ফসলের সর্বনাশ

ফসলের সর্বনাশ

রুদ্ররূপে আসেনি ঘূর্ণিঝড় ফণী। মহাদুর্যোগের আশঙ্কা থাকলেও শেষ পর্যন্ত দুর্বল গতি নিয়ে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার বোরো ধান ও ফসলের ক্ষেতে ধ্বংসচিহ্নের মানচিত্র এঁকেছে ফণী। এর প্রভাবে বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাসে ধান, আলু, পেঁয়াজ, আম, লিচু, তরমুজ, সূর্যমুখী, ফুলক্ষেত, বাদাম, ভুট্টা, কাঁচামরিচ, পানের বরজ, কলাগাছ, শাকসবজিসহ অন্যান্য মৌসুমি ফসল নষ্ট হয়েছে। প্রবল বাতাসে মাটির সঙ্গে লেপটে গেছে ধান। অতিবৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে আধাপাকা বোরো ফসল। বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে পুকুর ও ঘের থেকে ভেসে গেছে মাছ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড় ফণীর তাণ্ডবে প্রায় ৩৬ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমির বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ১৩ হাজার হেক্টর জমির রবিশস্য নষ্ট হয়েছে। কৃষকরা আতঙ্কে প্রায় ৯ লাখ হেক্টর জমির আধাপাকা বোরো ধান কেটেছেন। কৃষকের পাকা ধানের মাঠে যেন মই দিয়েছে ঘূর্ণিঝড় ফণী। ফণীর ছোবলে কৃষকের অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে বৃহস্পতিবার ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে মাঠে ৮০ ভাগ পাকা বোরো ধান কাটতে এবং ভুট্টা, বাদামসহ পরিপকস্ফ সব ফসল ঘরে তুলতে কৃষকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ-সংক্রান্ত আদেশ জারির পর স্থানীয় পর্যায়ে মাইকিং করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এতে আতঙ্কিত হয়ে কৃষকরা প্রায় কাঁচা ধান ও মাঠের অপরিপকস্ফ ফসল কাটা শুরু করেন। তাড়াহুড়া করে ধান কেটে কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। যারা ধান কেটেছেন তারা বাজারে ধানের দাম পাচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে লোকসানে ধান বিক্রি করছেন।

বরিশালের জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান জানান, ফণীর প্রভাবে ৯ হাজার ৫৩ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড়ে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলায় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ অঞ্চল। এতে জোয়ারের পানিতে ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। তলিয়ে গেছে মাঠের ফসল। অনেক এলাকায় কৃষক কাঁচা ধানই কাটছেন। চোখের সামনে স্বপ্নের ধান নষ্ট হলেও কৃষক কিছুই করতে পারছেন না। নওগাঁয় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝালকাঠির রাজাপুরে ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩-৪ ফুট উচ্চতায় নদীর পানি প্রবাহিত হয়। এতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। রাজশাহী অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে মাঠের পাকা ধান, আম ও লিচুর ক্ষতি হয়েছে।

বগুড়ার নন্দীগ্রামের কৃষক আবু তাহের জানান, ঝড় ও বৃষ্টিতে পাকা ধান মাটিতে নুয়ে পড়ে পানির ওপর ভাসছে। ঘাম ঝরানো ধান ঘরে তোলার আগেই সব শেষ। ধানের সঙ্গে মরিচ, বেগুনসহ বিভিন্ন ধরনের সবজির ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। ধান ও সবজি দুটি ফসল একসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কৃষকরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন।

রাজশাহীর তানোর পৌরসভার চাপড়া এলাকার কৃষক সাইদুর রহমান জানান, তার সাড়ে চার বিঘা জমির পাকা ধানের মধ্যে দুই বিঘা জমির ধান কাটা হয়েছিল। অবশিষ্ট দুই বিঘা জমির ধান কাটার প্রস্তুতি চলছিল। এরই মধ্যে ফণীর প্রভাবে বৃষ্টি ও দমকা হাওয়ায় দুই বিঘা জমির পাকা ধান মাটিতে শুয়ে পড়েছে। গোল্লাপাড়া এলাকার কৃষক ওহাব সরদার জানান, কৃষি বিভাগের সতর্কবার্তা পাওয়ার পর আট বিঘা জমির ধান কাটতে পেরেছেন। আরও ১৪ বিঘা জমির পাকা ধান কাটতে পারেননি বৃষ্টির কারণে।

ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলের ২ হাজার হেক্টর ফসলি জমি; পিরোজপুরের ইন্দুরকানী, কালাইয়া, বালিপাড়া, চরবলেশ্বরসহ উপকূলবর্তী ৮ গ্রাম ডুবে যাওয়ায় মুগডাল, মরিচ ও মৌসুমি সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বরগুনার আমতলীতে দুই শতাধিক পানের বরজ নষ্ট হয়েছে। কুড়িগ্রামের কাঁঠালবাড়ীর আলুচাষি মহিউদ্দিন সরকার বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বৃষ্টিতে ক্ষেতে পানি জমে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ময়মনসিংহের ফুলপুরের কৃষক জমির উদ্দিন বলেন, তরমুজ ও সবজির ক্ষেতে হাঁটুপানি জমেছে। এ অবস্থা আর একদিন থাকলে সব পচে নষ্ট হবে। শ্রমিকের অভাবে তো ক্ষেতের ধান কাটতেই পারলাম না। ঘূর্ণিঝড় আমাদের পথ বসাবে।

নেত্রকোনার দুর্গাপুরের চিতলী বিলের কৃষক আবু সামা বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বৃষ্টিতে বিল পানিতে ভরে গেছে। তার তিন একর জমির ধান তিন দিন ধরে পানির নিচে। কেউ কেউ সাঁতরিয়ে পানিতে ডুব দিয়ে ধান কাটছে। পানি না কমলে ধান কাটা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।

সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের কৃষক আহমদ আলী জানান, এবার ২৩ একর জমিতে ধান লাগিয়েছিলেন। ঘূর্ণিঝড়ের আগে প্রায় ১০ একর জমির ধান কেটেছিলেন। রোদ না থাকায় সে ধান নষ্ট হওয়ার পথে। বাকি ধান বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে।

কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক ড. নূরুল ইসলাম বলেন, আগাম সতর্কবার্তা দেওয়ায় কৃষকরা ৮০ শতাংশ পাকা ধান ও অন্যান্য ফসল ঘূর্ণিঝড়ের আগেই ঘরে তুলেছেন। ফলে ক্ষতি কম হবে। বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে ধান ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি জানান।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক ড. আব্দুল মুয়িদ বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের আগেই আমরা ধান কাটার বার্তা দিয়েছিলাম কৃষকদের। কৃষকরা মাঠের ফসল ঘরে তোলেন। ঝড়ের আগে সারাদেশে বোরো ধানের প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কাটা শেষ হয়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ঝড়ো বাতাস ও বৃষ্টিতে সারাদেশে কিছু ধান ও অন্যান্য ফসলের ক্ষতি হয়েছে। সারাদেশের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য জানতে আমরা তথ্যকেন্দ্র চালু করেছি।

এমজে/