পাচারের শিকার নারীদের ন্যায়বিচারে পরিবর্তন এনেছে ভিডিও কনফারেন্স

পাচারের শিকার নারীদের ন্যায়বিচারে পরিবর্তন এনেছে ভিডিও কনফারেন্স

ঢাকা, ১৯ জুন (জাস্ট নিউজ) : প্রতি বছর ভাল কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলাদেশ ও নেপালের গ্রাম এলাকার গরিব নারী ও শিশুদের পাচার করে পাচারকারীরা। একবার ভারতে পৌঁছালে তাদেরকে বিক্রি করে দেয়া হয় পতিতাবৃত্তিতে অথবা গৃহকর্মের কাজে।

এশিয়ার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে এমনভাবে পাচারের শিকার ব্যক্তিরা ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন। এক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। এতে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া একজন যুবতীর (অনুরাধা- ছদ্মনাম) কাহিনী তুলে ধরা হয়।

তিনি বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। নিরাপত্তার কারণে তিনি যশোরে তার বাড়ি থেকে বিষয়ের মামলায় সরাসরি সাক্ষ্য দিয়েছেন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। যশোরে একটি সরকারি অফিসে বসে তিনি যখন ভিডিও কনফারেন্সে সাক্ষ্য দিচ্ছিলেন তখন তার অবস্থানস্থল থেকে মুম্বইয়ের দূরত্ব ২০০০ কিলোমিটারের বেশি। সেখানে আদালতে দন্ডায়মান কয়েকজন পুরুষকে দেখানো হলো। ভিডিও কনফারেন্সে তাদেরকে সনাক্ত করলেন অনুরাধা। তিনি এখন যথোরে একটি বিউটি পার্লার চালান। সেখান থেকে তিনি রয়টার্সকে বলেছেন, আমাকে যারা পাচার করেছিল তাদেরকে আমি স্ক্রিনে দেখতে পেয়েছি এবং তাদেরকে সনাক্ত করতে মোটেও ভয় পাই নি। আমি তাদেরকে জেলে দেখতে চাই। ভিডিও কনফারেন্সে আমি তাদের বলেছি শুরুতেই পতিতালয়ে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানানোতে তারা আমাকে কিভাবে প্রহার করেছিল। বলেছি এক সময় বাধ্য হয়ে যখন এই ব্যবসায় নামতে হলো তখন যে টাকা উপার্জন করতাম তা তারা নিয়ে নিতো। এমন ভিডিও কনফারেন্সে সাক্ষ্য নেয়ার মাধ্যমে অভিযোগ গঠন সহজতর হবে বলে আশা প্রকাশ করেন মানবাধিকারকর্মীরা। তারা মনে করেন, এতে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়।

ঢাকা থেকে ভিডিও লিংকে মুম্বইয়ের একটি আদালতে একজন নির্যাতিতা প্রথমবার এভাবে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন ২০১৬ সালে। ওই সাক্ষ্যে এক বাংলাদেশী পাচারকারীর জেল হয়েছে। তবে এ অঞ্চলে আন্তঃসীমান্ত পাচারের ঘটনায় শাস্তি দেয়ার বিষয়টি বিরল। কারণ, ঘটনার শিকার ব্যক্তিকে সাক্ষ্য দিতে হলে তাকে ভারতের আদালতে উপস্থিত হতে হবে। এর অর্থ হলো মামলা চলাকালীন তাকে থাকতে হবে ভারতের কোনো একটি আশ্রয়কেন্দ্রে। ভারতীয় দাতব্য সংস্থা রেসক্যু ফাউন্ডেশনের আইনি পরামর্শক শাইনি পাড়িয়ারা। তিনি বলেন, নির্যাতিত এমন নারীরা সব সময়ই দেশে তাদের পরিবারের কাছে ফিরে যেতে চান। একবার দেশে ফিরে যাওয়ার পর তারা আর কখনো সাক্ষ্য দিতে ভারতে ফিরে আসেন না। এক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে ভিডিও কনফারেন্স ব্যবস্থা অত্যন্ত সহজসাধ্য একটি উপায়। আইনজীবীরা বলছে, বাংলাদেশে চলমান এমন কমপক্ষে ১০ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মামলায় নির্যাতিতরা তাদের বিবৃতি দিয়েছেন। পাচারকারীদের সনাক্ত করেছেন। জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার নামের একটি দাতব্য সংস্থা ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে নির্যাতিতকে ভিডিওতে সাক্ষ্য দেযার ব্যবস্থায় সমর্থন দেয়। এর আদ্রিয়ান ফিলিপস বলেন, ঘটনার মূল হোতারা অনেক সময় আইনের ফাঁক গলিয়ে ছাড় পেয়ে যান। ভিডিও কনফারেন্সে সাক্ষ্য নেয়াতে সেই সম্ভাবনা একেবারে কমে যাবে।

ক্ষমার অযোগ্য মা তারা খোকন মিয়ার ২৭ বছর বয়সী মেয়ে ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করতেন। এক পর্যায়ে তাকে ভারতে পাচার করে একদল পুরুষ। ওই অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে নিজের মেয়েকে প্রস্তুত করছিলেন খোকন মিয়া। তাদের বাড়ি মাগুরা। যথোর থেকে ৫০ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে। একদিন তার মেয়ে কাজ শেষে কিভাবে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন তা বর্ণনা করছিলেন তারা খোকন মিয়া। তিনি বলছিলেন, তার মেয়েকে ভারতে নিয়ে পতিতালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে তাকে এক বছর ধরে ধর্ষণ ও প্রহার করা হয়েছে। এরপরই উদ্ধার করা হয়েছে তাকে। কথাগুলো বলতে বলতে তারা খোকন মিয়ার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে। তিনি বলেন, আমি মেয়েকে তো চিরদিনের মতোই প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম। তাকে যারা পাচার করেছে তাদের কোনো ক্ষমা নেই। আমরা শুধু ন্যায়বিচার চাই। কারণ, মেয়েকে আমি গর্ভে ধরেছিলাম। সে কোথায় আছে এটা জানার পর আমার কি অনুভূতি হয়েছিল তা বর্ণনা করতে পারবো না। এ নিয়ে ২০১৩ সাল থেকে মামলা চলমান। ওই সময়েই তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ফলে মামলা এগিয়ে নিতে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে দাতব্য সংস্থা রাইটস যশোর। তারাই তাকে কাউন্সেলিং করছে। ভিডিও কনফারেন্সে কিভাবে সনাক্ত করতে হবে তার রিহার্সেল করায়। কথা বলার এক ফাঁকে মুখে স্মিত হাসি দেখা যায় তা তারা খোকন মিয়ার। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হলো আদালতে যখন কথা বলে তখন মেয়ের পাশে থাকে তার পিতা। এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার এখন। বাংলাদেশের সঙ্গে পাচারের ঘটনা তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করা নিয়ে ২০১৫ সালে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয় ভারতের সঙ্গে। নেপালের সঙ্গে এমন চুক্তি হয় ২০১৭ সালে। এর আওতায় আদালতে কিভাবে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাক্ষ্য দেয়া যাবে তার মৌলিক প্রক্রিয়াগুলো উল্লেখ করা হয়। যশোর কোর্টের একজন বিচারক কে এম মামুনুজ্জামান বলেন, এই প্রক্রিয়া খুবই স্বচ্ছ। যশোর কোর্ট হাউজের কনফারেন্স হলকে ভিডিও কনফারেন্সের জন্য কোর্টরুমে পরিবর্তন করা হয়। সেখানে বসে নির্যাতিত তার সাক্ষ্য দেন, গোপনীয়তার সঙ্গে। তিনি বলেন, সাধারণত আমি তখন উপস্থিত থাকি। নির্যাতত আস্থার সঙ্গে তার সাক্ষ্য দেন। এ প্রক্রিয়া অনেক সহজ এবং আমাদের জন্য সাশ্রয়ী। এতে সবচেয়ে লাভবান হন নির্যাতিতা।

এ প্রক্রিয়ার ভবিষ্যত বাংলাদেশে ভিডিও কনফারেন্স ব্যবস্থা প্রযুক্তিগত নানা জটিলতায় আটকে আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন থাকা ও দুর্বল কানেকশন। রাইটস যশোরের প্রধান বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, যখন ভারতের আদালতে নির্যাতিতা সাক্ষ্য দেন তখন অনেক সময়ই ইন্টারনেট সংযোগ থাকে দুর্বল। এতে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ২০১০ সালে প্রথম ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যে সাক্ষ্য নেয়া হয় তার প্রথম বিচারপতিদের মধ্যে স্বাতী চৌহান অন্যতম। তিনি মনে করেন, এসব ক্ষেত্রে যে জটিলতা বা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা দূর করতে পারে প্রযুক্তি।

(জাস্ট নিউজ/জেআর/১১১৫ঘ.)