৪২ সাবেক সচিবের বৈঠক, তুমুল আলোচনা

৪২ সাবেক সচিবের বৈঠক, তুমুল আলোচনা

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের আমন্ত্রণে ৪২ জন সাবেক সচিবের হঠাৎ বৈঠক নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। সরকার, প্রশাসন, রাজনৈতিকঅঙ্গনসহ বিভিন্নমহলে বিষয়টি নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে সাবেক সচিবদের এ ধরনের বৈঠক আলোচনায় ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে।

২৭ জানুয়ারি সোমবার বিকেলে শিল্পকলা একাডেমির এক সভাকক্ষে এ বৈঠক ডাকা হয়েছিলো। দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের আলোকে সাবেক সচিবদের ‘থিংক ট্যাংক’ হিসেবে কাজে লাগাতে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠনই এই বৈঠকের উদ্দেশ্য বলে আয়োজক ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।

এই বৈঠকে একটি ফোরাম বা সংগঠন করার বিষয়ে একমত হয়েছেন সরকারের অবসরপ্রাপ্ত শীর্ষ কর্মকর্তারা। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও তার ফলাফলকে ত্বরান্বিত করতে তাঁদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগাতে চান তাঁরা। সাবেক সচিব শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদারের সভাপতিত্বে আয়োজিত বৈঠকে এমন মতই প্রকাশ করেন দুদক চেয়ারম্যানসহ ৪২ সাবেক সচিব।

সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য সাবেক সচিবদের চিঠি দেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। খ্রিষ্টীয় নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে দেওয়া এ চিঠিতে ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘জীবনের এক বড় সময় আপনি দেশ ও জাতির সেবায় নিয়োজিত থেকেছেন। এ সেবা দেওয়ার সময় অর্জন করেছেন বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা, গ্রহণ করেছেন দেশে-বিদেশে নানা প্রশিক্ষণ, প্রত্যক্ষ করেছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাঁকবদল।

এ ছাড়া আপনার রয়েছে চমৎকার শিক্ষাগত যোগ্যতার পটভূমি। এসবের মিথস্ক্রিয়ায় আপনি ধীরে ধীরে হয়েছেন ঋদ্ধ, পরিণত ও প্রাজ্ঞ। আপনার অর্জিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা দেশের নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও তার ফলাফলকে ত্বরান্বিত করতেও পারে। দেশ ও জাতি এগিয়ে যেতে পারে সবার ইতিবাচক সম্মিলিত প্রয়াসের মধ্য দিয়ে।’ এই সম্মিলিত প্রয়াসের উপায় ও ধরন কী হওয়া উচিত বা সাবেক সচিবদের সমন্বয়ে কোনো একটি প্ল্যাটফর্ম করা যায় কি না, তা আলোচনার জন্য তিনি এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন।

বৈঠকে ৭৩,৭৭, ৭৯,৮১, ৮২ ও ৮২ (বিশেষ), ৮৪ ব্যাচের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যায়। সাবেক সচিব নজরুল ইসলামকে আহ্বায়ক ও হেদায়েতুল্লাহ আল মামুনকে সদস্যসচিব করে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন গণমাধ্যমকে বলেছেন, সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সচিবদের জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দেশ ও সমাজের কল্যাণে কাজে লাগানোর জন্য এ সংগঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি হবে একটি গবেষণা ও সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান।

বৈঠকটি গোপন ছিল কি না জানতে চাইলে আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘না, আমরা এ বিষয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। আমার স্বাক্ষরে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি তথ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এখন তারা গণমাধ্যমে পাঠিয়েছে কি না, তা আমার জানা নেই।’ তবে সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন তথ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কোনো বেসরকারি ব্যক্তি বা সংগঠনের খবর পিআইডি প্রচার করতে পারে না। পিআইডির কাজ সরকারের খবর প্রচার করা।

এদিকে সম্ভাব্য থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদকে প্রধান করে ওই সংগঠনে গঠনতন্ত্র তৈরির জন্য আরেকটি কমিটি করা হয়েছে। গঠনতন্ত্রের বিষয়ে আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা আমাদের অভিজ্ঞতাকে রাষ্ট্রের কাজে লাগাব। তাই সব সাবেক সচিবের অংশগ্রহণেই হবে এ সংগঠন। প্রথমে একটি খসড়া তৈরি করে সবার ই-মেইলে দেওয়া হবে। তারপর সবার মতামত নিয়ে এর গঠনতন্ত্র তৈরি করা হবে।’

তবে প্রশাসনের একটি সূত্র বলছে, এ ধরনের ফোরাম গঠনের উদ্দেশ্য হতে পারে সরকার ও প্রশাসনের বিভিন্ন কাজে ও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করা। এই সভা ও দুদক চেয়ারম্যানের চিঠি দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, প্রথমত, দুদক চেয়ারম্যানের এ ধরনের চিঠি দেওয়া অনৈতিক। দ্বিতীয়ত, তাঁরা সব সাবেক সচিবকে আমন্ত্রণ জানাননি। ফলে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যে এই সভা করা হয়েছে, তা পরিষ্কার।

চিঠির বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, তিনিও অবসরপ্রাপ্ত একজন সচিব। আর এটা ছিল পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান। এর বাইরে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

সাবেক কয়েকজন সচিব মনে করেন, ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রাক্কালে এ ধরনের বৈঠক, সাদা কাগজে দুদক চেয়ারম্যানের আমন্ত্রণ এবং একই আদর্শে বিশ্বাসী সব সচিবকে এক হওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তাঁরা বলেছেন, যাঁরা সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন, তাঁরাই উপস্থিত ছিলেন। সভায় উপস্থিত সাবেক সচিব খন্দকার শওকত হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা যাঁরা সচিব ছিলাম, তাঁরা একত্র হয়েছিলাম। সেখানে একটি ফোরাম গঠনের বিষয়ে সবাই একমত পোষণ করেছেন।’

তবে বৈঠকটিকে যতোই সাদামাটা হিসেবে উপস্থাপন করা হোক না কেন- সাবেক সচিব ও বিশ্লেষকরা এটিকে সাদা চোখে দেখতে রাজি নন। তারা বলছেন, এই বৈঠকটি যাদের নিয়ে হয়েছে তারা সরকার সমর্থক দলের অনুসারী হিসেবেই পরিচিত। এরা সবাই সরকারের সুবিধাভোগী। বলা হচ্ছে- তাদের এই বৈঠক নিয়ে যাতে কোনো সন্দেহ তৈরি না হয় সেজন্য আগেই সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে বিষয়টি জানানো হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দুদক চেয়ারম্যান সাবেক সচিব হলেও দুদকের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থার পদে থেকে এই ধরনের বৈঠক আয়োজন করা স্বাভাবিক বিষয় নয়। বলা হচ্ছে- নিজে চিঠি দিয়ে এই সভা আয়োজন করলেও উনি কোনো পদে থাকছেন না। সম্ভাব্য থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদকে। কেবলমাত্র গত মাসেই তিনি ওই পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। আবুল কালাম আজাদকে আওয়ামী লীগ তথা সরকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবে মনে করা হয়। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার একচ্ছত্র প্রভাব ছিলো। বিষয়টি কমবেশি সকলেই জানেন। যে কারণে চাকরির মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও একাধিকবার তিনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগেই ছিলেন। কিন্তু এই মেয়াদের পর তাকে আর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে দেখা যায়নি। এটি একটি বড় আলোচনার বিষয়ও ছিলো এবং এতে অনেকে অবাকও হয়েছেন। সরকারের নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখা এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতায় সাবেক সচিবদের একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম বা বৈঠক সাদামাটাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

এর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রশাসনের তিন শতাধিক সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন। সাবেক ওই আমলাদের নেতৃত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।

বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের পদমর্যাদায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। অথচ কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর মতো সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির এই বৈঠকে কোনো ভূমিকা ছিলো না। তবে বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন এমন একজন সাবেক সিনিয়র সচিব বলেছেন, অন্য কোনো বিষয় নেই। নিজেরা নিজেদের মধ্যে একটি ফোরাম করাই এর উদ্দেশ্য। সিএসপিদেরও একটি ফোরাম আছে।

সূত্র বলছে, বৈঠকে বলা হয়েছে সরকারের হাতকে শক্তিশালী করতে এটি করা হবে। তবে সরকারের হাত দুর্বল আছে কি না? সেই প্রশ্নও সভায় তুলেছেন অংশগ্রহণকারীদের একজন।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- সাবেক সচিব সোহরাব হোসাইন, মিজানুর রহমান, এ এস এম রশিদুল হাই, আতাউর রহমান, সিরাজুল হক, ইব্রাহীম হোসেন খান, সি কিউ কে মুশতাক, মোহাম্মদ মইনুদ্দিন আবদুল্লাহ, এম এ কাদের সরকার, মিকাইল শিপার, সেলিনা আফরোজ, শহিদুল হক, কাজী আখতার হোসেন, মাহবুব আহমেদ, আবদুল হান্নান প্রমুখ।