ঢাকা ফোরামের গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্টজনরা

উন্নয়ন কেবল পরিসংখ্যানে, বাস্তবে নেই

উন্নয়ন কেবল পরিসংখ্যানে, বাস্তবে নেই

ঢাকা, ৮ সেপ্টেম্বর (জাস্ট নিউজ) : ‘উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও সুশাসন’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে দেশের বিশিষ্টজনরা বলেছেন, দেশে উন্নয়নের যে কথা বলা হচ্ছে তা বাস্তবসম্মত নয়। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে অগ্রগতি দেখালেও মানুষের ব্যক্তি জীবনে তার প্রভাব পড়েনি। বরং দিনকে দিন ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বেড়েছে। তাছাড়া গণতন্ত্র বাদ দিয়ে শুধু উন্নয়ন হলে তা যেকোন সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে। গণতন্ত্র ও উন্নয়ন দুটিই পাশাপাশি চলতে হবে। টেকসই গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও সুশাসন ফিরিয়ে আনতে আন্দোলনে নামারও পরামর্শ দেন বক্তারা।

দি ঢাকা ফোরামের উদ্যোগে শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও দি ঢাকা ফোরামের চেয়ারম্যান ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সুজন সভাপতি এম. হাফিজ উদ্দিন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও নিউ নেশন সম্পাদক ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন, সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ ড. রাশেদ তিতুমীর, ড. মাহমুদুর রহমান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক ড. ম. ইনামুল হক. ঢাবির সাবেক অধ্যাপক শামসুল হক, ঢাবি সহকারী অধ্যাপক ড. রাফিয়া রহমান, সাংবাদিক আমানুল্লাহ কবীর, অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ফিনান্সিয়াল এক্সসিলেন্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, দি ঢাকা ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সিরাজুল ইসলাম, সাবেক রাষ্ট্রদূত এফ এ শামীম আহমেদ, সাবেক রাষ্ট্রদূত ইফতেখারুল করিম, সাবেক রাষ্ট্রদূত মাসুদ আজিজ, প্রফেসর ডা. এম মাজহারুল হক প্রমুখ।

মূল প্রবন্ধে ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, উন্নয়নকে সুশাসন ও গণতন্ত্র থেকে আলাদা করে দেখা ঠিক নয়। উন্নয়ন ও গণতন্ত্র অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। গণতন্ত্র ছাড়াও বিশ্বের কিছু দেশে উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু সে উন্নয়ন টেকসই ও সমতা ভিত্তিক নয়। সেখানে শুধু বস্তু নির্ভর প্রবৃদ্ধি ও ভোগবাদের প্রসার হয়েছে। মূল্য বোধ, ব্যক্তি স্বাধীনতা এগুলোর প্রাধান্য দেয়া হয়নি। বাংলাদেশ ওই পথে চলুক, আমরা সেটা চাইনা। তিনি বলেন, গণতন্ত্র ও উন্নয়ন দুটিই পাশাপাশি চলতে হবে।

আপনি শুধু উন্নয়ন নিশ্চিত করলেন আর গণতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে গেলেন তাহলে স্থায়ী, টেকসই, সমতাভিত্তিক ও অর্থবহ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। ড. সালেহ আরো বলেন, দেশে উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক বাড়লেও তার সুফল সাধারন মানুষের কাছে পৌছাচ্ছে না। দিন দিন ধনী দরিদ্রের ফারাক বাড়ছে। এই অসম উন্নয়ন গ্রহনযোগ্য নয়।

তিনি বলেন, দেশে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা না থাকলেও অনিশ্চয়তা আছে। কী হবে, না হবে। কী ধরনের সরকার হবে। দেশে সুশাসনের অভাব চলছে, স্বচ্ছতা নেই, জবাবদিহিতা নেই। কেউ অন্যায় করলে শাস্তি হয় না। সবচেয়ে মারাত্মক হল রুল অব ল নেই। আইন আছে কিন্তু বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। রাজনীতির আসল জিনিসটা যে খালি ভোট দিলে হয়ে গেল তা নয়। সুশাসন ছাড়া কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।

তিনি আরো বলেন, দেশে রাজনীতির চর্চা জনগণের স্বার্থে হচ্ছে না। রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সুস্থ রাজনীতি চর্চার অভাব প্রকট। জনগণকে বিভিন্ন বিষয়ে সম্পৃক্ত না করার প্রবণতাও বেশি। এতে জনগণের অনেক সমস্যার সমাধান হয় না। সবচেয়ে বড় বিষয় সমস্যাগুলোর সমাধান না করে বরং তা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয় এবং এর দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানোর প্রবণতা বিদ্যমান।

এম. হাফিজ উদ্দিন বলেন, দেশে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। এক দলের নেত্রী সারাদেশ ঘুরে ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন। আর বিরোধীদলের নেতারা তা করতে পারছেন না। তিনি দেশবাসীকে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য ’৫২, ’৬৯ ও ’৭১ সালের মত আন্দোলন করার আহবান জানিয়ে বলেন, আমরা বাঙ্গালিরা এক সময় খ্বুই প্রতিবাদী ছিলাম। সে সময় শুধু আন্দোলন নয়, সশস্ত্র আন্দোলন হয়েছিল। এখন সেই সাহস গেল কোথায়?

সুজন সভাপতি বলেন, আগে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচন করার বিধান ছিল। এখন আইন করে সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। তারা এখন ইভিএম প্রকল্প হাতে নিয়ে আছে। প্রকল্প পাস হওয়ার আগেই একটি প্রতিষ্ঠানকে ইভিএম কিনতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যারা ইতোমধ্যে এলসিও খুলে ফেলেছে। কাজের অর্ডার পাবার আগেই কিভাবে এলসি খোলা হল তা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, ইসির উচিত সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা। সবাই যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে সে ব্যবস্থা করা। না হলে তাদের চলে যাওয়া উচিত।

তিনি আরো বলেন, দেশের সর্বত্র এখন বিশৃংখলা চলছে। কোনো প্রতিষ্ঠান নিরপেক্ষ ও সৎ নেই। প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচার প্রশাসনসহ একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থার মধ্য দিয়ে সব প্রতিষ্ঠান চলছে। ব্যাংকে চরম নৈরাজ্য চলছে। সবকিছু রাজনৈতিকভাবে দেখা হচ্ছে। চাকরির জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের গিয়ে প্রশ্ন করা হচ্ছে- সে কোন দল করে, কোন দলকে ভোট দেয় ইত্যাদি। উন্নয়নের মহাসড়কে ওঠার দাবি করা হচ্ছে। অথচ সাধারণ মানুষের জীবনমানে কোন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না।

ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন বলেন, ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতা না ছাড়ার নির্বাচন জাতিকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে। মনে রাখতে হবে, অবাধ নির্বাচনের দাবি, জাতীয় দাবি এটা কোনো দল বিশেষের দাবি নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের নির্বাচন সংসদীয় ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত। ভোট চুরির প্রয়োজনে যারা শাসনতন্ত্র ভেঙ্গেছে তাদরেকেই সমাধান দিতে হবে।

আলী ইমাম মজুমদার বলেন, দেশে বিচারহীনতা, দুর্ণীতি ও ভোগের সংস্কৃতি চলছে। মানুষের আয় বৈষম্য বেড়েছে। মধ্যব্ত্তিরা ক্রমান্বয়ে দরিদ্র হচ্ছে। দুর্ণীতির মাধ্যমে সিস্টেম করে জনগণের পকেট কেটে কিছু লোক ও প্রতিষ্ঠানকে বড়লোক করা হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষ ঘুরে দাঁড়াবেই।

আবু আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ মানুষ এখন আর বিশ্বাস করে না। কাগজে কলমে দেশের বিভিন্ন সূচকের উর্ধগতি দেখানো হলেও বাস্তব জীবনে তা দেখা যায় না। জনগণেের টাকা কিছু লোকের পকেটে চলে যাচ্ছে। এসব টাকা অবৈধ পথে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে।

ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, দেশে উন্নয়নের প্রচারণা চলছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কতটুকু উন্নয়ন হয়েছে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। দেশে যে জিডিপি আছে তা মিয়ানমার, পাকিস্তানের চেয়েও কম। তিনি বলেন, জনগণকে বাইরে রেখে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশে সুশাসনের অভাব রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আইনের শাসন নেই, সর্বত্র দুর্নীতি আর দুর্ণীতি। মানুষ কথা বলতে ভয় পায়। প্রশাসন এখন রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছে। এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না।

ড. রাশেদ তিতুমীর বলেন, দেশে যে উন্নয়নের প্রচার করা হচ্ছে তা টেকসই নয়। আমরা ভাঙ্গা সেতুর উপর দাঁড়িয়ে আছি। এ সেতু যেকোন সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে।

ড. ম. ইনামুল হক বলেন, উন্নয়ন নিয়ে অনেক ঢাকঢোল পেটানো হচ্ছে। কিন্তু দূষন নিয়ে কোন কথা নেই। বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় দ্বিগুন-তিনগুন বাড়ছে। মানুষের ঘাড়ে ঋণের বোঝা বাড়ছে। ব্যাংকে লুটপাট চলছে। কোথাও সুশাসন নেই। তিনি বলেন, যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য এত আন্দোলন এক মুহূর্তে তা উড়িয়ে দেয়া হল। জনগণের মত না নিয়ে বাদ দিয়ে দেয়া হল। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যে ক্ষমতা পায় তিনি আর ছাড়েননা। আসলে তিনি নিজেই ক্ষমতা ছাড়তে চাচ্ছেন না।

(জাস্ট নিউজ/একে/২০১৭ঘ.)