অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান

এক-এগারোর হিংস্রতার শিকার তারেক রহমান

এক-এগারোর হিংস্রতার শিকার তারেক রহমান

ঢাকা, ৭ মার্চ (জাস্ট নিউজ) : তারেক রহমান বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতিতে একটি উচ্চকিত নাম। শহীদ জিয়ার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে যিনি দেশব্যাপী সমধিক সমাদৃত। দেশের প্রত্যান্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহর-বন্দর-নগর সর্বত্র জাতীয়তাবাদের চেতনায় বিশ্বাসী প্রতিটি নাগরিকই তারেক রহমানের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন তাদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। কেবল রক্তের উত্তরাধিকারী হিসেবে নয়- তারেক রহমান তার আপন যোগ্যতায়, স্বমহিমায় ঠাঁই করে নিয়েছেন ধর্ম-বর্ণ-জাতি-শ্রেণি-বিশ্বাস নির্বিশেষে সব জনতার হৃদয়ের মণিকোঠায়।

তারেক রহমানের রয়েছে বিস্ময়কর জনপ্রিয়তা, জনগণকে আপন করে কাছে টেনে নেয়ার জাদুকরী-ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব, সম্মোহন ব্যবহার ও মার্জিত আচরণ বোধ। আর এই গুণাবলিই তার বিপরীত রাজনৈতিক শিবিরকে ভাবিয়ে তুলেছে। তারা পরম হিংসাকাতর হয়ে পড়েছে। তাদের ভয় তারেক রহমানকে যদি অঙ্কুরেই বিনাশ করে দেয়া না হয় তাহলে তাদের রাজনীতি মাঠে মারা যেতে বাধ্য। তাই তো তারা তারেক রহমানের রাজনৈতিক উত্থানকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার পরিবর্তে যে করেই হোক তার রাজনৈতিক উত্থানকে ঠেকানোর জন্য, তাকে চিরতরে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে। এ লক্ষ্য অর্জনে তারা শক্তি প্রয়োগ করে, অপপ্রচারের প্রোপাগান্ডা চালিয়ে তারেক রহমানের স্বচ্ছ ইমেজে কালিমা লেপনের হীনকর্মে মেতে ওঠে। তারা দেশে-বিদেশে তারেক রহমানকে একজন দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, অর্থপাচারকারী ও হত্যাকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সর্বোচ্চ মাত্রার প্রয়াস চালায় এবং অনেকাংশে তারা সফলও হয়।

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের ভোট বিপস্নবের নেপথ্য কারিগর হিসেবে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন তারেক রহমান। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলেও তারেক রহমান সরকারে যোগ না দিয়ে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হন। তার নেতৃত্বে দলীয় কর্মকাণ্ডের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই নিজেকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পাদপ্রদীপে নিয়ে আসতে সক্ষম হন তিনি। তার এই অভিনব রাজনৈতিক উত্থানে বিরোধী শিবির অন্তরজ্বালা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। তারা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অপবাদ প্রচারণায় মেতে ওঠে। কিছু কিছু মহল থেকেও তার শিক্ষা-দীক্ষা, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে পত্র-পত্রিকায় নেতিবাচক মন্তব্য শুরু হয়।

দেশের অনেক গুণীজনদের মধ্যেও তার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হতে থাকে। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় সিনিয়র শিক্ষকও তার সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করলে তিনি ২০০৪ সালে তাদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন। দীর্ঘক্ষণ প্রাণবন্ত আলোচনা শেষে তারা যখন বেরিয়ে আসেন তখন সাংবাদিকদের সম্মুখে অকপটে স্বীকার করেন যে, তারেক রহমান সম্পর্কে তাদের মধ্যে এতদিন যে ভ্রান্ত ধারণা ছিল আজ তার অবসান হলো। সত্যিকারার্থে রাজনীতিতে তারেক রহমানের যাত্রা অল্প সময়ের হলেও তিনি একজন পরিণত, বিচক্ষণ, কৌশলী ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিক। বাবার মতোই রয়েছে তার অসাধারণ দেশপ্রেম। তবে এ দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের ভয়ও অনেক বেশি। কারণ আজ হোক কিংবা কাল হোক এদের চরম হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনকি মৃত্যুর মুখোমুখী হয়ে তা নিঃসঙ্কোচ চিত্তে আলিঙ্গন করতে হয়।

দেশপ্রেমিক সিরাজ-উদ-দৌলা, টিপু সুলতান, তিতুমীর, ক্ষুদিরাম বসু, ভগাৎ সিংকে জীবন দিতে হয়েছে। জীবন দিতে হয়েছে জিয়াউর রহমানকে। আর তারেক রহমানের দেশপ্রেম, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান, অন্যের সেবাদাসে পরিণত না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে শুরু হয় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। আর এই ষড়যন্ত্রেরই ফসল হলো মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন এক-এগারোর হায়েনা সরকার। কায়েমি স্বার্থবাদী বিদেশি প্রভু ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের আশীর্বাদপুষ্ট এক-এগারোর সেনা সমর্থিত সাংবিধানিকভাবে অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নৃশংস প্রতিহিংসার শিকার হন তারেক রহমান।

কোনো প্রকার মামলা ছাড়াই ২০০৭-এর ৭ মার্চ রাতে তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করে যৌথবাহিনী। গ্রেপ্তারের ১৬ ঘণ্টা পর গুলশান থানায় এক কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে ব্যবসায়ী আমিন আহমেদ চৌধুরীর দায়ের করা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের জন্য আদালতে আবেদন করলে আদালত কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। পর্যায়ক্রমে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা দায়েরের পাশাপাশি ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ডিটেনশনও দেয়া হয়।

এভাবে ৬ দফায় ১৩ দিন রিমান্ডে নিয়ে তার ওপর অমানবিক শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি মানসিক নির্যাতনও চালানো হয়। চাপ প্রয়োগ করা হয় তাকে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। আর রাজনীতি না করার জন্য। কিন্তু তিনি দেশের কথা, দেশের জনগণের কথা ভেবে তাদের কোনো প্রস্তাবেই রাজি হননি। ২০০৭-এর ২৮ নভেম্বর আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারকের অনুমতি নিয়ে তারেক রহমান তার ওপর অমানবিক নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরেন।

তিনি আদালতকে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে চোখ বেঁধে (২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টা) আমাকে নিগৃহীত করা হয়েছে। আমি একজন রাজনীতিবিদ। কোনো সন্ত্রাসী নই। এর আগে আমার চিকিৎসার জন্য আদালত নির্দেশ দিলেও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এবার রিমান্ডে নিলে আমি আর বাঁচবো না। আমি রিমান্ডে শারীরিকভাবে এতটাই নির্যাতনের শিকার হয়েছি যে, এখন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারছি না। চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে আমাকে ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকিও দেয়া হয়েছে।

আদালতে তারেক রহমান আরও বলেন, ২৪ ঘণ্টা মোটা কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে নির্জন স্থানে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে আমাকে। তার এই বক্তব্যে কেবল শুধু আইনজীবীরাই নন, আদালতে উপস্থিত সবাই বিচলিত ও বিষণ্ন হয়ে পড়েন। বিবেকবান মানুষ ফেটে পড়েন শোকে-দুঃখে আর ক্ষোভে। এভাবে সরকারের হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন এবং যথোপযুক্ত সময়ে সঠিক চিকিৎসা না হওয়ায় তারেক রহমানের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকলে ২০০৮-এর ৩১ জানুয়ারি তাকে পিজি হাসপাতালের প্রিজন সেলে নিয়ে ভর্তি করা হয়।

এরপর আদালতে চিকিৎসকদের দেয়া মেডিকেল রিপোর্টে বলা হয়, তারেক রহমানের স্পেশালাইজড অর্থোপেডিক ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন হবে। নির্যাতনে তার মেরম্নদণ্ডের ৬ ও ৭নং হাড় ভেঙে গেছে, কয়েকটি বেঁকে গেছে, মেরম্নদণ্ডের ৩৩টি হাড়ের দূরত্ব কমে গেছে। চোখে, হৃদযন্ত্রে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। পরে তারেক রহমানের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে পর্যায়ক্রমে তিনটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়।

ফ্যাসিস্ট সরকারের সব ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে প্রতিটি মেডিকেল বোর্ডই দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য তারেক রহমানকে বিদেশের অর্থোপেডিক, ফিজিওথেরাপি, কার্ডিওলজি ও রেডিওগ্রাফির সুবিধা সংবলিত যে কোনো হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেয়া হয়। এরপর তার স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হতে থাকলে তার নিঃশর্ত মুক্তি লাভ ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিতে রাজপথে শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। টনক নড়ে ফ্যাসিবাদী সরকারের।

তারা তারেক রহমানকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিতে রাজি হয়। কিন্তু আত্মপ্রত্যয়ী ও নির্ভীক তারেক রহমান নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে অনড় থাকে এবং একপর্যায়ে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান উন্নত চিকিৎসার জন্য। বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পান ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর।

বিদেশে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায়ও তারেক রহমান এ দেশের জনগণ, তাদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে প্রতিনিয়ত খোঁজ-খবর রাখেন। রাজনীতিতে আসারও আগে থেকে তারেক রহমান জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন এবং এখনো আছেন। বর্তমান সরকারের আমলে গুম-হত্যার শিকার ৭৫০টি পরিবারকে তিনি জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। এ ছাড়া দলীয় অনেক নেতাকর্মী এবং গরিব-অসহায় মানুষের নানান সমস্যায় তিনি নীরবে-নিভৃতে সাহায্য-সহযোগিতা করে যাচ্ছেন যা তিনি কোনো মিডিয়ায় প্রকাশ করেননি।

জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সবচেয়ে সম্ভাবনাময় নেতা তারেক রহমানের মাথার ওপর অনেক মামলার খড়গ ঝুলছে। এক-এগারোর অবৈধ সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে একে একে ১৩টি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু তারেক রহমানের ওপর অমানবিক নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে তাকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েও একটি মামলায়ও তারা দোষী সাব্যস্ত করতে পারেনি।

বর্তমান সরকার তাদের কারিগরদের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলতে থাকে। তাদের কাছেও তারেক আতঙ্কের অবসান ঘটেনি। তাকে আরও নতুন মামলায় জড়ানো হয়। প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে তাকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য একে একে তার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ডজনে ডজনে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। এর একমাত্র কারণ রাজনীতির অঙ্গন থেকে তারেক রহমানকে দূরে রাখা। ভয় একটাই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলে অপরাজনীতি কঠিন হয়ে পড়বেই।

এরই অংশ হিসেবে ২১ জুলাই ২০১৬ আপিল বিভাগ মানি লন্ডারিং মামলায় তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড ও ২০ কোটি টাকা জরিমানা করেন। পরে এ বছর ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির এক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলায় তারেক রহমানকে ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার টাকা সমপরিমাণ জরিমানা ধার্য করে ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসার মাঠে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. আক্তারম্নজ্জামান এক ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেন। এই রায়ে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ উল্লাস প্রকাশ করে।

তাদের মনে রাখা দরকার শেখ মুজিবুর রহমানও বছরের পর বছর জেল খেটেছিলেন, আদালত কর্তৃক কারাদণ্ড প্রাপ্ত হয়েছিলেন কিন্তু তাতে তিনি রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিতাড়িত হননি বরং তার জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস তারেক রহমানের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটনারই প্রতিফলন ঘটবে। তবে তারেক রহমানের ভক্ত-অনুরক্তরা মনে করেন তাকে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করার জন্যই এই মামলায় সাজা প্রদান করা হয়েছে। তারা এও বিশ্বাস করেন তিনি এর জন্য কতটা দায়ী, সেটা একদিন ইতিহাসই বলে দেবে। তবে তার ভক্ত-অনুরক্তরা ৭ মার্চ তার কারাবন্দি দিবস পালন করে থাকে। আজকের এই কারাবন্দি দিবসে তার যারা কল্যাণ চান, তাদের দৃঢ় প্রত্যয় হোক তার প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে, তা দেশবাসীকে বহুলভাবে, ব্যাপকভাবে জ্ঞাত করা। তবেই এ কারাবন্দি দিবসের কথা বলা যথার্থ হবে।