কোন কিছুই তোয়াক্কা করেনা বর্তমান সরকার: ডয়চে ভেলেকে শহীদুল

কোন কিছুই তোয়াক্কা করেনা বর্তমান সরকার: ডয়চে ভেলেকে শহীদুল

ঢাকা, ৭ নভেম্বর (জাস্ট নিউজ): কোন কিছুরই তোয়াক্কা করেনা সরকার, আর আমাকে জেলে আটক করে তারা সেটাই বুঝাতে চেয়েছে। নিজের ১০০ দিনেরও বেশি দুঃসহ কারাস্মৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে এ কথা বলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফটোগ্রাফার শহীদুল আলম।

আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপ আর নিন্দার মুখে ১০৭ দিন কারাভোগ করার পর গত ২০ নভেম্বর জামিনে মুক্তি দেয়া হয় শহীদুল আলমকে৷ আগস্টে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে আল-জাজিরাকে সাক্ষাৎকার দেয়ার পর তাঁকে ঢাকায় নিজ বাড়ি থেকে আটক করা হয়৷ সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি৷

কারাগারে আটকের পর নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে শহীদুল আলম বলেন, কার্যত আমাকে তারা জিজ্ঞাসাবাদ আর নির্যাতন করে।  নেয়া হয় সাত দিনের রিমান্ডে, এরপর ১০০ দিনেরও বেশি বন্দি দশায় কাটাতে হয়েছে।

তিনি বলেন, রিমান্ডের তিনটা ধাপ একরকমের ছিলোনা। প্রথম অভিজ্ঞতাটা ছিলো খুবি ভীতিকর। আশংকা করছিলাম খুব বাজে একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। দ্বিতীয় ধাপে তারা চেয়েছিলো আমার থেকে কথা বের করে আনতে এবং তাতে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু তারা আমার কাছ থেকে কোন কিছুই আদায় করার মতো পায়নি। কোন একটা কিছু বের করাটা তাদের জরুরি ছিলো কিন্তু পারেনি। আর তৃতীয় ধাপটা ছিলো বেশ লম্বা, কারাগারে কাটানো সময়টুকু। তিন ধাপেই চেয়েছিলো নানা কৌশল অবলম্বনে করে কিছু একটা করতে। আসলে সরকারপক্ষ চেয়েছিলো ভয় দেখিয়ে বশ্যতা স্বীকার করাতে।

ক্ষমা চাইলে জেল থেকে মুক্ত করে দেয়া হবে এমন প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো উল্লেখ করে খ্যাতিমান এই ফটোগ্রাফার বলেন, আমি মুখ বন্ধ রাখবো এমন প্রস্তাবে রাজি হলে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হবে, মামলা প্রত্যাহার হবে- বলে প্রস্তাব দেয়া হয়। যখন এ প্রস্তাব মানতে অস্বীকৃতি জানালাম, তাদের কৌশল ভেস্তে গেল, তখন রিমান্ডে নেয়া হলো। রিমান্ডের সময়টাতে আমার বিরুদ্ধে কোনো কিছু খুঁজে বের করা যায় কিনা সে চেষ্টা শুরু করলো, তারা চেয়েছিলো দোষী সাব্যস্ত করতে। সবকায়দা ফলিয়েও সফল হলো না। কোনো কিছু না পেরে তারা শেষমেষ প্রস্তাব দিলো-অনুতপ্ত হতে হবে, ক্ষমা চাইতে হবে। আমাকে বলতে হবে-দুঃখিত। এ প্রস্তাবনাও ভেস্তে গেলো।  সে সময়টাতে আমার পক্ষে বিদেশে এবং দেশে মুক্তির জন্য সরকারের উপর চাপ বাড়তে থাকে। আমার ধারণা তারা (সরকার) বুঝতে পেরেছিলো যে, তারা (সরকার) যেটা করছে সেটা ভুল।

সরকার কেন আটক করেছিলো? এমন এক প্রশ্নের জবাবে শহীদুল আলম বলেন, জেলে আটক করে তারা আমাকে দুটি শিক্ষা দিতে চেয়েছিলো। প্রথমটা হলো- সরকার খুবি ক্ষমতাশালী এটা বুঝিয়ে দেয়া। আর দ্বিতীয়টা হলো- তুমি যেই হও, যতো জনসমর্থনই থাক না কেন, সরকার চাইলে তুমাকে জেলের ভাত খাওয়াতে পারে এটা বুঝানো। আরেকটা বিষয় হলো কারো দোষ থাক বা না থাক সরকার চাইলেই যাকে খুশি তাকে জেলে ঢুকাতে পারে। নিজের স্পর্ধা আর দাপট দেখানোটা ছিলো এর উদ্দেশ্য। তারা (সরকার) দেখাতে চেয়েছে কোন কিছুরই তোয়াক্কা করেনা।

বাংলাদেশে মতপ্রকাশের বর্তমান পরিস্থিতি উদ্বেগজনক উল্লেখ করে খ্যাতিমান এই ফটোগ্রাফার বলেন, বর্তমান অবস্থাটা উদ্বেগের। দীর্ঘ একটা সময় গেছে যখন শুধু রাষ্ট্রীয় মিডিয়া ছিলো। তারপর ব্যক্তিমালিকানাধীন টেলিভিশন আর সংবাদপত্রের বিকাশ ঘটলো। দেশে এখন প্রচুর মিডিয়া আর প্রকাশনা রয়েছে। ধারণা করেছিলাম এর মাধ্যমে মতপ্রকাশের ব্যাপক প্রসারের সুযোগ ঘটবে কিন্তু আসলে সেটা হয়নি। ব্যক্তিমালিকানাধীন মিডিয়াগুলো এখন রাষ্ট্রীয় মিডিয়ার মতো কাজ করছে। অনেক ব্যক্তিমালিকানার মিডিয়া আছে যেগুলো প্রপাগান্ডার কাজ করে যাচ্ছে, সরকারের কথামতো বশ্যতা মেনে নিয়েছে।

তিনি বলেন, ভয়ের সংস্কৃতি আর মিডিয়ার স্বাধীনতার ঘাটতির কারণে সাংবাদিকদের জন্য একটা আতংকের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সাংবাদিকরা নিজেদের জীবন নিয়ে শংকায় আছে। সাংবাদিকরা এখন আর সাংবাদিকতার চর্চা করছেনা। স্পষ্টকরে বললে বলতে হয়, সরকারের কথামতো চললেই রাস্তাটা এখন সহজ।

বর্তমান পরিস্থিতি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলবে?-এমন এক প্রশ্নের জবাবে শহীদুল আলম বলেন, সামনের নির্বাচনটি খুবি গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্যই এটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক হওয়া উচিত। কিন্তু চলমান পরিস্থিতি আভাস দিচ্ছে নির্বাচনটা তেমনভাবে হবেনা। আর এ কারণেই সাংবাদিকদের সতর্ক থাকতে হবে।

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা নিয়ম করেছে যার কারণে সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালন করাটা কঠিন হয়ে পড়বে।

শহীদুল আলম প্রশ্ন রেখে বলেন- তারা (সাংবাদিক) কি ছবি তোলতে পারবে? স্বাধীনভাবে নিজেদের প্রতিবেদন তৈরি করতে পারবে? এ বিষয়গুলো এখন বড় আকারের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের শুধু অতন্দ্র প্রহরী হলে চলবেনা তাদের সাহসীও হতে হবে। তবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাদের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে।

(জাস্ট নিউজ/জিএস/২৩৪০ঘ)