কৃষকদের জমি দখল করে চেয়ারম্যানের বাগানবাড়ি

কৃষকদের জমি দখল করে চেয়ারম্যানের বাগানবাড়ি

নরসিংদীর মেহেরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবুল হাসানের বিরুদ্ধে চৌয়া গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের কয়েক বিঘা ফসলি জমি জবরদখলের অভিযোগ উঠেছে। সেখানে তৈরি করা হয়েছে বিলাসবহুল বাগানবাড়ি। যারা জমি দিতে রাজি হননি তাদের ওপর চলে নানা নির্যাতন। শুধু কৃষকই নন, চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন ইউপি সদস্যরাও।

জানা গেছে, এক সময় ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের নেতা ছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান মাহবুবুল হাসান। পরে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ২০১৫ সালে তাকে মেহেরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। তার এক বছরের মাথায় অর্থাৎ ২০১৬ সালে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মাহবুবুল হাসান। এর পর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

স্থানীয়দের অভিযোগ, চেয়ারম্যান মাহবুবুল হাসানের বাগানবাড়িটি প্রায় ৬ বিঘা জমির ওপর নির্মিত। এর মধ্যে একাধিক হতদরিদ্র কৃষকের ফসলি জমি রয়েছে। জবরদখলে বাধা বা পুলিশের কাছে অভিযোগ জানালেও কৃষকদের ওপর নেমে আসে হামলা-মামলাসহ অমানবিক নির্যাতন। বাড়িতে ঢোকার সুবিধার্থে ইউনিয়ন পরিষদের টাকায় তৈরি করেছেন পাকা সড়কও। চৌয়া গ্রামের আবুল হোসেন বলেন, ‘চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই বিপদ নেমে আসবে। জেলে পচে মরব। পরে বউ-বাচ্চা না খেয়ে মরবে। তাই মুখ বুজে সব সহ্য করি।’

গ্রামের বাসিন্দা রহিমা বেগম বলেন, ‘বাগানবাড়ি তৈরির জন্য আমার তিন কানি জমি দখল করেছেন চেয়ারম্যান। যে জায়গাটিতে পুকুর খনন করেছেন সেটি আমার। পারিবারিক বিষয় নিয়ে বিচারের নাম করে আমার স্বামী ও ছেলেকে অনেক মারধর করে চেয়ারম্যান। পরে নগদ ৭০ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করেন। কিন্তু এত টাকা দেব কীভাবে? তখন চেয়ারম্যান আমার তিন কানি জায়গা তার কাছে বিক্রি করতে বলেন। আমি বললাম এ জমি বিক্রি করব না। তখন ভাড়া দিতে বলেন, তাতেও রাজি না হওয়ায় জোর করেই জমিটি দখলে নিয়ে পুকুর খনন করেন।’

কৃষক মো. জাহাদ আলী বলেন, ‘বাগানবাড়িটির ভেতরে আমার সাড়ে ১৫ শতাংশ বসতভিটা রয়েছে। চেয়ারম্যান আমাকে ডেকে নিয়ে জমিটি তাকে লিখে দিতে বলেছিলেন। আমার বাড়ির জন্য নাকি তার বাগানবাড়ির পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু জায়গাটি লিখে দেইনি বলে আমার বাড়ির চতুর্দিকে বেড়া দিয়ে রেখেছেন। এখন বাড়ি নির্মাণের জন্য ইটা-বালু কোনো কিছুই আনা যাচ্ছে না। রাস্তার মধ্যে ইটের ট্রাক আটকে দিচ্ছে চেয়ারম্যানের লোকজন। বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে লাইন দিচ্ছে না।’

মুজিবুর রহমান নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমার সাড়ে ২২ শতাংশ জমির মধ্যে ১৪ শতাংশই দখল করে বাগানবাড়ির পুকুর খনন করেছেন চেয়ারম্যান। আমাকে একবার মুখের কথাটুকুও বলেননি তিনি।’ আসিয়া বেগম নামে আরও একজন বলেন, ‘চেয়ারম্যানের দখলদারিত্বের হাত থেকে রক্ষা পায়নি আমাদের বসতভিটাটুকুও। ওনার বাড়িতে গিয়ে হাতে-পায়ে ধরেছি কিন্তু মন গলেনি। উল্টো বলেছেন, আমাদের বাড়ি থাকলে নাকি তার বাগানবাড়ির পরিবেশ নষ্ট হবে। এখন আমরা কী করব বলেন।’

এর আগেও জমি দখল করে নেওয়ায় চেয়ারম্যান মাহবুবুলের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন দেলোয়ার হোসেন নামে এক ভুক্তভোগী। এমনকি তার নানা অনিয়ম তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী ও খোদ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চার সদস্য। এর পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।

এ বিষয়ে দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘১৯৮৪ সাল থেকে আমি আওয়ামী লীগ করি। অথচ চেয়ারম্যান আমার জমিও দখল করে নিয়েছে। পুলিশ ও জেলা প্রশাসনসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ে বারবার অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি।’ স¤প্রতি চাঁদা দাবির অভিযোগেও চেয়ারম্যান মাহবুবুল হাসান ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ সুপারের দপ্তরে লিখিত দিয়েছেন মাধবদীর দক্ষিণ চৌয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আবদুুল মতিন। এ বিষয়ে মাধবদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু তাহের দেওয়ান বলেন, ‘বিষয়টির তদন্ত চলছে। অভিযোগের প্রমাণ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য দানিছুর রহমান দানা বলেন, ‘চেয়ারম্যান যে বাগানবাড়িটি করছেন, সেখানে অল্প কিছু জায়গা কিনেছেন তিনি। বাকিগুলো জোরপূর্বক দখল করে রঙ্গমঞ্চ ও জলসাঘর তৈরি করছেন। ওনার পেশিশক্তি বেশি। সব সময় সাধারণ জনগণকে হুমকির ওপর রাখেন। এমনকি স্কুলের জায়গা দখল করে গড়ে তুলেছেন দলীয় কার্যালয়। তার বিরুদ্ধে মুখ খোলা যায় না।’

তবে সব অভিযোগ ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি করে মেহেরপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান মাহবুবুল হাসান বলেন, ‘আমার নিজস্ব এবং ক্রয়কৃত জমিতেই বাগানবাড়ির কাজ করছি। সেখানে দুই বিঘা জমি ভাড়া নিয়েছি। আসলে ব্যক্তিগত হিংসা চরিতার্থে আমার প্রতিপক্ষরা ষড়যন্ত্র করে বিভিন্ন মাধ্যমে এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে তার কোনো প্রমাণ তারা দেখাতে পারবে না।’ কোনো অন্যায় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন বলেও দাবি করেন চেয়ারম্যান মাহবুবুল হাসান। সুত্র: আমাদের সময়।