আইন আছে, সুশাসন নেই

আইন আছে, সুশাসন নেই

সালাহউদ্দিন বাবর


গণতান্ত্রিক সমাজে আইনের শাসন নিয়ে কিছু বলা অপ্রয়োজন। কেননা, এই বিষয় দু’টি পরস্পর পরিপূরক। গণতান্ত্রিক সমাজ একটি সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা- তা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় নিয়ম-কানুন দিয়ে পরিচালিত হওয়ার কারণে। আর নিয়ম-কানুনগুলো অবশ্যই জনগণের অভিপ্রায়ের আলোকে রচিত হতে হবে। জনগণের অভিব্যক্তির পরম প্রকাশই কোনো দেশের প্রধান আইনগ্রন্থ বা সংবিধান। এই আইন ও তার আলোকে রচিত অন্যান্য বিধিবিধানের মাধ্যমে সমাজ পরিচালিত হবে। বাংলাদেশে আইনের শাসনের গুরুত্ব কতটা ব্যাপক তা সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদের দিকে তাকালেই উপলব্ধি করা যাবে। তাতে বলা হয়েছে, ‘আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনুযায়ী ব্যবহার লাভে যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।’ আইনের শাসন শুধু এ দেশেই নয়, বিশ্বের সব প্রান্তেই এর গুরুত্ব সর্বাধিক। আইন এবং আইন অনুযায়ী শৃঙ্খলা বিধানের বিষয়টি পরিমাপ করা গেলেই বোঝা যাবে কোন দেশের নাগরিকেরা কতটা নিরাপদ এবং আইনের সুরক্ষায় রয়েছে এবং সম্মান ও নিরাপত্তার মধ্যে বসবাস করছে।

আইনের শাসন নিয়ে সংক্ষিপ্ত যে কথা উপরে বলা হলো, সেটা বস্তুত একটি আদর্শিক অবস্থান। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এমন আদর্শিক অবস্থা বিরাজ করছে না। বাংলাদেশে আইনের শাসন নিয়ে সরকারের প্রতিপক্ষরা সন্তুষ্ট নয়। তাদের কথা হলো, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত নেই সে ক্ষেত্রে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হবে কিভাবে। বাংলাদেশসহ বহু দেশে গণতন্ত্র নামে আছে বাস্তবে নেই। আইন আছে কিন্তু আইনের শাসন নেই, বিরাজ করছে অপশাসন। এমন পরিবেশে জনগণ অনেকটা বন্দিদশায় জীবনযাপন করে। বাংলাদেশে আইনের শাসন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে জোর দাবি নিয়ে বলা হয়, দেশে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত। আইনের অধীনে এবং আইন অনুযায়ী প্রশাসন পরিচালিত হচ্ছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু পক্ষান্তরে সরকারের প্রতিপক্ষ ও আইনবিদেরা মনে করেন, দেশে আইনের শাসন নেই বরং যে শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, তা ব্যক্তিগোষ্ঠীর অভিলাষ এবং অভিপ্রায়ের ওপর নির্ভর। ফলে সমাজে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয় সাধারণ নাগরিক ও সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। ক্ষমতাসীনদের চাপে প্রশাসন পরিচালনাকারীরা নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না।
আইনের শাসনের সুফল পাওয়ার ক্ষেত্রে উপরোল্লিখিত অন্তরায়গুলোর সাথে আরো আছে আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যটা কী। সেটা কি নাগরিক কল্যাণ, না ব্যক্তিগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ? যদি নির্মোহভাবে আইন প্রণয়ন করা না হয়, সুশাসনের প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্য না হয় তবে সে আইনে কোনো কল্যাণ নেই। সম্প্রতি এমন কিছু আইন হয়েছে, যা নিয়ে এই বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে, তা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের জন্য ভীতিকর। এমন একটি আইন নিয়ে বিতর্ক চলছে। আর সেটা হলো আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা। এই বিধানটি অবাধ তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে। সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে প্রতিবাদের মুখে বিধি প্রণয়নকারীরা কিছুটা পিছু হটার কথা বলছেন। অবশ্য ইতোমধ্যে এই ৫৭ ধারার প্রয়োগ করে কিছু সংবাদকর্মীকে হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে। একটি দেশের জন্য আইন প্রণয়ন করে রাষ্ট্রে একটি অঙ্গ, আইন বিভাগ। এই বিভাগের সদস্যরা হচ্ছেন জনপ্রতিনিধি। জনগণ তাদের ভোট দিয়ে আইন সভায় পাঠায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে এখন যারা এ দেশের আইন সভার সদস্য তারা প্রকৃত অর্থে জনগণের প্রতিনিধি নন। ২০১৪ সালের একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে এসব সদস্য আইন সভায় বসেছেন। এই সভার বেশিরভাগ সদস্যই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বতায় উঠে এসেছেন। আরো বলা যেতে পারে, সেই নির্বাচনে কোনো বিরোধী দল অংশ নেয়নি। তেমন একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে আসন গ্রহণকারী সদস্যরা জনগণের পক্ষ থেকে কোনো ম্যান্ডেট নিয়ে আসেননি, তাই তাদের প্রতি তারা দায়িত্বও বোধ করেন না। তাদের কাছে জনবান্ধব আইন রচনা করাটা বাতুলতা মাত্র। তা ছাড়া এই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়েছে বিধায় তাদের কাছে ক্ষমতা রক্ষার চেয়ে ভিন্ন কিছু মুখ্য নয়।

আইন-কানুন চর্চার অভাব যে সমাজ রয়েছে, সে সমাজে জনগণ কোনো অবস্থায়ই স্বস্তিতে বসবাস করতে পারে না। আইনের বৃহত্তর অর্থ সমাজের শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার বহাল থাকা। এই লক্ষেই তৈরি হয়ে থাকে দেশের সব আইন-কানুন, বিধিবিধান। আমাদের দেশে আইনের কোনো কমতি নেই বরং আধিক্যই রয়েছে। কিন্তু সে আইন রচনার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কতটা জনবান্ধব তা নিয়ে দেশে বিতর্ক রয়েছে। আইন ও আইনের প্রয়োগ হতে হবে সমাজের সার্বিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে। অভিযোগ রয়েছে, এখানে আইন প্রয়োগের ব্যাপারে অনুরাগ বিরাগের বশবর্তী হয়ে থাকেন প্রয়োগকারীরা, কাউকে ছাড় দেয়া, আবার কারো প্রতি প্রতিহিংসার কারণে। আইনের অপপ্রয়োগ করা হয়। এর ফলে দেশে এখন অনিয়ম বঞ্চনা দুর্নীতি অপরাধ দুরাচার ব্যাপক মাত্রায় চলছে। কেউ অন্যায় করে পার পাচ্ছে আবার কেউ অন্যায় না করেও দণ্ড পাচ্ছে। এখন এমন ভোগান্তি রাজনৈতিক অঙ্গনেও বিরাজ করছে, যা সুশাসনের বড় প্রতিবন্ধকতা। এটা কোনো বিশেষ সময়ে বিরাজ করছে তা নয়, কম বেশি সবসময়ই এই দুর্ভোগ মানুষকে পোহাতে হয়েছে।

আগেই বলা হয়েছে, বর্তমান যেসব আইন রয়েছে তাতে কোনো ঘাটতি নেই বরং আধিক্যই রয়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী বিহিত ব্যবস্থা হচ্ছে না। দেশে অনিয়ম দুর্নীতি অপকর্ম বাধাহীনভাবে চলছে। এসব দোষীকে কদাচিৎ আদালতে সোপর্দ করা হয়। এখানে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। অথচ লক্ষ করা যায়, দেশের ক্ষমতাসীনেরা তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রকৃত অপরাধ ছাড়াই মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। আর এমন মামলার সংখ্যা একটি দু’টি নয় শত শত। এ ধরনের মামলা বস্তুত এমন সব বিষয় নিয়ে রুজু করা হয়েছে যা হাস্যকর। যে অপরাধ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়, বাস্তবসম্মত নয়। আইনের এমন অপব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে দমন পীড়নের ফলে দেশের স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি জনগণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলছে। একই সাথে বিচার বিভাগরে প্রতি নির্বাহী বিভাগের আচরণ শুধু বৈরীই নয়, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি তাদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক।

সম্প্রতি দেশের প্রধান বিচারপতির সাথে প্রতিহিংসামূলক আচরণ করা হয়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তিনি পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। উচ্চ আদালতে বিচারকদের স্বাধীন সত্তা খর্ব করার জন্য সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সংসদে পাস করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সম্মিলিতভাবে সে সংশোধনী বাতিল করায় নির্বাহী বিভাগ ক্ষিপ্ত হয়েছে। নিম্ন আদালতের শৃঙ্খলা বিধানের ব্যাপারে একটি মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট নিম্ন আদালতে শৃঙ্খলাকর্মস্থল নির্ধারণ ও ছুটির বিষয়টি নিজেদের এখতিয়ারে নিয়েছেন, যা স্বাধীন বিচারব্যবস্থার জন্য অনুকূল। কিন্তু নির্বাহী বিভাগ তা কার্যকর করার জন্য বিহিত ব্যবস্থা নিচ্ছে না। স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকলে তা সব নাগরিকের জন্য কল্যাণকর। ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। এমনকি যারা ক্ষমতায় থাকে ভবিষ্যতে তা তাদের জন্য কল্যাণকর হবে। কেননা তারা সব সময় ক্ষমতায় থাকবেন না। ক্ষমতা হারানোর পর তারা যাতে ন্যায়বিচার পান সেজন্য আদালতের স্বাধীনতার বিষয়টি সবারই কাম্য হওয়া উচিত।

বাংলাদেশের সংবিধান আইনের ব্যাখ্যাদানের এখতিয়ার উচ্চ আদালতের ওপর ন্যস্ত করেছে। তাছাড়া উচ্চ আদালতের রায়ও আইনের সমমর্যাদা পেয়ে থাকে। সংসদে পাস করা আইন যদি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়, তবে উচ্চ আদালতকে বাতিল করে দেয়ার অধিকার সংবিধানই দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আদালত সমাজের ভারসাম্য বিধানের জন্য কাজ করে থাকেন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের ভূমিকা রয়েছে। সম্প্রতি লক্ষ করা গেছে, নির্বাহী বিভাগ তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোনো কোনো বিষয়ে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। এসব বিষয় আদালতের গোচরে এলে তারা নির্বাহী বিভাগের প্রতি আদেশ জারি করেন তা প্রতিপালনের জন্য। এটাও আইনের শাসনের একটি দিক।

যথাসময়ে বিচার পাওয়ার অধিকার প্রতিটি নাগরিকের জন্যই আবশ্যক। তা না হলে সমাজে ক্ষোভ হতাশা বাড়বে। আইন ও আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা নষ্ট হবে। বিচার পেতে দীর্ঘসূত্রতা বলতে গেলে ন্যায়বিচারের অন্তরায়। তা বিচারপ্রার্থীকে অসহায় করে তোলে। বিচার প্রক্রিয়ায় আদালতের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ন্যায় ও ত্বরিত বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে আরো কিছু বিষয় রয়েছে যেমন- অপরাধে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ভূমিকা। তারা যদি ত্বরিত সত্য ও নিষ্ঠভাবে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে পেশ না করেন, আইনজীবীরা যদি গড়িমসি না করেন, আদালতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক না থাকে তবে বিচার প্রক্রিয়ার গতি শ্লথ হয়ে পড়বে। তাতে আদালতে মামলার জট বেড়ে যাবে। আইনের শাসনের ক্ষেত্রে দ্রুত সুবিচার পাওয়া একটি জরুরি বিষয়। আইন এবং আইনের প্রয়োগের ব্যাপারে যদি সতর্কতা না দেখানো হয়, তবে সমাজ কাঠামো ভেঙে পড়বে, নৈরাজ্য দেখা দেবে। আইনের যথাযথ অনুসরণ অনুশীলনের মাধ্যমে সভ্য সমাজ গড়ে উঠেছে। কেননা, আইন মানেই শৃঙ্খলা ও সুবিন্যস্ত হওয়া।

সুশাসন তথা আইনের শাসনে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়। এই স্বাধীনতা আইনের প্রতিষ্ঠায় সহায়ক শক্তি। কেননা, অপশাসনের যাঁতাকলে সমাজ সেখানে বিশৃঙ্খলায় রুগ্ন হয়ে পড়ে। সংবাদপত্র সেই বিশৃঙ্খল অন্ধকারে কোনে আলো ফেলে তা স্পষ্ট করে তোলে প্রশাসনের জন্য। যাতে করে প্রশাসন তার প্রতিবিধান করার সুযোগ পায়। আর সংবাদপত্র যদি স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালনে বাধ্যগ্রস্ত হয়, তবে এই অন্ধকারে আলো ফেলবে কে? আর অন্ধকার তো সৃষ্টি হয় সুশাসনের উদ্যোগের অভাবে। আর প্রশাসনই তাদের সৃষ্ট এই অন্ধকার লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখার জন্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নানাভাবে খর্ব করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু এই বাধা যে নাগরিকদের সবসময়ের জন্য অন্ধকারে রাখতে পারে তা নয়। সব কিছু আবডাল করে রাখা যায় না। আবার কোথাও কোথাও সংবাদপত্রের সৈনিক সাংবাদিকেরা তাদের উঁচিয়ে রাখা কলম নামিয়ে রাখতে বাধ্য হয়। সংবাদপত্রের কর্ণধারেরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রশাসনের সাথে সখ্য করে পত্রিকার কণ্ঠ থামিয়ে দেয়। প্রশাসনের বাঁকা দৃষ্টির কারণে ভীত হতে হয় কখনো সংবাদকর্মীদের।

একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক ‘অনুশীলন’ আইনানুযায়ী করার বিরাট দায়িত্ব সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ওপর বর্তাতে যাচ্ছে। আর সে দায়িত্বটা হচ্ছে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচন কখন হবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। মাত্র কিছু সময় আগে সরকারি মহলের একজন দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি নির্বাচনের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, আগামী ডিসেম্বর মাসে ফাইনাল খেলা হবে। অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন ডিসেম্বর মাসেই নির্বাচন হবে। কিন্তু অতিসম্প্রতি তিনিই আবার বলেছেন, আগাম নির্বাচন হতে পারে। এটা তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের প্রতিক্রিয়া ও তাদের প্রস্তুতিটা উপলব্ধি করার জন্য বলেছেন কিনা তা নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন যদি না হয়, তবে কখন তা হবে সে সম্পর্কে তিনি কোনো আভাস দেননি। বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় যখন তখন বা যেকোনো মাসে করা সম্ভব নয়। কারণ, এখানে দীর্ঘ একটা সময় দেশের বিরাট অংশ জলমগ্ন হয়ে থাকে। তাই বরাবর বাংলাদেশে নির্বাচন হয়ে থাকে বছরের শুকনো মওসুম বছর প্রথম তিন মাস অথবা শেষ তিন মাসে। নেতার ভাষায় যদিই আগাম নির্বাচন হয়, তবে তা জানুয়ারি মাস থেকে মার্চ মাসের মধ্যে হতে হবে। আগাম নির্বাচন হলে যে সময় এখন হাতে রয়েছে তাতে মার্চ মাসে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। রাজনৈতিক ময়দানে আগাম নির্বাচনের কথা ওঠার পরপরই ইসিও আভাস দিয়েছে, তারা আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম। সরকারি বক্তব্যের সাথে সাথে ইসির এক সুরে কথা বলায় এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ যে, ইসি সরকারি বক্তব্যের প্রতিধ্বনী করেছে। ইসির মুখে যে কথাটা শোনার জন্য সবাই উদগ্রিব সেটা কিন্তু তারা বলছে না। জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ইসি যেকোনো মূল্যে তারা আগামী নির্বাচন ভালো করবেন, সে কথা কিন্তু ইসির মুখে নেই। ইসি বলছে না আগামী নির্বাচন যাতে অবাধ নিরপেক্ষভাবে করা যায় তার জন্য নির্বাচনী বিধিবিধানগুলোর কোনো ত্রুটি থাকলে তার প্রয়োজনীয় সংশোধন করার চেষ্টা তারা করবেন। জনগণ তাদের মুখে আরো শুনতে চায়, সংবিধান তাদের নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা দিয়েছে, তার সদ্ব্যবহার তারা করবেন। ২০১৪ সালে যে ধরনের নির্বাচন হয়েছে ভবিষ্যতে তাদের দিয়ে তার পুনারুবৃত্তি ঘটবে না। এসব প্রত্যয়ের কথা ইসির মুখে শোনা যাচ্ছে না। তারা এ কথাও বলছে না একটি ভালো নির্বাচনের ঐতিহ্য তারা সৃষ্টি করবে। বিগত নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় আইনকানুন, বিধিবিধানের যে ব্যত্যয় ঘটেছিল এবার তা ঘটবে না, এমন অঙ্গীকার ইসির তরফ থেকে আসা দরকার।

নির্বাচন কখন হবে তার একটা সময়সীমা সংবিধান নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেই সময়সীমার মধ্যে যেকোনো সময় নির্বাচন হতে পারে। এটা ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ডিসেম্বর থেকে আগাম নির্বাচনের কথা বলার কী প্রয়োজন পড়ল সেটা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। অবশ্য যেকোনো সরকার নির্বাচনের সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক পরিস্থিতিগুলো তাদের অনুকূলে কিনা তা আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। ইতোপূর্বে ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়ার যে কথা বলা হয়েছিল। সেটা সরকারের বিবেচনায় অনুকূল হবে বলে নিশ্চয়ই মনে করা হয়েছিল। কিন্তু কয়েক দিনের মাথায় পরিস্থিতির কী পরিবর্তন ঘটল যে সে তারিখ পরিবর্তনের কথা বলতে হলো? এ বিষয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা অনেক কিছু ভাবছেন। তবে সাধারণভাবে অনেকে মনে করে সরকার তার প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির খারাপ সময়কে সামনে রেখেই নির্বাচন সরিয়ে আনার কথা ভাবছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বহু মামলা এখন শেষ পর্যায়ে, কোনো সিদ্ধান্ত আদালত থেকে আসতে পারে। এমন সময়টা বিএনপির জন্য স্পর্শকাতর, তারা কিছুটা বিপর্যয়ের মাঝে পড়তে পারে। এমন অবস্থায় নির্বাচন হলে নির্বাচনী পরিবেশ সরকারের অনুকূলে থাকবে।

এ ছাড়া আগাম নির্বাচন করার আরো কারণ হিসেবে পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন যে, আগামী বছরের দ্বিতীয়ার্ধে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হবে। সে নির্বাচনে যদি ক্ষমতাসীনেরা ভালো করতে না পারে তবে তার একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জাতীয় নির্বাচনে। এই পরিস্থিতি এড়ানোর জন্যও নির্বাচন এগিয়ে আনার চিন্তাভাবনা হতে পারে। তবে আবার হঠাৎ করেই ক্ষমতাসীন দলের হাইকমান্ড বলছে আগাম নির্বাচন নয়।

ইসি তাদের প্রস্তুতির কথা বলেছে বটে, কিন্তু সত্যিকারভাবে তারা নির্বাচন করতে কতটা প্রস্তুত তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিষয়টি সবাই জানতে চাইবে। যতদূর জানা গেছে, আগামী নির্বাচন নিয়ে ভোটার তালিকা এখনও প্রস্তুত হয়নি, তার প্রয়োজনীয় সংশোধনীসহ সেটা প্রকাশ করতে হবে। আপত্তি শুনতে হবে। এ ছাড়া আরো নানা কিছু কাজ তো বাকি থাকতেই পারে। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে সব প্রস্তুতি শেষ করে আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করাটা কি সম্ভব হবে? এবার ইসিকে মনে রাখতে হবে দেশবাসী একটি ত্রুটিমুক্ত প্রশ্নবিহীন নির্বাচনের আশায় রয়েছে। দ্রুত করতে গিয়ে যেন কোনো প্রস্তুতি বাকি না থাকে সেটাও দেখতে হবে। গত ইসির কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানটির প্রতি জনগণের আস্থাকে ভাংচুর করে গেছে। সে অবস্থাটার পরিবর্তন আনতে হবে, এটা এমনি এমনি হবে না। তাদের কাজেই তা গড়বে। ইসির কর্মকর্তাদের কাজের স্বাভাবিক মেয়াদ পাঁচ বছর। এ নির্বাচনের পর আগামী নির্বাচনে তারা থাকবেন কিনা, সেটা বলা যায় না। তাই এবারই তাদের দৃষ্টান্ত রেখে যেতে হবে যে, তারা ভালো করে এসেছেন।