নির্বাচনে প্রশাসনেই আস্থা আ’লীগের!

নির্বাচনে প্রশাসনেই আস্থা আ’লীগের!

ঢাকা, ২৫ নভেম্বর (জাস্ট নিউজ) : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রশাসনের ওপর আস্থা রাখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া এবং বিরোধী নেতাকর্মীদের দমনে প্রশাসনিক পরিকল্পনাও চূড়ান্ত করে রেখেছেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। তারই অংশ হিসেবে বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুরনো মামলাগুলো সক্রিয় করা হচ্ছে। এসব মামলায় গ্রেফতারও করা হচ্ছে নিয়মিত। সাথে যোগ করা হচ্ছে নতুন নতুন মামলা।

আগামী নির্বাচন এবং নির্বাচন পরবর্তী কিছু সময় পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকবে। তবে নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদেরও ব্যাপকভাবে মাঠে নামানোর পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগের। বিরোধীদের প্রশাসনিকভাবে দমনের পাশাপাশি প্রার্থীদের পক্ষে দলীয় প্রচার নিয়ে মাঠে থাকবেন নেতাকর্মীরা।

আ’লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই ধরনের প্রশাসনিক পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে রাখা হয়েছে। বিএনপি জোট শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকলে একরকম এবং শেষ দিকে নির্বাচন বর্জন করলে আরেক রকম কৌশল প্রয়োগ করা হবে।

সূত্রগুলো জানায়, এখনো পর্যন্ত বিএনপি জোট নির্বাচনী মাঠে থাকায় গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মডেলকে সামনে নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। সে অনুযায়ী নির্বাচনের আগের রাত পর্যন্ত তৎপর থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নির্বাচনের আগে ও পরে দেশের সম্ভাব্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ প্রশাসনিক শক্তি কাজে লাগানো হবে। বিশেষ করে ৩০ ডিসেম্বরের আগেই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি জেলা ও স্থানীয় নেতাদেরও বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার করা হতে পারে। বিশেষ বিশেষ দিনকে কেন্দ্র করে অঘোষিত একাধিক গ্রেফতার অভিযানও পরিচালনা করা হতে পারে। তবে গ্রেফতার অভিযান যাতে চোখে পড়ার মতো না হয় এবং ফলাও করে প্রচারের সুযোগ না পায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকবে প্রশাসন। এভাবেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চান সরকারের নীতি নির্ধারকেরা।

আর নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে বিএনপি জোট নির্বাচন বর্জন করলে আরো হার্ডলাইনে যাবে প্রশাসন। ওই সময় দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সব কিছুই করবে সরকার। বিএনপি জোট নির্বাচন বর্জন করলে কোনোভাবেই তাদের নির্বাচনে ফেরানোর চেষ্টা করবে না সরকার। বরং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের আন্দোলন বা নাশকতা শুরু হলে কঠোরতার মাত্রাও বাড়বে। বিএনপির কেন্দ্রীয়সহ তৃণমূল পর্যায়ের ডাকসাইটে নেতাদের আটক ও গ্রেফতার করা হতে পারে। ইতোমধ্যে আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।

তবে গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচনের মডেলের সফলতা নিয়ে যথেষ্ট সংশয়ও রয়েছে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। তাদের কারো মতে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রশাসনের সর্বশক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে সেই শক্তি সারা দেশে ভাগ হয়ে যাবে। দেখা গেছে, সিটি নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্যকে মোতায়েন করার সুযোগ ছিল। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে আর সেই সুযোগ থাকছে না। এ ক্ষেত্রে বিরোধী জোটের কর্মীরা কেন্দ্রে কেন্দ্রে সক্রিয় থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে তা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়তে পারে। সেজন্য খুলনা ও গাজীপুর মডেল শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আ’লীগ ও সরকারের সূত্রগুলো আরো জানায়, নির্বাচন ঘিরে প্রশাসনের তৎপরতার পাশাপাশি দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠ দখলে রাখার চেষ্টা করবে আ’লীগ। তবে নির্বাচনে মূল ভূমিকা পালন করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দলীয় নেতাকর্মীরা কেবল সহযোগী হিসেবেই মাঠে থাকবে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি জোটের সম্ভাব্য আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল সরকারের। এতে দেশব্যাপী সহিংসতা ও নাশকতার তথ্যও ছিল। বিশেষ করে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনকালীন সরকারের সময় সরকারবিরোধীরা সহিংসতা শুরু করতে পারে বলে সরকারের কাছে নানা ধরনের তথ্য দেয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।

নির্বাচনকালীন সরকারের কারণে এ সময় প্রশাসনের ওপর সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণও খানিকটা ঢিলে হতে পারে বলে আশঙ্কা ছিল। বিষয়টি মাথায় নিয়েই তফসিলের আগে কয়েক দফা প্রশাসনিক রদবদল করা হয়। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত বর্তমান মাঠ প্রশাসনকেই পছন্দ সরকারের। বিষয়টি নিয়ে বিএনপি জোট ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দিয়েছে। তারা ঊর্ধ্বতন ও মাঠপর্যায়ের সব মিলিয়ে ৯২ জন প্রশাসনিক কর্মকর্তার একটি তালিকা নির্বাচন কমিশনের কাছে হস্তান্তর করেছে। তবে বিএনপি জোটের দাবি অনুযায়ী মাঠ প্রশাসনে রদবদল কোনোভাবেই মানবে না ক্ষমতাসীন আ’লীগ। শুক্রবার নির্বাচন কমিশনে গিয়ে ক্ষমতাসীন ১৪ দলের পক্ষ থেকে বিএনপি জোটের বিরুদ্ধে ডজনখানেক পাল্টা অভিযোগ জমা দেয়া হয়েছে।

সূত্রগুলো জানায়, এখন পর্যন্ত বিএনপি জোট নির্বাচনে থাকবে ধরে নিয়েই এগোচ্ছে সরকার। সেজন্য ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে সারা দেশে দায়ের হওয়া জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর ও নাশকতার মামলাগুলোর দিকে নজর দিচ্ছে প্রশাসন। এর বাইরেও গত ১০ বছরে বিএনপি জোটের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলোকেও চাঙ্গা করা হচ্ছে। এসব মামলায় গ্রেফতার অভিযান নির্বাচন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।

সম্প্রতি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি গিয়াস কাদের চৌধুরী, স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া এবং দলের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী আ ন ম এহছানুল হক মিলনকে পুরনো মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

নয়াপল্টনে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে দলের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে। তাদের অনেককেই রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে বিরোধী নেতাকর্মীদের চাপে রাখার জন্যই এসব মামলা ও গ্রেফতার চলছে বলে আ’লীগ ও প্রশাসনের বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে।

প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানায়, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৬৪ জেলার পুলিশ সুপারদের (এসপি) সদর দফতরে ডেকে ব্রিফ করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। নিয়মিত সভা করে নির্বাচনকেন্দ্রিক কর্মপন্থা ঠিক করছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

আ’লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দু’জন নেতা বলেন, ‘নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি জোটের রাজনৈতিক কথাবার্তার জবাব দল থেকে সংবাদ সম্মেলন বা অন্য কর্মসূচির মাধ্যমে নিয়মিতভাবে দিচ্ছেন দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। আর অন্য বিষয়গুলো দেখবে প্রশাসন। সেখানে আমাদের না জড়ানোই ভালো। সে জন্য নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আ’লীগ নেতাকর্মীদের শুধু সতর্ক থাকতে বলা হবে। এটাই আমাদের কৌশল।’

তাদের একজন বলেন, ‘সর্বশেষ অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো আ’লীগের জন্য অনুকরণীয়। এসব নির্বাচনে কোনো সহিংসতা বা নাশকতা হয়নি। ভোট সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। ওই নির্বাচনে কারচুপির বড় কোনো প্রমাণ কেউ দিতে পারেনি। সেজন্য আগামী জাতীয় নির্বাচনেও সেই কৌশল নিবে সরকার।

বিশেষ করে খুলনা ও গাজীপুর সিটির নির্বাচনকে মডেল হিসেবে নিয়ে এগোবেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা।’

এ ব্যাপারে আ’লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘গণজাগরণ তৈরি হলে প্রশাসন কিছু করতে পারে না। আর আ’লীগ প্রশাসনে ভর করে নির্বাচনে জিততেও চায় না। প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিএনপি যেসব অভিযোগ করছে তা ভিত্তিহীন। দেশের জনগণই আ’লীগকে ভোট দিয়ে আবারো সরকার গঠনের সুযোগ দিবে।’সূত্র : নয়াদিগন্ত

(জাস্ট নিউজ/এমজে/৯৪০ঘ.)