্থীর জন্য বাড়তি সুযোগ থাকছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারি দল বিএনপি প্রার্থীকে সেই সুযোগ কতটা কাজে লাগাতে দেবে- তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

বিবিসির চোখে খুলনার ভোট
জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত খুলনা সিটি নির্বাচন নিয়ে চলছে নানা আলোচনা, বিচার-বিশ্লেষণ। ভোটশেষে বিএনপি ব্যাপক ভোট জালিয়াতির অভিযোগ করলেও আওয়ামী লীগ একে ভিত্তিহীন এবং অপপ্রচার হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সাধারণ মানুষের বক্তব্যেও যথার্থতা নির্ণয় করা মুশকিল। কারণ কে কোন দলের- সেটিও বোঝা যায় না। কিন্তু কেমন হলো খুলনার নির্বাচন- তা বোঝা দরকার।

বিবিসির সংবাদদাতা আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, ‘ভোটের প্রকৃত অবস্থা বোঝার জন্য একটি কেন্দ্রে ভোট গণনার সময় উপস্থিত ছিলাম। ওই কেন্দ্রে ৬৮ শতাংশের ওপরে ভোট পড়েছে। ব্যালট বাক্স থেকে বের করে গণনার সময় দেখেছি কিছু ব্যালটের পেছনে সিল এবং স্বাক্ষর আছে। কিছু ব্যালটের পেছনে সিলমোহর আছে কিন্তু স্বাক্ষর নেই। আবার কিছু দেখেছি সিল স্বাক্ষর কিছুই নেই। নির্বাচনী কর্মকর্তারা ভোট গণনার এক পর্যায়ে স্বাক্ষরবিহীন একটি ব্যালট প্রিজাইডিং অফিসারকে দেখালে তিনি অবৈধ ঘোষণা করেন। পরক্ষণেই একইরকম একগাদা ব্যালট তার হাতে দেয়া হলে তিনি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। ওই সবগুলো ব্যালট ছিল নৌকা মার্কায় দেয়া ভোট। পরে ভোটকেন্দ্রে অবস্থানরত পুলিশের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রিজাইডিং অফিসার ব্যালটে স্বাক্ষরবিহীন ভোট বৈধ হিসেবে গণনার নির্দেশ দেন। এরপর আর ব্যালটে স্বাক্ষর আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা হয়নি।’

আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ ব্যাপারে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আইনত এসব ভোট বাতিল হওয়ার কথা। কিন্তু স্বাক্ষরবিহীন সব ব্যালটকে বৈধ ধরে নিয়েই গণনা হয়েছে ১৮৬ নম্বর কেন্দ্রে।’ ওই কেন্দ্রে নৌকা মার্কা পেয়েছে ১,১৫৬ ভোট, ধানের শীষ পেয়েছে ১৩৩ ভোট। এ কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থীর কোনো এজেন্ট উপস্থিত ছিল না। ভোট গণনা শেষে ফলাফল নির্ধারণ হওয়ার পর প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি মন্তব্য না করেই দ্রুত বেরিয়ে যান।” বিবিসি বলছে, কেন্দ্রের নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে আড়ালে কথা বলে জানা গেছে, ওই কেন্দ্রে ভোটে অনিয়ম হয়েছে। একই ব্যক্তি একাধিকবার ভোট দিয়েছেন, অপ্রাপ্তবয়স্করাও ভোট দিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের লোকজন হুমকি দিয়েছে যে, কথা না শুনলে একজনও বাড়ি ফিরতে পারবে না।’ তার ভাষায়, ‘এরে নির্বাচন কয় না’।

এ নিয়ে বিবিসির সাংবাদিক আরো বলেছেন, ভোটকেন্দ্রগুলো কার্যত নৌকার কর্মীদের টহল এবং নিয়ন্ত্রণে ছিল বলেই মনে হয়েছে। পরিচয় গোপন রেখে কয়েকজন জানান, ‘কিছু কেন্দ্রে দলবেধে ঢুকে ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে ভোট কাটার ঘটনা ঘটেছে। প্রকাশ্যে কোনো দাঙ্গা হাঙামা না বাঁধিয়ে সুকৌশলে কাজ হয়েছে।

ভোট কারচুপির নতুন রূপ
খুলনা সিটির নির্বাচন ছিল এই নগরবাসীর জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা না বাধিয়ে কেবল সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রেখে এবং প্রতিপক্ষকে চেপে ধরে ভোট নেওয়ার এমন দৃশ্য এই নগরের মানুষ আগে দেখেননি। ভোট ডাকাতি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে বাহিরে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ম্যাজিস্ট্রেট ও তাদের টহল সবই ছিল। এর মধ্যেই প্রতিপক্ষের এজেন্ট কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, দল বেধে বুথে ঢুকে ব্যালটে সিল মারা, জাল ভোট দেয়া, বাবার সঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুর ভোট দেয়া, ভোটারদের প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারতে বাধ্য করা, নারী কর্মীরাও কেন্দ্র দখল করে নৌকায় সিল মারে, দুপুরের আগেই ব্যালট শেষ হওয়াসহ নানা ঘটনা ঘটেছে। সব কিছুর পরও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগ কর্মীদের কেন্দ্র দখলে সহযোগিতার ভূমিকাও পালন করেছে পুলিশ। এই নির্বাচনে শুরু থেকেই ইসির দুর্বলতা বেশ স্পষ্ট ছিল। তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন আইনানুযায়ী নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকলেও কমিশন সেভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, চেষ্টাও করেনি। প্রার্থীদের অভিযোগও আমলে আনেনি। বরং অভিযোগ সুনির্দিষ্ট নয় বলে দায় এড়ানোর তথা ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করেছে নির্বাচন কমিশন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সকালে ভোট শুরুর পরপর বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে এজেন্ট বের করে দেয়ার খবর আসতে থাকলেও কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল ভালো। বিক্ষিপ্ত কিছু কেন্দ্র ছাড়া পরিবেশও ভালো ছিল। কিন্তু বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ভোটের পরিবেশ পাল্টাতে থাকে। বিভিন্ন কেন্দ্রে সরকারি দলের কর্মীরা ঢুকে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করে। যেসব কেন্দ্রে এমনটি হয়েছে, তা আধঘণ্টার বেশি স্থায়ী ছিল না। এরপর তারা সটকে পড়ে, সুযোগ বুঝে আবার ফিরে আসে। তারা চলে যাওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সক্রিয় হয়। ততক্ষণে সাধারণ ভোটার আতঙ্কিত হয়ে কেন্দ্র ছাড়েন। এসব ঘটনা সবচেয়ে বেশি চলে ভোটের দিন বেলা সাড়ে ১১ থেকে দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যে। পরিকল্পিতভাবে একই সময়ে মাস্তানরা বিভিন্ন কেন্দ্রে ঢুকে সিল মারে ব্যাপকহারে। সিল মারা ব্যালট বিভিন্ন কেন্দ্রে পড়ে থাকতেও দেখা গেছে। যা পরে সংবাদকর্মীদের ক্যামেরায় ধরা পড়ে। এতে শুধু বিএনপির মেয়রপ্রার্থী নয়, তাদের কাউন্সিলর প্রার্থীরাও হেরে গেছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, প্রায় সব কেন্দ্রের সামনে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের জটলা দেখা যায়। তারা কার্যত কেন্দ্রের প্রবেশমুখ নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ভোটার, পর্যবেক্ষক যে-ই আসুন, তারা নজরদারি করেন। বিএনপি বা ২০ দলীয় জোটের কোনো নেতাকর্মী এলে তাদের কেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দেয়া হয়েছে। হুমকি দেয়া হয়েছে। ফলে প্রাণের ভয়ে অনেকেই কেন্দ্রে ঢোকার সাহসই পাননি। যারা সাহস করে বাধা উপেক্ষা করার চেষ্টা করেছেন তাদের উপর চলেছে হামলা, মারধর ও নির্যাতন।

৫৪ কেন্দ্রে অস্বাভাবিক ভোট
ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অন্তত ৫৪টি কেন্দ্রে অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে। খালিশপুরের নয়াবাঢী হাজী শরীয়ত উল্লাহ (বিদ্যাপীঠ) ভোট কেন্দ্রে ১,৮১৭টি ভোটারের মধ্যে ১,৮১৬টি ভোট পড়েছে। একটি বাদে সবকটি ভোট পড়ার ঘটনায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও ভোট বাতিল হয়নি। এ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক ১,১১৪টি ভোট পেয়েছেন। বিএনপি প্রার্থী পেয়েছেন মাত্র ৩৭৩ ভোট। এ বিষয়ে কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মোড়ল জাকির হোসেন বলেন, ‘সব ভোটার ভোট দিয়েছেন বলেই ৯৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ ভোট পড়েছে।’

একই এলাকার মাওলানা ভাসানী বিদ্যাপীঠ কেন্দ্রে ১,৫০৩ ভোটের মধ্যে ১,৪৬৭ ভোট পড়েছে। যা মোট ভোটারের ৯৭.৬৭ শতাংশ। এ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ৯৯৭টি ও বিএনপি ৩৯০টি ভোট পেয়েছেন। নগরীর নতুনবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ৯১.৩৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। এ কেন্দ্রে ১,৫০৮টি ভোটের মধ্যে ১,৩৭৮টি ভোট পড়েছে। এখানেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী বড় ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন।

গায়েবি ভোটের নয়া মডেল
এক অভূতপূর্ব ভোটের সাক্ষী হলো খুলনা। গায়েবি ভোটের নয়া মডেলও বলা চলে। হানাহানি নেই, রক্তপাত নেই। ভোটের আগে থেকেই নানা গুজব ছিল মুখে মুখে। সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন প্রার্থী এবং ভোটাররা। নির্বাচনের দিন গুজব আর শঙ্কারই বাস্তবচিত্র দেখা গেল ভোটে। দখল আর অনিয়মের কারণে তিন কেন্দ্রে নির্বাচন স্থগিত রাখলেও বাকি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি নির্বাচন কমিশনের।

১৫০ কেন্দ্রে জাল ভোট
নির্বাচনে অন্তত ১৫০ কেন্দ্র দখল করে একতরফা নৌকা প্রতীকে জাল ভোট দেয়ার অভিযোগ মিলেছে। ভোটের দিন বিভিন্ন কেন্দ্রে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১১, ১৫, ২২, ২৫, ২৬, ২৯, ৩০ ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ডসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডের ৪০টি কেন্দ্র থেকে ধানের শীষ প্রতীকের এজেন্টদের বের করে দেয়া হয় বলে জানা গেছে। বিভিন্ন কেন্দ্রে নৌকায় ভোট দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। রাজি না হলে ভোটারদের বের করে দেয়া হয়েছে ভোটকেন্দ্র থেকে। সরকার দলীয় প্রার্থীর সমর্থকরা পুলিশি ছত্রছায়ায় প্রকাশ্যে এসব অপকর্ম করলেও কেউ তাদের বাধা দেয়ার সাহস দেখায়নি বলে প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে ও সরেজমিনে দেখা গেছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে বিএনপি প্রার্থীর গাড়ি আটকে রেখে নৌকার পক্ষে ভোটের দিন স্লোগান দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল।

ঢাকা থেকে যাওয়া একটি জাতীয় পত্রিকার সাংবাদিককে ২৪নং ওয়ার্ড নৌকা প্রার্থীর সমর্থকরা জালভোট দিতে অনুরোধ জানান। নগরীর বসুপাড়ায় নূরানি বহুমুখী মাদ্রাসা কেন্দ্রে নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক দলের একজন সদস্য আওয়ামী লীগের স্থানীয় একজন নেতার হাতে অপদস্থ হন। তিনি বিষয়টি মোবাইল ফোনে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ঘটনাস্থল থেকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার না পেয়ে নিজেই কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যান। তখন পেছন থেকে তাকে একরকম ধাওয়া করা হয়।

প্রায় সব ভোটকেন্দ্রের অনতিদূরে নৌকা প্রতীকের একটি করে অস্থায়ী নির্বাচনী কার্যালয় ছিল। সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৭টার মধ্যে তারা সেখানে অবস্থান নেন। অনেক কেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্টরা সেখানেই প্রথম বাধা পান। অনেকে শারীরিকভাবে আঘাত বা অপমান-অপদস্থ হয়ে সেখান থেকে ফিরে গেছেন। জামিয়া ইসলামিয়া আশরাফুল উলুম বয়স্ক মাদরাসা কেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্র কাউন্সিলর প্রার্থী জামান মোল্লা জেলিনের এজেন্ট আসাদ ও হাবিবকে সকালেই বের করে দেয়া হয়। বেলা ২টা থেকে নৌকা প্রতীকের ব্যাজ পরিহিত ভোটার ছাড়া অন্য কোনো ভোটারকে নগরীর ১১নং ওয়ার্ডের প্লাটিনাম মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। পুলিশ সদস্যরা নিজেরাই কেন্দ্রে ঢুকে একেকজন ৪-৫টি করে ভোট দিয়ে বের হয়ে এসেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

১০নং ওয়ার্ডের বঙ্গবাসী ও মওলানা ভাসানী স্কুল কেন্দ্রটি দুপুরের পর থেকে নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা ধানের শীষের প্রতীকের এজেন্টদের বের করে দিয়ে নৌকা প্রতীকে সিল মারে। নগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের ডি আলী ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র পরিদর্শনের সময় অভিযোগ করেন বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী হাসান মেহেদি রেজভী ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী মাজেদা খাতুন। তারা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সমর্থকরা ব্যালটে সিল মেরে তা বাক্সে ফেলছে। অনেক ভোটার এসে বিমুখ হয়ে ফিরে গেছেন।’

বেলা ১১টার সময় ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের সময় রূপসা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫নং বুথের সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা উজ্বল কুমার পাল একটি কেন্দ্রে জাল ভোট দিতে বাধা দেয়ার পর তাকে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ ৫-৭ জন লোক এসে ব্যালট পেপার কেড়ে নেয়। পরে তারা নৌকায় সিল মারতে গেলে আমি তাতে বাধা দিয়েছি। এমনকি আমি সিল মারা ব্যালট পেপারগুলো বক্সে ভরতে দেইনি। তারা আমার নাম পরিচয় জেনে গেছে। ভোট শেষ হলে দেখে নেবে বলেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমার কাছে থাকা একশ’ ব্যালট পেপার কেড়ে নেয়া হয়েছিল। যার সিরিয়াল নং ০০৪৫৮৪০১ থেকে ০০৪৫৮৫০১ পর্যন্ত।’ এ ঘটনার পর এই কেন্দ্রটিতে ভোটগ্রহণ কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত থাকে। পরে আবারও ভোট গ্রহণ করা হয়। পাশেই আরো একটি কেন্দ্রে জালভোট দেয়ার প্রমাণ পাওয়ার পর সেটিও দুই ঘণ্টার জন্য ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়।

নগরীর ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের হাজী আবদুল মালেক ইসলামিয়া কলেজে জাল ভোট দেয়ার সময় দু’জনকে আটক করে পুলিশ। কিন্তু আটকদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করেনি পুলিশ। সেখানে দায়িত্বরত পুলিশের এসআই বোরহান মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘অসহায়। আপনাদেরই ভাই ব্রাদার। নাম বলে দিলে এখানে অনেক সমস্যা হবে।’ এ সময় নির্বাচনী দায়িত্বরত একজন ম্যাজিস্ট্রেট সেই কেন্দ্রে গেলেও গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি তিনি।

বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে ওই কেন্দ্রে দায়িত্বরত সমন্বয়ক আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘আটকদের ছেড়ে দেয়া হবে। এ জন্যই তাদের তাদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করেনি পুলিশ।’ এদিকে জাল ভোট দেয়ার সময় সোনাডাঙ্গা থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদককে আটক করেছিল পুলিশ। কিন্তু গণমাধ্যম সেখানে পৌঁছার আগেই তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। আবদুল মালেক ইসলামিয়া কলেজ কেন্দ্রের কয়েকটি গেট বন্ধ করে রাখা হয়। যারা ভোট দিতে এসেছেন তাদেরও ফেরত দেয়া হয়েছে ব্যালটের অভাবে।

৩১নং ওয়ার্ডের লবনচরা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টদের পাশাপাশি প্রিজাইডিং অফিসারদেরও বের করে দেয় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের সমর্থকরা। তারা বুথের ভেতরে ঢুকে যখন সিল মারছিল তখন প্রিজাইডিং অফিসাররা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ২০নং ওয়ার্ডে এইচআরএইচ প্রিন্স আগাখান উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে পুলিশের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ সমর্থকরা ভোটারদের বের করে দিয়ে নৌকা মার্কায় সিল মারেন।

৪নং ওয়ার্ডে দেয়ানা উত্তরপাড়া কেন্দ্রে বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ওপর হামলা এবং বিএনপি কর্মী মিশুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ১৯নং ওয়ার্ড ইসলামাবাদ ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্টকে মারধর করে প্রশাসনের সামনেই বের করে দেয় সরকার সমর্থকরা। পাইওনিয়ার স্কুল ভোটকেন্দ্র থেকেও প্রশাসনের সামনেই বের করে দেয়া হয়েছে বিএনপির পোলিং এজেন্টদের। গল্ডামারি লায়ন্স স্কুল ও নিরালয় স্কুল কেন্দ্র থেকে ধানের শীষের এজেন্টকে প্রশাসনের সামনে মারধর করে বের করে দেয়া হয়।

দুপুর দেড়টার দিকে কেএমপির সবচেয়ে নিয়ন্ত্রিত এলাকা ১৪নং ওয়ার্ডের পুলিশ লাইন স্কুল কেন্দ্রে পুলিশ বেষ্টিত অবস্থায় একযোগে প্রকাশ্যে নৌকা ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রতীকে সিল মারতে দেখা যায়। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মাহবুবুর রহমান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘এ কেন্দ্রে প্রতিটি বুথ থেকে একশ’টির মতো ব্যালটে সন্ত্রাসীরা নৌকায় সিল মেরেছে।’

বেলা ৩টার দিকে নগরীর ১৬নং ওয়ার্ডের নূর নগর নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র দখল করে নেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এখানে নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পরেও নৌকা প্রতীকে সিল মারতে দেখা যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। খবর পেয়ে র‌্যাবের একটি টিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে তারা পালিয়ে যায়। এর আগে সকালে এসব কেন্দ্রে কোনো এজেন্টকে ঢুকতে দেয়নি। এমনকি অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্টদের এ কেন্দ্র ছাড়াও আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মন্নুজান স্কুল কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি। সকাল ৯টা থেকে ৯নং ওয়ার্ডের বৈকালী ইউসেফ স্কুল কেন্দ্র দখল করে নেয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এভাবে অন্তত ১৫০টি কেন্দ্রে নয়া মডেলের দখল ও জাল ভোটের মহোৎসব চলে।

কুপিয়ে ও মারধর করে আহত
খালিশপুর থানার ১১নং ওয়ার্ডে জামিয়াহ তৈয়্যেবাহ নূরানী তালিমুল কোরআন মাদরাসা কেন্দ্রে সহোদর সিরাজকে কুপিয়ে আহত এবং আলমকে মারধর করা হয়। তাদের খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এই কেন্দ্রে দুপুর ২টার দিকে নৌকা প্রতীকের লোকজন প্রকাশ্যে সিল মারে। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে বিএনপি প্রার্থীর এজেন্ট ও কর্মী-সমর্থকদের মারধর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কেন্দ্র থেকে কেন্দ্রে জাল ভোটের গ্রুপ
এ এক অন্য রকম ভোট। স্থায়ীভাবে ভোটকেন্দ্র দখল না করলেও নগরীজুড়ে ছিল আতঙ্ক। নগরজুড়ে সব কেন্দ্রেই ছিল সরকারদলীয় প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের লোকজনের আধিপত্য। পুলিশের সহায়তায় কেন্দ্র দখল, একচেটিয়া ভোট আদায় ও সিল মারার কাজে প্রত্যেক কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের আলাদা নির্দিষ্ট করা গ্রুপ তো ছিলই, এমনকি ৩০ থেকে ৪০ জনের একটি গ্রুপ ছিল যারা কেন্দ্র থেকে কেন্দ্র ঘুরে প্রকাশ্যে সিল মেরেছে। ভোটের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এভাবে সিল মারার কাজ চালিয়ে যায় নিশ্চিন্তে। নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সঙ্গে সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক বের হলেই কেন্দ্র দখলে নিয়ে ১০ মিনিটের মধ্যে সিল মেরে বাক্স ভরে সটকে পড়ে তারা।

তারা সকাল ৮টা থাকে ১০টা পর্যন্ত প্রথমে রেকি করে কয়েকটি কেন্দ্রে। বিএনপি সমর্থিত ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুর সমর্থকদের দুর্বল অবস্থান ও সাংবাদিকদের মুভমেন্ট দেখে ১০টার পর শুরু করে জাল ভোট দেয়ার মিশন। ১০টার দিকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক প্রবেশ করেন ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের নূর নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। এ সময় সাংবাদিক ও কিছু পর্যবেক্ষকও প্রবেশ করেন তার সঙ্গে। কেন্দ্র পরিদর্শন করে বের হয়ে এলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সঙ্গে সাংবাদিকরাও বের হয়ে আসেন। এমন সময় নগর যুবলীগ নেতা জাকির ও কানা রানার নেতৃত্বে ৪০ থেকে ৫০ জনের একটি গ্রুপ হঠাৎ প্রবেশ করে ভোটকেন্দ্রের ভেতর। প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইং অফিসার ও ধানের শীষ প্রতীকের এজেন্টদের বের করে দিয়ে শুরু করেন সিল মারা। ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে সামনে থাকা সব ব্যালট পেপারের বান্ডিলে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করে মুহূর্তের মধ্যে কেন্দ্র ত্যাগ করে। খবর পেয়ে মিডিয়া ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আসতে আসতে সটকে পড়ে তারা। চলে যায় পরবর্তী কেন্দ্রে। একইভাবে প্রতিটি কেন্দ্রে তালুকদার আব্দুল খালেক ভেতরে অবস্থানকালে সিল মারা গ্রুপ কেন্দ্রের বাইরে অবস্থান নেয়। খালেক ও সাংবাদিক-পর্যবেক্ষকরা বের হয়ে যাওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যেই একযোগে প্রবেশ করে মুহূর্তেই সামনে থানা সব ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করে সটকে পড়ে।

নারীরাও কেন্দ্র দখল করে সিল মেরেছে
স্থানীয় ভোটাররা বলেছেন, আওয়ামী লীগের নারী কর্মীরা ৩১নং ওয়ার্ডের লবনচরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রটি দখল করে নৌকায় সিল মেরেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা একটার দিকে এই কেন্দ্রের একটি বুথে হঠাৎ কয়েকজন নারী ঢুকে সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তার কাছ থেকে ব্যালট পেপার নিয়ে নেন। পরে তারা মেয়র পদে নৌকা ও কাউন্সিলর পদের পছন্দের প্রার্থীর প্রতীকে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে রেখে চলে যান। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, ‘কয়েকজন মহিলা বুথে ঢুকে বলেন- কেউ কোনো কথা বলবেন না। কিছুক্ষণ পর তারা ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সে ভরে চলে গেছেন।’

পরে ওই কেন্দ্রটির ভোট স্থগিত করা হয়। এটিসহ কেন্দ্র দখল ও ব্যালট ছিনতাই করে সিল মারার অপরাধে মোট চারটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়। এর বাইরে আরও একটি কেন্দ্রের একটি বুথে ভোট স্থগিত হওয়ার পর আবার চালু হয়।

বাবার সঙ্গে ভোট দিল দ্বিতীয় শ্রেণির শিশু
নগরীর ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের নুরানি বহুমুখী মাদ্রাসা কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকে সিল মারার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেখানে স্থানীয় নৌকা-সমর্থিত প্রভাবশালী এক ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষণ দলের এক সদস্যকে অপদস্থ করেছেন। কেন্দ্রটিতে দুপুর ১২টার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, এক ব্যক্তি তার দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বের হচ্ছেন। বাবা-ছেলের দুজনের হাতের আঙুলে ভোট দেওয়ার সময় লাগানো অমোচনীয় কালি দেখে তাদের অনুসরণ করেন সংবাদকর্মীরা। একপর্যায়ে ভোট দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আমার ছেলেও ভোট দিয়েছে।’

দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলেটি বলে, ‘নৌকায় ভোট দিয়েছি। টিপু আঙ্কেলকে ভোট দিয়েছি (আওয়ামী লীগের স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী আলী আকবর টিপু, প্রতীক ঠেলাগাড়ি)।

‘কষ্ট করে ভোট দেয়া লাগবে না, আমরাই দিয়ে দিয়েছি’
খুলনা সিটির ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের রূপসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভোট। এ কেন্দ্রে ভোট দিতে না পারা একজন বয়স্কা হাসিনা বেগম। ভোট দিতে না পারার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ভোট দিতে কেন্দ্রে ঢুকলে আমাকে ধাক্কা মেরে বের করে দিয়েছে কতগুলো ছেলে। ছেলেগুলো বলেছে, আপনি বয়স্ক মানুষ, কষ্ট করে ভোট দেয়া লাগবে না। আমরাই দিয়ে দিয়েছি।’ একই ধরনের অভিযোগ করেছেন ছোরাব শেখসহ আরও অনেক ভোটার।

প্রত্যক্ষদশীরা জানান, তখন সকাল ১০টা। পুলিশি পাহারায় হৈহৈ করে কেন্দ্র ঢুকলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর একদল কর্মী। প্রথমেই তারা কয়েকটি বুথ থেকে বের করে দিলো ভোটার ও অন্যান্য প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের। এরপর প্রিসাইডিং অফিসারের কক্ষ থেকে নিয়ে আসলো বেশ কয়েকটি নতুন ব্যালট বই। চারটি বুথের প্রতিটিতেই দুই-তিনটি করে নতুন ব্যালট বই নিয়ে ঢুকলো তারা। এরপর প্রকাশ্যে চালায় সিল মারার মহোৎসব। দু’চারজন ভোটার নিজেদের ভোট দিতে চাইলে তাদের ধাক্কা মেরে ও ধমক দিয়ে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। এ সময় প্রিসাইডিং অফিসারসহ নির্বাচনী দায়িত্বরত কর্মকর্তারা ছিলেন পুতুলের মতো নিশ্চুপ, নিশ্চল। এভাবেই চলে খুলনা সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের রূপসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দের ভোট। খবর পেয়ে আধাঘণ্টা পর সাংবাদিকরা সেই কেন্দ্রে উপস্থিত হন। কিন্তু এর আগেই কেন্দ্রের মোট ১৩৬০ ভোটের বেশিরভাগই ঢুকে গেছে বাক্সে। প্রতিটি বুথের বাক্সগুলো সাড়ে ১০টার মধ্যেই উপছে পড়ছিল সিলমারা ব্যালটে।

এদিকে সাংবাদিকরা সেখানে ছুটে গেলে কেন্দ্রের গেটে দায়িত্বরত এক পুলিশ সদস্যকে বলতে শোনা গেছে, ‘সিল মারতে এতো সময় লাগে নাকি। সাংবাদিকরা এসে পড়েছে। এ সময় পাশে থেকে এক যুবককে বলতে শোনা যায়, টার্গেট ছিল ১২শ’, আধাঘণ্টা তো লাগবেই।’

অবাধে গাড়ি ও মোটরসাইকেল ব্যবহার
ভোটের দিন নির্বাচনী এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকেরা গাড়ি ও মোটরসাইকেলে নৌকা প্রতীকের স্টিকার লাগিয়ে অবাধে চলাচল করেন। এ ব্যাপারে একজন মোটরসাইকেলচালক ছাড়া পুলিশ বা ভ্রাম্যমাণ আদালত কাউকে শাস্তি বা অর্থদ- করেছে, এমন খবর পাওয়া যায়নি।

ধানের শীষে ভোট দিল কারা?
প্রত্যক্ষদর্শী একটি সূত্র বলছে, ভোটের দিন ৮০টি কেন্দ্র ঘুরে ধানের শীষ ব্যাজধারী বিএনপির অন্তত একজন করে ৮০ জন নেতা বা কর্মীকেও দেখা যায়নি। তাহলে ধানের শীষে ১ লাখ ৯ হাজারের অধিক এই বিপুলসংখ্যক ভোট কারা, কখন দিল? কারণ, লাইনে দাঁড়ানো, ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সময় বা বুথফেরত অধিকাংশ ভোটারের হাতে ছিল নৌকা প্রতীকের ভোটার স্লিপ বা বুকে ছিল ব্যাজ। বিষয়টি খোদ তালুকদার আবদুল খালেককেও ভাবিয়েছে।

বিজয়-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তালুকদার খালেক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভোটের দিন আমাদের কর্মীদের পরিচিতি ছিল, তারা নৌকার ব্যাজ পরে ছিল। কিন্তু আমি সারা দিন বিএনপির প্রতীকের ব্যাজধারী কাউকে কোনো কেন্দ্রে দেখিনি। এত ভোট কোত্থেকে এল!’ তালুকদার খালেক দাবি করেন, ভোট অবাধ, সুষ্ঠু হয়েছে। কেবল কিছু কেন্দ্রে কাউন্সিলর প্রার্থীরা কিছু বিশৃঙ্খলা করেছে। তার দায় তিনি নেবেন না। যদিও মোট যে ভোট পড়েছে, তা হিসাব করে দেখা গেছে, কাউন্সিলরদের ভোটের চেয়ে মেয়র ভোট ৪১১টি বেশি পড়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, কেবল কাউন্সিলর প্রার্থীদের কারও কারও জন্য বুথ দখল বা সিল মারা হলে মেয়র প্রার্থীদের মোট ভোটের সংখ্যা কম হতো।

‘ডাকাতির’ ফল বাতিল করে ফের ভোট চেয়েছেন মঞ্জু
খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ‘ভোট ডাকাতির’ অভিযোগ এনে একশ‘র বেশি কেন্দ্রের ফলাফল বাতিল করে নতুন করে ভোট নেয়ার দাবি জানিয়েছেন পরাজিত বিএনপির মেয়রপ্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু। ১৫ মে সন্ধ্যায় খুলনায় দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি করেন ধানের শীষের প্রার্থী।

‘চমৎকার’ ভোট হয়েছে
খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচন অনেক ‘চমৎকার’ হয়েছে বলে দাবি করেছেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব হেলালুদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ২৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩টি বন্ধ রয়েছে। বাকি ২৮৬টি কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হয়েছে এবং এ ভোট তার দৃষ্টিতে অত্যন্ত ‘চমৎকার’। সৌজন্যে : সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/২০২৪ঘ.)