দ্য ডিপ্লোমেট'র প্রতিবেদন

হাসিনার একনায়কতন্ত্র বিরোধীদের আতংকে রাখে ছাত্রলীগ

হাসিনার একনায়কতন্ত্র বিরোধীদের আতংকে রাখে ছাত্রলীগ

ঢাকা, অক্টোবর ২৬ (জাস্ট নিউজ): একনায়কতন্ত্রের পথ ধরে হাঁটা হাসিনা সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করা ছাত্র এবং শিক্ষকদের ভয় দেখিয়ে আতংকে রাখে ছাত্রলীগ। দশ বছর আগে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশের কর্তৃত্ব নেবার পর থেকেই দেশটির ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) সব বিরুদ্ধমতকে কন্ঠরোধ করে রাখা হয়।

আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী ম্যাগাজিন দি ডিপ্লোমেট-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার ভূমিকা নিয়ে করা এক প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করা হয়।

'দি ইউনিভার্সিটি ফাইটারস অব শেখ হাসিনা' শিরোনামে ২৪ অক্টোবর প্রকাশিত ঐ প্রতিবেদনে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে জাতীয় নানান পট পরিবর্তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা, বর্তমানে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ দ্বারা এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ, বিরোধী কন্ঠরোধ, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সরকার দলীয় সংগঠনে যোগ দিতে বাধ্যকরাসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।

জাস্ট নিউজ পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি হুবহু তোলে ধরা হলো:

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষ্য গাঁথা হয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন। এর টেবিলগুলো যেন সে কথাই বলে! শিক্ষার্থীরা এখন সেখানে জড়ো হয়ে চা পান করে, সবজি রোল কিংবা মিষ্টি মুখে পুড়ছে কিন্তু কিছু একটার শূন্যতা দেখা দিয়েছে। ইতিহাসের সে গৌরব আর ক্যান্টিনটির নেই।

কলা অনুষদের এক অধ্যাপকের কণ্ঠে যেন এ কথারি প্রতিধ্বনি। তিনি বললেন-"মধুর ক্যান্টিনটা ছিলো সবধরণের রাজনীতির প্রাণ কেন্দ্র। দুই কিংবা তিন দশক আগে এটার যে সার্বজনীনতা ছিলো, এখন আর সেটার নেই।"

তিনি বলেন, দুই বিপ্লবীর স্মৃতি বিজরিত ক্যান্টিন এটি। বাংলাদেশর স্বাধিকার রক্ষার সংগ্রামে একসময় তাঁরা এখান থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্যান্টিনটি এখন ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

দশ বছর আগে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার যখন বাংলাদেশের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে তখন থেকেই দেশটির ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়টির (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) সব বিরুদ্ধ মতের কণ্ঠ চুপসে যায়। হাসিনার ক্রমবর্ধমান একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে কোনাে ছাত্র কিংবা শিক্ষক ভিন্নমত পোষণ করলেই তাদেরকে আতংকিত করে দমিয়ে রাখে ছাত্রলীগ।

সর্বত্রই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাদা-কালো ছবি শোভা পেতে দেখা যায়।শীর্ষে শোভা পেতে দেখে যাবে পতাকাকেও। এতকিছুর মাঝে সরকার নিয়ন্ত্রণ আরোপের পর যে কণ্ঠটি আপনি মুক্ত পাবেন-তা শুধু সরকার পক্ষের!

কলা অনুষদের আরেক অধ্যাপক বলেন, এখানে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) যারা আছে তাদের ৯০ শতাংশই ছাত্রলীগ করে।

আতংক, অনিচ্ছায় কিংবা সুবিধা পেতে বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০,০০০ শিক্ষার্থীদের মাঝে একটা বিশাল অংশ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত। আবাসিক হলে যেসব শিক্ষার্থীদের অবস্থান করে তাদের মধ্যে ছাত্রলীগ আধিপত্য বিস্তার করে বলে জানান ঐ অধ্যাপক। যেসব দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীরা রাজধানীতে খরচ চালিয়ে থাকার মতো সামর্থ্য নেই তারা হলে উঠে এর ভুক্তভোগী হন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক বলেন, "হলের নেতাদের নির্দেশ বাস্তবায়ন করার জন্য রাজনৈতিক সভাগুলোতে নিয়মিত যোগ দিতে হয় হলের শিক্ষার্থীদের। আর কেউ সেটা না মানলে তাকে হল থেকে বের করে দেয়া হয়।"

তিনি জানান, "এ বিশ্ববিদ্যালয়টাকে যদি আপনি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন তাহলে দেশের ভবিষ্যতকেও নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।"

বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অঘোষিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করার নীতি প্রসঙ্গে অারেকজন শিক্ষক জানান, চীনা সেনাবাহিনীর নীতি নির্ধারক তাঁর লেখা "আর্ট অব ওয়ারে" বলেছেন-শত্রুকে যদি পরাস্থ নাই করতে পারো তাহলে তাদের সঙ্গে মিশে যেও।" এখানেও এমন নীতিরই বাস্তবায়ন হচ্ছে।

মধুর ক্যান্টিনে দি ডিপ্লোমেট সঙ্গে সাক্ষাতকার দেন ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারি সাদ্দাম হোসেইন। তার সঙ্গে ক্যান্টিনে যারি দেখা হচ্ছে তারা মাথা ঝুঁকে কুশল বিনিময় করছে আর হাত মেলাচ্ছে। হোসেনকে দেখেই টেবিল গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ক্যান্টিন ওয়েটাররা। হোসেন বসার সঙ্গে সঙ্গেই তার সেকেন্ড ইন কমান্ডকে দেখা যায় অন্যদের ইশারা দিয়ে থামিয়ে দিতে। আর যেই কথা সেই কাজ। যখনি ইন্টারভিউ নেয়া শুরু হলো- মনো হল পুরো ক্যান্টিনটা সাক্ষাতকারের জন্য টেলিভিশন সেটে পরিণত হয়েছে।

হোসেন যেভাবে সাক্ষাতকার দিচ্ছিলেন তা ছিলো রাজনৈতিক কৌশলী কথাবার্তা, আর সে হিসেবে সঠিক বলা যায়। রাজনৈতিক লক্ষ্য কি এ প্রশ্নের জবাবে অনেকটা সংকোচ হতে দেখা যায় তাকে। তিনি বলেন, "আমি এমন একজন কর্মী হতে চাই যে কিনা পরিবর্তনকে উৎসাহিত করে। আর এটা করার জন্য যে আমাকে প্রধানমন্ত্রীর জায়গায় যেতে হবে, এমনটা মনে করি না।" রাজনৈতিক আকাংখা তার যাই থাকুক ইতিমধ্যে ক্যাম্পাসে নিজেকে প্রভাবশালী হিসেবে তৈরি করে নিয়েছেন হোসেন।

হোসেন যখন কমিটিতে জায়গা পান ঠিক সে সময়টাতেই দুই স্কুল শিক্ষার্থীর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়াকে কেন্দ্র করে সপ্তাহরও বেশি সময় ধরে বিক্ষোভ চলছিলো। জুলাই ২৯ থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত বিক্ষোভকারীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের রাজপথ দখল করে রাখে। ছাত্ররা যখন রাজপথে ছিলো তখন বিক্ষোভ দমাতে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। বিক্ষোভ চলাকালে হেলমট পড়ে এবং হাতে লম্বা লাঠি নিয়ে কিছু গ্রুপ ছড়াও হয় আন্দোলনকারী প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের উপর। নিরাপদ সড়কের দাবিতে সে সময় আন্দোলনকারীরা ড্রাইভারদের লাইসেন্স পরীক্ষা করছিলো। সমালোচকরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগ যেটা করেছে সেটাকেই আসন্ন ডিসেম্বর মাসের জাতীয় নির্বাচনে কাজে লাগাতে চাইবেন প্রধানমন্ত্রী।

আন্দোলনে ছাত্রলীগের কোন ধরনের সহিংসতার বিষয়টি নাকোচ করে দেন হোসেন, তবে আন্দোলন চলাকালে হামলা-অনিয়মের বিষয়টি তিনি স্বীকার করে নেন। তিনি বলেন, "বিরোধী শক্তিগুলো চেয়েছিলো একটি সামাজিক আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলনের রুপ দিতে।যখন আন্দোলনটা শুরু হয় তখন আমরা স্কুল শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়েছি সমর্থন জানাতে, তাদের মধ্যে চকলেট বিতরণ করেছি।" শিক্ষার্থীরা যে দাবিতে আন্দোলন করছিলো তাই একসময় আইন পরিবর্তনের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

ছাত্রলীগের আরেক নেতা নয়ন বলেন, আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবার আরেকটা কারণ হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এসময় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ কোথায় ছিলো-প্রশ্ন রাখেন তিনি। এটা সময় ভুল তথ্যের একটা কেন্দ্রে পরিণত হয়- ভিডিও, ছবি, বার্তায় ছিলো গুজব আর ভূয়া তথ্যের ছড়াছড়ি। আইন করে সেটাকে বন্ধ করতে হয়েছিলো।

দাতব্য সংস্থার টাকা অনিয়োমের অভিযোগে দেশের প্রধান বিরোধী নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের জেল দিয়ে সাজা দেবার পর সরকার মনযোগ দিয়েছে মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দিকে। সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখ ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন পাস করে সরকার, যেটাকে দেশ-বিদেশের সমালোচরা কাল কানুন হিসেবে অভিহিত করেছেন। আইনটিতে সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীদের আপত্তিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এ আইনের মাধ্যমে পুলিশ যখন তখন তল্লাশি চালাতে পারবে এবং কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই যে কাউকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে পারবে।

ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ধারা-৮ অনুসারে সম্প্রীতি বিনষ্ট, জন বিশৃঙ্খলা তৈরি, সাম্প্রদায়িক ঘৃণা উদ্রেককারি কিছু ঘটার দায়ে যেকোনো ডিজিটাল মিডিয়ায় কন্টেন্ট অপসারণ বা ব্লক করে দেবার সুযোগ রাখা হয়েছে। ধারা-২৫ বলা আছে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো ওয়েবসাইটে ভূয়া সংবাদ পরিবেশন করলে অভিযুক্তকে সবোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড দেয়া যাবে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, নতুন আইন মুক্ত মতপ্রকাশের ক্ষেত বড় রকমের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়টিতে অতীত থেকে কোনো রকমের শিক্ষা নেয়া হয়নি। জনগণের মধ্য যারাই কথা বলতে চায় আইনটি তাদের মত প্রকাশে অন্তরায় হযে দাঁড়াবে।

ছাত্রলীগ নেতা নয়ন আরো বলেন, যে বিষয়টা আরো উদ্বেগের তা হলো- অনেক লোকই জানেনা কিভাবে ফেসবুক ব্যবহার করতে হয়।

ডিপ্লোমেট থেকে প্রশ্ন করা হলো- তাহলে কি ছাত্রদের বিক্ষোভকে আপনি ভূয়া সংবাদ বলবেন? তিনি জবাব দিলেন- অনেকটাই ভূয়া। সরকারকে বিপদে ফেলেত বিরোধীরা সহিংসতায় মদদ দিয়েছে।

সাক্ষাতকারে শেষে যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হবার জন্য আমরা বাইরে পা রাখলাম তখনি কানে বাজতে লাগলো রিক্সার বেল বাজার শব্দ, আর রাস্তায় মানুষের কোলাহাল। কিন্তু যদি আমরা বাংলাদেশের শ্রেণিকক্ষ, গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দিকে দৃষ্টি ফেরাই তাহলে দেখতে পাবো- নিরবতা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে, আর আওয়ামী লীগ অপেক্ষায় আছে তাদের স্বৈরতন্ত্রের ফসল ঘরে তােলার আশায়।

(জাস্ট নিউজ/জিএস/০০৩৫ঘ)