মানিকগঞ্জ, ১৩ মার্চ (জাস্ট নিউজ) : বাবা সেলিম মোল্লা (৫০) হরিরামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। ছেলে রাজিবুল হাসান ওরফে রাজীব (২৭) একই উপজেলার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। রাজনৈতিক এই পরিচয়ের আড়ালে তারা দুজনে মিলেই নেতৃত্ব দেন একটি অপহরণ চক্রের। চক্রের অন্য সদস্যরাও আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
রবিবার রাতে এই দুজনসহ ১০ জন ধরা পড়েন র্যাবের হাতে। র্যাব বলছে, এই চক্রের লোকজন ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে লোকজনকে মাইক্রোবাসে তুলে নির্যাতন করে স্বজনদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। শুক্রবার সকালে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে মো. জাফর ইকবাল (৪০) এবং মো. মিরাজ গাজী (৩৫) নামের দুই ব্যবসায়ীকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যান তারা। তাদের মুঠোফোন থেকে স্বজনদের কাছে টাকাও চাওয়া হয়। জাফরের বোন শুক্রবার রাতেই মানিকগঞ্জে গিয়ে নগদ ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা দিয়ে আসেন। আরো টাকা পাঠানোর জন্য মিরাজের স্বজনদের একটি অ্যাকাউন্ট নম্বর দেওয়া হয়, যার সূত্র ধরেই চক্রের সন্ধান পায় র্যাব।
সোমবার দুপুরে কারওয়ান বাজারে মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে এই চক্রটির সম্পর্কে তথ্য দেয় র্যাব। তবে তারা গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে কিছু জানে না বলে দাবি করে। তবে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা এ প্রতিবেদকের কাছে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করেন। সেলিম মোল্লা ও তার ছেলে রাজিবুল হাসানকে দল থেকে বহিষ্কার ও শাস্তির দাবিতে গতকাল বিকালে ঝিটকা বাজারে বিক্ষোভ মিছিলও করেন স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
রবিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে র্যাব–২-এর ২৫ জন কর্মকর্তা হরিরামপুরের কালোয়া গ্রামে সেলিম মোল্লার আলিশান বাড়িতে ঝটিকা অভিযান চালান। বাড়ির বিভিন্ন তলা ও কক্ষ থেকে তারা ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেন। তল্লাশি চালিয়ে ছয়টি পিস্তল, নয়টি ম্যাগাজিন, ৩৬টি গুলি, সাতটি চায়নিজ কুড়াল, চারটি চাপাতি এবং নগদ ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা উদ্ধার করেন। বাড়ির একটি কক্ষে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায় অপহৃত জাফর ও মিরাজকে।
গ্রেপ্তার অন্য আটজন হলেন- উপজেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক মো. মোশারফ হোসেন (৪৭) এবং যুবলীগের কর্মী মো. নিরব আহম্মেদ টিটু (২৯), মো. আবদুর রাজ্জাক (৩৫), মো. তারেক হোসেন (৩১), মো. আবুল বাশার বিশ্বাস (৩৩), মো. রুহুল আমিন (৩৫), মো. তারেক হোসেন পুলক (২৬) ও মো. তুহিন বিশ্বাস (৩০)।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান সাংবাদিকদের বলেন, সেলিম মোল্লার তিনতলা বাসার পুরোটাতেই তার সাঙ্গপাঙ্গরা থাকত। এর একটি কক্ষে অপহৃত ব্যক্তিদের আটকে রেখে নির্যাতন করা হতো। আভিযানিক দল বলেছে, কক্ষটিকে ‘টর্চার করার মতো একটি প্লেস’ বলা চলে। প্রাথমিকভাবে তারা জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে চক্রটি অপহরণ করে অত্যাচার করে মুক্তিপণ হিসেবে টাকা আদায় করে আসছিল। সেলিম মোল্লা বেশ অর্থ–সম্পদের মালিক হয়েছেন এলাকাতেই। সে বিষয়গুলোও পরবর্তী সময়ে তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
উদ্ধার হওয়া মো. জাফর ইকবাল ও মো. মিরাজ গাজী বলেন, শুক্রবার সকালে ব্যবসায়িক কাজে তারা দুজন ফার্মগেটে এসেছিলেন। বিজ্ঞান কলেজের সামনে তারা দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। এ সময় একটি মাইক্রোবাস এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। ধানমন্ডি কোন দিকে জানতে চায়। তারা যখন তাদের দিক বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন দু-তিনজন নেমে তাদের মাইক্রোবাসে ধাক্কা দিয়ে তুলে চোখ বেঁধে ফেলে। এরপর আনুমানিক দু-তিন ঘণ্টা একটানা চলার পর একটি জায়গায় দাঁড়ায়। তাদের চোখ যখন খোলে, তখন একটি কক্ষের মধ্যে ছয়-সাতজন লোক তাদের সামনে। তারা বলে ‘টাকা দে’। তারা হতভম্ব হয়ে পড়েন। ঘোর কাটার আগেই তাদের বেতের লাঠি দিয়ে পেটানো শুরু করে। একপর্যায়ে কাপড় খুলে লুঙ্গি পরায়। হাত-পা বেঁধে মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে একটি পাটাতনের ওপর শোয়ায়। গলার কাছে কিছু একটা ধরে। ছটফট করতে থাকলে মুখের স্কচটেপ খোলে। টাকা দেওয়া হবে বলে জানালে মারধর থামে।
জাফর বলেন, অপহরণকারীরা তার ফোন থেকে তার বোনের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়। অপহরণকারীদের কথা অনুযায়ী তিনি চেকবই ও নগদ ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা নিয়ে মানিকগঞ্জে যান। অপহরণকারী সদস্যদের একজন তার বোনের সঙ্গে দেখা করে চেক বই ও টাকা নিয়ে আসে। এরপর মিরাজের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার মুক্তিপণ পাঠানোর জন্য সেলিম মোল্লার ছেলে রাজিবুল হাসানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর দেওয়া হয়।
জাফর বলেন, শুক্রবার দুপুরে শুধু একবেলা তাদের খেতে দিয়েছিল অপহরণকারীরা। নির্যাতনের একপর্যায়ে হাত-পা বেঁধে দুজনকেই চালের আলাদা বস্তায় ঢুকিয়েছিল। বলেছিল নদীতে ফেলে দেবে।
র্যাব–২-এর আভিযানিক দলটির নেতৃত্বে ছিলেন উপ-অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, মিরাজের স্বজনেরা রাজিবুলের অ্যাকাউন্টে আড়াই লাখ টাকা পাঠিয়েছিলেন। রাজিবুল যখন সেই টাকা তুলতে যান, তখনই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর রাতে তাদের বাসায় অভিযান চালানো হয়। তারা যখন অভিযান চালান, তখন সেখানে সবমিলে ১৫-২০ জন ছিল। তাদের মধ্য থেকে অপহরণের সঙ্গে জড়িত ১০ জনকে তারা গ্রেপ্তার করেন।
স্থানীয় লোকজন এবং দলীয় একাধিক নেতা-কর্মী জানান, সেলিম মোল্লার গ্রামের বাড়ি হরিরামপুর উপজেলার কামারঘোনা গ্রামে। প্রায় চার বছর আগে তিনি এই এলাকায় বাড়ি করেন। তিনি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে চতুর্থ শ্রেণির চাকরি করেন। অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে তিনি বেশ অর্থ ও বিত্তশালী হয়ে ওঠেন। তিনতলাবিশিষ্ট ডুপ্লেক্স বাড়ির দক্ষিণ পাশে দুই তলা আরেকটি ভবন নির্মাণ করেছেন। চার-পাঁচ বছর ধরে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম মহীউদ্দিন তাকে রাজনীতিতে আনেন, পদবি দেন। এ ছাড়া তার ছেলে রাজিবুল হাসানও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন।
সেলিম মোল্লা স্থানীয় ঝিটকা আনন্দ মোহন উচ্চবিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির পরপর সভাপতিও। বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক অভিভাবক সদস্য রফিকুর রহমান চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, বিদ্যালয়ের নিজস্ব প্রায় আট বিঘা জমিতে মাটি ভরাট করে ৩০০ দোকান ঘর বরাদ্দ দিয়েছেন সেলিম মোল্লা। এর থেকে উপার্জিত তিন কোটি টাকার বেশি সেলিম মোল্লা আত্মসাৎ করেন।
তবে সেলিম মোল্লাকে রাজনীতিতে নিয়ে আসার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম মহীউদ্দিন। তিনি বলেন, দু-এক দিনের মধ্যেই উপজেলা আওয়ামী লীগ জরুরি সভা ডেকে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করবে বলে জানান তিনি। সূত্র: প্রথম আলো।
(জাস্ট নিউজ/একে/২১৫০ঘ.)