টিউলিপ সিদ্দিকের মুখোশ উন্মোচনে সোচ্চার বৃটিশ মিডিয়া

‘পারিবারিক কারণে বাংলাদেশ সরকারের নিষ্ঠুরতায় সমর্থন দিচ্ছেন টিউলিপ’

‘পারিবারিক কারণে বাংলাদেশ সরকারের নিষ্ঠুরতায় সমর্থন দিচ্ছেন টিউলিপ’

নিউইয়র্ক থেকে মুশফিকুল ফজল আনসারী, ১৪ ডিসেম্বর (জাস্ট নিউজ) : আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্টজন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আপন ভাগ্নি হওয়া স্বত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই বলে বার বার গণমাধ্যমের কাছে তা অস্বীকার করে যাচ্ছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বৃটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক। গেলো নভেম্বরে বৃটেনের জনপ্রিয় গণমাধ্যম চ্যানেল ফোরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারেও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশি নন। মানবাধিকার ইস্যুতে বৃটেনে টিউলিপের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো হলেও বাংলাদেশের গুম, বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ডসহ ক্রম অবনতিশীল মানবাধিকার ইস্যুতে তার নির্লিপ্ততা সমালোচনা আর নিন্দার ঝড় তোলেছে গণতন্ত্রের তীর্থস্থান খ্যাত পুরো বৃটেন জুড়ে।

‘টিউলিপ সিদ্দিক: কোয়েশ্চন ওভার লিংকস উইথ বাংলাদেশি রুলিং পার্টি’ শিরোনামে বুধবার সচিত্র একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রেস্টিজিয়াস গণমাধ্যম চ্যানেল ফোর। প্রতিবেদনটিতে সর্বশেষ বিএনপি সরকারের আমলে ভিয়েতনামে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা মারুফ জামানের ৪ ডিসেম্বর গুম হবার প্রসঙ্গ এনে বাংলাদেশে অব্যাহত গুম ও বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ডসহ মানবাধিকার অবনতির চিত্র তোলে ধরা হয়। বৃটেনে মানবাধিকার লংঘন নিয়ে মাঠে-ময়দানে সরব থাকলেও নিজের বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে কেন কোনো প্রশ্ন তোলেছেন না বা ভূমিকা রাখছেন না তা নিয়ে বিষ্ময় ও হতাশা প্রকাশ করা হয়েছে। উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মীসহ বৃটেনের নেতৃস্থানীয়রা।

অ্যালেক্স থমসনের করা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বৃটিশ এমপি টিউলিপের খালা শেখ হাসিনা, যিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকারের অধীনে বাংলাদেশে জোরপূর্বক অপহরণ এবং গুম অব্যাহত রয়েছে। এটি যেন এখন নিত্যদিনের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতির চিত্র তোলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ৪০০ এর বেশি মানুষকে গুম করা হয়েছে। গত দুই বছরে গুম হয়েছে ১১৭ জন। ২৮ জনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। নিখোঁজ রয়েছে ৩০ জনের বেশি। নিখোঁজ এবং গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ এসব আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে।

বাংলাদেশের চলমান এ অবনতিশীল পরিস্থিতিতে পরিবারের সঙ্গে বৃটিশ এমপি টিউলিপ এর ঘনিষ্ট যোগাযোগ এখন সবার পর্যবেক্ষণে বলেও প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়। সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ ও ক্ষমতাসীন দলের হয়ে তার লবি করার বিষয়টিও উঠে এসেছে উক্ত প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে গুম হওয়া সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামানের কন্যার সাক্ষাতকার এবং নভেম্বর মাসে চ্যানেল ফোর কর্তৃক আহমেদ বিন কাশেমের গুম হওয়া বিষয়ে টিউলিপকে প্রশ্ন করার বিষয়টি তোলে ধরা হয়। যেখানে টিউলিপ স্পষ্ট জানিয়ে দেন- গুম হওয়া ব্যক্তি তার আসনের কোনো নাগরিক না। এমনকি টিউলিপ বলেন যে, তিনি বৃটিশ এমপি, বাংলাদেশি নন। প্রতিবেদকের সাথে কথা বলার সময় সতর্ক হবার জন্যও বৃটিশ সাংবাদিকদের হুমকি দেন।

টিউলিপের বাংলাদেশের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাবার বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলি চ্যানেল ফোরকে বলেন, অবশ্যই তিনি (টিউলিপ) বৃটেনের নাগরিক এবং অন্যসব বৃটিশ এমপির মতো একজন এমপি। যেহেতু তিনি বৃটেনে মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলে থাকেন তাই তার উচিত বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়েও কথা বলা। বাংলাদেশ এবং দেশটির সরকারের সঙ্গে তার যোগসূত্র রয়েছে। দেশটিতে যেসব ঘটে যাচ্ছে তা নিয়ে তার কথা বলা উচিত।

বৃটেনের নাগরিক নন বলে আহমেদ বিন কাশেম ইস্যু নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না বলে টিউলিপ যে মন্তব্য করেছেন তারি বিরোধীতা করেছেন বেশ কয়েকজন বৃটিশ এমপি। তারা চ্যানেল ফোরকে জানিয়েছেন এ ধরনের মন্তব্য- কান্ডজ্ঞানহীন। এমনকি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অন্য দুই বৃটিশ এমপিও ( রুশনারা আলী ও রুপা হক) বাংলাদেশের গুম নিয়ে মুখ খুলেছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবাধিকার ইস্যুতে সোচ্চার ভূমিকা রাখার জন্য বৃটেন এবং তার বাইরে বিশ্ব পরিমন্ডলেও তার পরিচিতি রয়েছে। ইরানে আটক এক বৃটিশ মহিলা নাগরিকের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রভাব থাকা স্বত্তেও তিনি তা অস্বীকার করে যাচ্ছেন। বলছেন- বাংলাদেশে পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে, রাজনীতিতে তার কোনো প্রভাব নেই। আর দেশটির মানবাধিকার লংঘন ইস্যুতে তিনি একেবারেই নিশ্চুপ।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগসূত্রের বিষয়ে টিউলিপ ভোটারদের কাছে নানান মন্তব্য করে বেড়াচ্ছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। লন্ডনে স্থানীয় একপত্রিকায় দেয়া সাক্ষাতকারকে উদ্ধৃত করে চ্যানেল ফোর জানিয়েছে, টিউলিপ বলেছেন, ‘আমরা কখনোই রাজনীতি নিয়ে কথা বলি না। আমি তার (শেখ হাসিনা) সঙ্গে শুধু পারিবারিক বিষয় নিয়েই কথা বলি। আমরা রাজনীতি নিয়ে কথা বলি না।’

প্রতিবেদনে প্রশ্ন করা হয় এই বলে যে, টিউলিপ মস্কোতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাতকালে তার খালা শেখ হাসিনার সফর সঙ্গি হয়েছেন। ওয়েস্ট মিনিস্টারে তার খালাকে নিয়ে ২০ বৃটিশ এমপির সঙ্গে দেখা করেছেন। একি জায়গায় স্পিকার ব্যাকোর সঙ্গে দেখা করেছেন শেখ হাসিনাকে নিয়ে। রুশনারা আলীসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে জুন মাসে মিলিত হয়েছেন। এর সবগুলো কি শুধু পারিবারিক কারণে?

চ্যানেল ফোর এ করা প্রতিবেদন প্রসঙ্গে মন্তব্য জানতে চাইলে টিউলিপ সাম্প্রতিক সময়ে বলেন, ‘আমার কোনো সামর্থ নেই এবং ইচ্ছাও নেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো প্রভাব রাখার।’


প্রতিবেদনে বলা হয়, টিউলিপ রুটিনমাফিকভাবেই ওয়েস্টমিনিস্টারে তার খালা শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সময় দিয়ে যাচ্ছেন। এবং তার খালার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে।

২০১৫ সালে টিউলিপ যখন নতুন বৃটিশ এমপি হন তখন তার সংবর্ধনায় যোগ দিতে লন্ডন আসেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের আয়োজিত এই সংবর্ধনা সভায় টিউলিপ বলেন, ‘আপনাদের (আওয়ামী লীগের) সাহায্য ছাড়া আমি কখনোই বৃটিশ এমপি হিসেবে এখানে দাঁড়াতে পারতাম না।’


২০১৭ সালে নির্বাচনে জিতেও টিউলিপ ওয়েস্ট মিনিস্টারে মার্চ মাসে আওয়ামী লীগের এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আপনাদের (যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের) সাপোর্ট ছাড়া আমি কিন্তু নির্বাচন জিততে পারতাম না’।

প্রতিবেদনে বলা হয়, লেবার দল থেকে এমপি নির্বাচিত হবার পূর্বেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিউলিপের জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে। ২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি টিউলিপের টুইটের একটি স্ক্রীন প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়, যাতে লেখা আছে, আজকে আমি প্রধানমন্ত্রী অফিস এবং দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি অনুষ্ঠানে উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি। এবিষয়ে টিউলিপের মন্তব্য জানতে চাইলে তা পাওয়া যায়নি এবং প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ হাইকমিশনও এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেনি।

টিউলিপ বরাবরই বলে যাচ্ছেন তিনি তার আসনের বাইরের কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলবেন না। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারও গুম এবং হত্যাকান্ড সংঘটিত হবার বিষয়ে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে যাচ্ছে।

হ্যাম্পস্টেড এর একজন সাবেক এমপি চ্যানেল ফোরকে বলেন, টিউলিপ তারা খালা (শেখ হাসিনা)’র নিষ্ঠুর সরকারের সঙ্গে পারিবারিক ঘনিষ্টতার কারণেই সমঝোতা করে নিয়েছেন।

(জাস্ট নিউজ/জিএস/১৯৪০ঘ)