সুবিচার পেলেন না প্রধান বিচারপতি

সুবিচার পেলেন না প্রধান বিচারপতি

মাসুদ আহমদ তালুকদার

সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ১৯৯৯ সালের ২৪ অক্টোবর হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁকে স্থায়ী বিচারপতি করা হয় ২০০১ সালে। ২০০৯ সালে হলেন আপিল বিভাগের বিচারপতি। ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি সিনহা বাংলাদেশের সর্বপ্রথম অমুসলিম প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। তাঁর ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সুস্থ প্রধান বিচারপতি হঠাৎ সরকারি ইচ্ছায় ‘অসুস্থ’ হলেন। নানা নাটকীয়তার মধ্যে গত ২ অক্টোবর ৩০ দিনের ছুটিতে যেতে হয় তাকে। রাষ্ট্রপতির দফতর ১২ অক্টোবর এ ব্যাপারে ছুটির গেজেট প্রকাশ করেছে। ১৩ অক্টোবর বাধ্য হয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যান প্রধান বিচারপতি ১০ নভেম্বর ছুটি শেষে মি. সিনহার দেশে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু তিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে কানাডা চলে গেলেন। কানাডা যাওয়ার আগে পদত্যাগ করেছেন। রাষ্ট্রপতির প্রেস সেক্রেটারি তাঁর পদত্যাগপত্রে প্রাপ্তি স্বীকার করেছেন। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে তিনি বলেছিলেন, তিনি সুস্থ। আবার স্বপদে বলেছিলেন। তার আর কর্মে ফেরা হলো না। দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতির কর্মজীবনের এভাবেই ইতি ঘটানো হলো। ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোট কর্তৃক তাঁর সম্পর্কে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। এতে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির ১১টি অভিযোগ আনা হয়েছে। যথা দুর্নীতি, অর্থপাচার, আর্থিক অনিয়ম এবং নৈতিক স্থলন। তিনি বহুন আলোচিত হলেন রায়ের কারণে। সরকার অতীতে বরাবরই মি. সিনহার প্রতি আস্থা রেখেছে। সাংবাদিক স্বদেশ রায়ের শাস্তি, তিন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দণ্ডাদেশ এবং সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এবং সাংবাদিক অলিউল্লা নোমানকে সাজা দেয়াসহ অনেক রায় তিনি দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও হঠাৎ সরকারের অপচ্ছন্দের মানুষে পরিণত হলেন সিনহা। এরই ফলে অসময়, অকল্পনীয়ভাবে বিদায় নিতে হলো তাকে।

বেশ কিছু দিন ধরে মি. সিনহার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল না বলা চলে। সরকার তার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ বলেই দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলো। আপিল বিভাগের বিচারপতিরা মি. সিনহার সঙ্গে বিচার আসনে বসতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। তারা সরকারের আনীত সব অভিযোগ বিশ্বাস করলেন। সরকার যার প্রতি অখুশি দুর্নীতির অভিযোগে তার বিদায়। বিচারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কাউকে দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করা সরকারের নতুন কৌশল হিসেবে জনগণ দেখছে। সরকারের ইচ্ছা মাফিক এর ব্যবহারে ইতিমধ্যে সরকার ‘সুফল’ও পেয়েছে। কথা আছে ‘বিচার ব্যবস্থা যে দেশে যত স্বচ্ছ আর স্বাধীন, সে দেশ তত গণতান্ত্রিক’। বিচারব্যবস্থার বর্তমান হাল দেখলে আমরা কেমন গণতান্ত্রিক দেশে আছি, তা সহজেই বোঝা যায়। সবাই শঙ্কিত- আমাদের দেশে ভবিষ্যতে কি সরকার প্রদত্ত সীমারেখা মধ্যে থেকেই বিচার করতে হবে, নাকি প্রকৃত অর্থে বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন হবে কোনো দিন?

এস কে সিনহার জীবনে যা ঘটেছে তা এর আগে আরো অনেক প্রধান বিচারপতির জীবনেই ঘটেছে। বয়স কমিয়ে প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেনকে সরিয়ে দেয়া হয়। এএসএম সায়েমকে পদত্যাগ করানো হয়। জ্যেষ্ঠতা উপেক্ষিত হওয়ায় পদত্যাগ করেন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান। এর আগে তাকে ডিঙ্গিয়ে বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো: রুহুল আমিন ও মো: ফজলুল করিমকে বাদ দিয়ে কে এম হাসান এবং জে আর মোদাসসিরকে নিয়োগ দেয়া হয় প্রধান বিচারপতি হিসেবে। রুহুল আমিনকে নিয়োগ দেয়া হয় ফজলুল করিমকে বাদ দিয়ে। এভাবে তাফাজ্জল ইসলামকে নিয়োগ দেয়া হলো ফজলুল করিমকে বাদ দিয়ে। এ বি এম খায়রুল হককেও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হলো বিচারপতি এম এ মতিন ও বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে ডিঙিয়ে। সিনিয়র বিচারপতিকে বাদ দেয়া বা জুনিয়র বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে এস কে সিনহাকে যেভাবে অপমান করে বিদায় দেয়া হয়েছে, সেরকম দুর্ভাগ্য অতীতে অন্য কেউ বরণ করেননি। ঘটনাটি দীর্ঘ দিন এ দেশের মানুষের স্মৃতিতে অম্লান থাকার মতো।

এস কে সিনহার সাথে আমার দীর্ঘ দিনের পরিচয়। আমরা ক’জন বন্ধু আসামি হয়ে তার আদালতে হাজির হয়েছি। সম্মানজনক বিচারিক ব্যবহার পেয়ে মুগ্ধ হয়েছি। বহু গুণে গুণান্বিত মি. সিনহা। একদিনের কথা। আমি তখন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি। মি. সিনহা বিচারকদের এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি। আমিও সেখানে অতিথি ছিলাম। বক্তব্য দেয়ার জন্য আমাকে ১৫ মিনিট সময় দেয়া হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতি তখন পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। গল্প দিয়ে বক্তব্য শেষ করি। একজন মানুষ বিপদগ্রস্ত। তার টাকার দরকার। সবার কাছে সাহায্য চায়। কেউ তাকে সাহায্য করেনি। নিরুপায় লোকটি বায়তুল মোকাররম মসজিদের গেটে মুসল্লিদের কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতেন। সাহায্য পাওয়া যায় খুবই সামান্য। ভারাক্রান্ত মনে বাড়ি ফিরছিলেন হেঁটে। এক সময়ে ঢাকা ক্লাবের সামনে হাজির হন। একটি গাড়ি বের হতে দেখে হাত পাতলেন। গাড়ি থেকে ৫০০ টাকার একটি নোট দেয়া হলো। লোকটি সেখানে দাঁড়িয়ে গেলেন। গাড়ি বের হলেই হাত পাতেন। দুই, চার, পাঁচ হাজার করে সবাই তাকে টাকা দিতে থাকেন। প্রয়োজনের অধিক টাকা তিনি পেয়ে গেলেন। লোকটি বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়ে মনের আনন্দে বলতে থাকলেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি কত কিছু না মানুষকে দেখাও, তুমি থাকো কোথায়, আর ঠিকানা দাও কোথায়।’ লোকটির বিশ্বাস ছিল, আল্লাহ বায়তুল মোকররম মসজিদে থাকেন। ওই লোক আল্লাহকে মসজিদে পাননি। পেয়েছেন ঢাকা ক্লাবে! বিচার প্রার্থী মানুষ যেন আদালতে বিচার পায়। অন্য কোথাও যেন বিচার খুঁজতে না হয়। আমার গল্প বলার উদ্দেশ্য ছিল সেটাই। মি. সিনহা আমার গল্পের উত্তরে বলেছিলেন মানুষ বিচার আদালতেই পাবে। অন্য কোথাও যেতে হবে না বিচার খুঁজতে। তার কথায় সেদিন কোনোক্রমেই আস্থা আনতে পারিনি। অনেকের মতে, বর্তমানে বিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণ আর সপক্ষের পরিত্রাণের নাম ‘আইনের শাসন’। প্রধান বিচারপতি বিচার পেলেন না। আইনের শাসন এর চেয়ে বড় অমর্যাদা আর কী হতে পারে?

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনে মাত্র ৮%-১০% ভোট পেয়ে সরকার গঠন করা হয়। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। ১৫৪ জন সংসদ সদস্য ‘নির্বাচিত’ হন বিনা ভোটে। গত চার বছর সে সরকার দেশ চালাচ্ছে। সরকার রাজনীতিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার রাজনীতি আর অরাজনৈতিক নেতাদের নিয়ন্ত্রণ করতে আইন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহারে অধিক মনোযোগী।

তখন বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি চলছে। হাজার হাজার মিথ্যা মামলা দেয়া হলো বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। লাখ লাখ আসামি করা হয়। আসামির তালিকা থেকে বেগম খালেদা জিয়াকেও বাদ দেয়া হয়নি। প্রধান বিচারপতি সিনহা তখন সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত ভূমিকা পালন করেছেন। সব আদালতের ওপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। সরকারের ইচ্ছা বাস্তবায়নে মি. সিনহা সর্বতোভাবে সহায়তা করেছেন। র‌্যাব-পুলিশ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করেছে। একটি অপরাধের মামলায় ৪-৫ রকমের অপরাধের উল্লেখ করা হয়েছে। একই মামলায় ৪-৫টি চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। পুলিশ রিমান্ড চেয়েছে। কোনো আইনের তোয়াক্কা না করেই চাহিদা মোতাবেক রিমান্ড মঞ্জুর করা হতো। রিমান্ডের ক্ষেত্রে নবীন-প্রবীণ কোনো নেতাকেই বাদ দেয়া হয়নি। রিমান্ডে অনেকে জীবন হারিয়েছেন। কারও কারও অঙ্গ হানি হয়ে গেছেন। কেউ পঙ্গু হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়াকে পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৮-১০টি মামলায় হাজিরা দিতে হয় বিভিন্ন আদালতে।

বিচারব্যবস্থার ওপর অগাধ নিয়ন্ত্রণ রেখে সরকার দেশ চালাচ্ছে। তখন প্রায় সব আদালতে আইনী প্রতিকার দুরূহ ছিল। ঠিক এমন সময় ৩ আগস্ট প্রকাশ করা হলো সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়। সরকার সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে সাথে সাথে যেন এক ধরনের যুদ্ধ ঘোষণা করে। ‘দুর্নীতিবাজ’ আখ্যা দিয়ে অসময় প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হল। অপমান-অপদস্ত করে দেশছাড়া করা হলো। মি. সিনহা প্রায়ই বলতেন, সরকার নিম্ন আদালতকে নগ্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। এখন উচ্চ আদালতকে নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। সে কথাই সত্য প্রমাণিত হলো।

স্পষ্ট কথা বলার অনেক সুনাম ছিল মি. সিনহার। আমার মনে হয়, অতি কথন তার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য অনেকাংশে দায়ী। তিনি রাজনীতিবিদদের মতো কথা বলতেন। তার কথায় রাজনীতিবিদদের মনে ভয় ধরতে শুরু করেছিলো। তার পরে যা ঘটার তা ঘটে গেল।

সুরেন্দ্র সিনহা ষোড়শ সংশোধন বাতিলের রায়ে যা উল্লেখ করেছেন, তার চেয়ে আরো অনেক বেশি কিছু লিখলেও হয়তো তার জীবনে দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটত না। বিপত্তি ঘটেছে রায়ে শহীদ জিয়ার প্রবর্তিত এবং ইতিপূর্বে বিলুপ্ত করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত করায়, স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়াকে সমালোচনা না করায়, আর বর্তমান সংসদকে অকার্যকর বলায়। অতীতের মতো রায়ে যদি এই সরকারকে বাদ দিয়ে শুধু বিরোধী দল, শহীদ জিয়া, বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকে সরকারের মতো ঢালাওভাবে সমালোচনা করতেন ষোড়শ সংশোধীতে, তাহলে যা ঘটেছে হয়তো তা ঘটত না। এ মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে দারুণ বিচারিক সঙ্কট চলছে।

সিনহাকে ছুটিতে পাঠিয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ মতে। যখন ৯৬ অনুচ্ছেদের (৪) উপ-অনুচ্ছেদ মতে পদত্যাগ করা গৃহীত হয়. তারপর আর ৯৭ অনুচ্ছেদে ‘ভারপ্রাপ্ত’তে বসে না থেকে সংবিধানের ৯৫(১) মতে একজন নিয়মিত প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা বাধ্যতামূলক। তা না হলে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারকদের শপথ পড়ানোর বিষয়ে আরেকটি সঙ্কট তৈরি হবে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিজেই শপথ পড়েননি। কাউকে তিনি শপথ পড়াতেও পারবেন না যতক্ষণ নিজেও শপথ না পড়েন। আইনমন্ত্রীর ব্যাখ্যা এ ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসবেন না। কারণ সংবিধানের প্রতিষ্ঠিত নীতিকে অনুসরণ করতে হবে।

এস কে সিনহা বিদেশে যাওয়ার পর আপিল বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি এম এ ওয়াহহাব মিয়া সুপ্রিম কোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হয়েছেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের অংশীদার হলেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের সব বিচারপতি। তাদের কেউই বিদায়ী প্রধান বিচারপতির সাথে অবজারভেশন বা রায়ে কোনোরূপ দ্বিমত পোষণ করেননি। অথচ যে রায়ের কারণে সিনহাকে দেশ ছাড়তে হলো, অন্য সব বিচারপতি সে রায়ের কারণে সরকারের আস্থাভাজন হয়ে গেলেন।

বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন; আমাদের সংবিধানে সে কথা লেখা আছে। নিম্ন আদালত সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অধীনস্থ থাকার কথা। দেরি করে হলেও মি. সিনহা বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার কাজটি সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন। বিষয়টি যখন তিনি অনুধাবন করলেন, তখন তাকে আর সময় দেয়া হলো না। কথায় আছে ‘সময় নাকি কাউকে সময় দেয় না’। মি. সিনহার জীবনে সময় না দেয়ার বিষয়টি নিদারুণ নির্মম হয়ে ধরা দিলো। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির ১১টি অভিযোগ আনা হলো। অথচ কেউ অভিযোগ করেননি এবং কোনো অনুসন্ধান হয়নি। কেউ মামলা করেননি। তদন্ত হলো না কোনো অভিযোগের। বিচার শুরু হলো না। অথচ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতিকে ‘দুর্নীতিবাজ’ বানিয়ে দেয়া হলো। সে কারণেই আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিরা সিনহার সাথে এজলাসে বসে বিচারকার্য পরিচালনায় অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। তিনি দুর্নীতিবাজ হলে সে কথা তার সহকর্মী বিচারপতিরা কিছু দিন আগে পর্যন্ত বুঝতে পারলেন না কেন? সরকারের কোনো এজেন্সি মি. সিনহাকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেয়ার আগে সরকারকে জানাল না তিনি দুর্নীতিবাজ।

এখন মানুষের প্রচার করা হচ্ছে মি. সিনহা দুর্নীতিবাজ। তাহলে কি সরকার তা জেনেই তাকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছিল? ধরে নিতে হয়, সরকার একজন দুর্নীতিবাজকে যত সহজে প্রতিপক্ষ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করতে পারবে বলে মনে করছে, সৎ ব্যক্তিকে দিয়ে তা তত সহজে করাতে পারবে না। তবে সিনহা সৎ বলে হয়তো শেষের দিকে সরকার তাকে ম্যানেজ করতে পারছিল না। আর সে কারণেই তাকে ‘দুর্নীতিবাজ’ আখ্যা দিলো। কোনটি যে সঠিক তা নির্ণয়ের সময় ও সুযোগ পর্যন্ত দেয়া হলো না। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় প্রকাশের পর সরকার এবং সিনহার সহকর্মীরাসহ সবাই জেনে গেলেন মি. সিনহা ‘দুর্নীতিবাজ!’ কী বিচিত্র এদেশ। রায় সরকারের পক্ষে গেল না বলে তাকে দুর্নীতিবাজ বানানো হলো। সারাজীবন যিনি বিচার করলেন, তিনি নিজে বিচার পেলেন না। বিচার ছাড়াই দুর্নীতিবাজ সাব্যস্ত হয়ে গেলেন। আশঙ্কা করছি, ভবিষ্যতে এমন আরো অনেক ঘটনা ঘটতে পারে।

২০০৭ এর ১/১১ এর সময় একজন রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করানো হলো। সাংবিধানিক কেয়ারটেকার সরকার বাদ দিয়ে অসাংবিধানিক কেয়ার টেকার সরকার নিয়োগ দেয়া হলো। ২০১৪ সালে ১০ম সংসদ নির্বাচনের আগে একজন সুস্থ সাবেক রাষ্ট্রপতিকে অসুস্থ বানানো হলো। মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেয়ার পরও তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হলো। ২০১৭ সালে দেশের কর্মরত প্রধান বিচারপতিকে বলপূর্বক ছুটিতে পাঠানো হলো। দেশ ছাড়া এবং পদত্যাগে বাধ্য করা হলো। শুধু কারসাজি আর কারসাজি। বিচারব্যবস্থা এখন আবার পুরোটা সরকারের হাতের মুঠায় চলে এসেছে বলে আশংকা হয়। সামরিক স্বৈরাচারের আমলে নাকি বিচারকেরা স্বাধীনভাবে বিচার কাজ করতে পারেন না। এখন দেখা যাচ্ছে পরিস্থিতি আরো খারাপ। একটা জুডিশিয়াল ‘ক্যু’ হয়ে গেল মি. সিনহার বিদায়ের মাধ্যমে। তায় যতটা না দুশ্চিন্তার কারণ, তার চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তার বিষয় হলো শিয়াল যে ভাঙা বেড়া চিনে গেল, ভবিষ্যতে তার কী হবে?

পরিশেষে বলতে হয়ে, সিনহা হয়তো কখনো ভাবেননি তার প্রিয় অনির্বাচিত সরকার যাকে তিনি নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবেসে ছিলেন, সেই সরকার তাকে বিচারকার্য, এমনকি দেশ থেকে এমনভাবে অপমান করে বিদায় করে দেবে। যে যা করে তা-ই নাকি তার জীবনে প্রতিদান হয়ে ফিরে আসে। গণতন্ত্র আজ নির্বাসনে। মানবাধিকার সম্পূর্ণরূপে পদদলিত। বিচারব্যবস্থা পরাধীন।

বিরোধী রাজনীতি, শক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। মুক্ত চিন্তা আর মানুষের বিশ্বাসকে হত্যা করা হয়েছে। বাকস্বাধীনতা শৃঙ্খলিত। একে একে জীবন থেকে সব নিয়মনীতি হারিয়ে যাচ্ছে। কারো কোনো কিছুতে কোনো অনুশোচনা নেই। ভুল আর অন্যায় করার অশুভ প্রতিযোগিতা চলছে। বিদায়ী প্রধান বিচারপতি সব কিছু ভুলে গেলেও তার জীবনে ঘটে যাওয়া ভুল ঘটনাকে কোনো দিনই হয়তো ভুলতে পারবেন না। অপেক্ষায় থাকা ছাড়া আমাদের আর কী-বা করার আছে? স্বাগত জানানোর অপেক্ষায় রইলাম পরবর্তী প্রধান বিচারপতিকে।

লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সভাপতি (সাবেক) ঢাকা, বার অ্যাসোসিয়েশন