ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে দফায় দফায় পিটিয়ে হত্যা করা হয় আবরারকে

ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে দফায় দফায় পিটিয়ে হত্যা করা হয় আবরারকে

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রবিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে বুয়েটের শের-ই–বাংলা হলের নিচতলা থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হলের শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন।

মারা যাওয়া আবরার ফাহাদ বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি কুষ্টিয়া শহরে।

হলের শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, গতকাল রাত আটটার দিকে আবরার–ফাহাদসহ দ্বিতীয় বর্ষের ৭-৮ জন শিক্ষার্থীকে শের–ই–বাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে পাঠান তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ৭-৮ জন নেতা। তারা আবরার ফাহাদের মুঠোফোন চেক করে শিবির-সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ খোঁজেন। একপর্যায়ে ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে তাকে পেটাতে শুরু করেন তারা। পরে চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী ওই কক্ষে গিয়ে আবরারকে আরেক দফায় পেটান। এতে তার মৃত্যু হলে রাতে সহপাঠীদের ডেকে লাশ সিঁড়ির নিচে রাখতে বলা হয়।

ঘটনার সময় ২০১১ নম্বর কক্ষে উপস্থিত বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আশিকুল ইসলাম ওরফে বিটু দাবি করেন, ‘রাত আটটার দিকে আবরার ফাহাদকে ২০১১ নম্বর কক্ষে ডাকা হয়। আমি মাঝে মাঝে ওই কক্ষে বন্ধুর কাছে যাই। গতকাল রাতে গিয়ে দেখতে পাই, সেখানে আবরার ফাহাদের ফেসবুক আইডি ও মেসেঞ্জার চেক করা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে শিবির-সংশ্লিষ্টতার কিছু প্রমাণও পাওয়া যায়। রাত পৌনে নয়টার দিকে আমি কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসি। পরে সেখানে কী হয়েছে, আমি জানি না।

‌‘নিজের কক্ষে গিয়ে পড়াশোনা ও আড্ডা দিয়ে রাত একটার দিকে ওই কক্ষে রেখে আসা নিজের ল্যাপটপ ও বই আনতে গেলে আবরারকে পড়ে থাকতে দেখি। তখন সেখানে আর কেউ ছিল না।’

হল শাখা ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, আবরারকে জেরা ও পেটানোর সময় ওই কক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপ-সম্পাদক ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র অমিত সাহা, উপদপ্তর সম্পাদক ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র মুজতাবা রাফিদ, সমাজসেবা বিষয়ক উপ-সম্পাদক ও বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ইফতি মোশারফ ওরফে সকালসহ তৃতীয় বর্ষের আরো কয়েকজন শিক্ষার্থী ছিলেন। ওই কক্ষে এসে দ্বিতীয় দফায় আবরারকে পেটান বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অনিক সরকার, ক্রীড়া সম্পাদক ও নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একই বর্ষের মেফতাহুল ইসলাম জিয়নসহ কয়েকজন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, পেটানোর পর আবরারের মৃত্যু হলে রাতে তার সহপাঠীদের ডেকে লাশ নিচতলার সিঁড়ির সামনে রাখা হয়।

হলের দারোয়ান মোহাম্মদ মোস্তফা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সিঁড়ির পাশের সিসিটিভি ফুটেজটি নষ্ট। কোনো আওয়াজ বা হইচই শুনিনি। এই অংশের সিসিটিভি কয়েক দিন থেকে এলোমেলো।’

ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় শের–ই–বাংলা হলে গিয়ে দেখা যায় হল ক্যানটিনে আবরারের লাশ রাখা। আবরারের সহপাঠীদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলেও তাঁরা কিছু বলতে রাজি হননি। কিছুক্ষণ পর হলের সিসিটিভি ফুটেজ শিক্ষার্থীদের সামনে দেখানো হলেও রাত ২টা ৬ মিনিটের পর সিসিটিভি ফুটেজে কী রয়েছে, তা দেখানো হয়নি। যে কক্ষে (২০১১ নম্বর) আবরারকে পেটানো হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেখানে গিয়েও কাউকে পাওয়া যায়নি।

ভোরে ঘটনাস্থলে আসেন নিহত আবরারের মামাতো ভাই একটি দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক আবু তালহা রাসেল। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আবরারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা একদমই সত্য নয়। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নে। আওয়ামী লীগের পাঁচজন সমর্থক থাকলে তাঁর বাবা বরকতউল্লাহ তাঁদের একজন। আমরা এই হত্যার বিচার চাই।’

ঘটনার বিষয়ে হল প্রাধ্যক্ষ জাফর ইকবাল খান বলেন, রাত পৌনে তিনটার দিকে খবর পাই যে এক শিক্ষার্থী হলের সামনে পড়ে আছেন। কেন সে বাইরে গিয়েছিল, কী হয়েছিল, তা এখনও জানা যায়নি। তাৎক্ষণিকভাবে বুয়েটের চিকিৎসক দিয়ে তাকে পরীক্ষা করা হয়। ওই চিকিৎসক জানান তিনি বেঁচে নেই। পরে পুলিশকে খবর দিই। পুলিশ এসে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।

তবে ঘটনাস্থলে আসা পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলের অনুসারীরাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে ধারনা করা হচ্ছে।

বুয়েটের চিকিৎসক মাশরুক এলাহী বলেন, খবর পেয়ে তিনটার সময় ঘটনাস্থলে আসি। একতলা ও দোতলার মাঝামাঝি জায়গাতে আবরারকে পড়ে থাকতে দেখি। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বুঝতে পারি ছেলেটি বেঁচে নেই।

কী কারণে আবরারের মৃত্যু হয়েছে—জানতে চাইলে মাশুক এলাহী বলেন, ‘আঘাতজনিত কারণে সে মারা গেছে। সেই সম্ভাবনাই বেশি।’

চকবাজার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) দেলোয়ার হোসেন বলেন, রাত পৌনে ৩টার দিকে তাঁরা খবর পান শের-ই বাংলা হলের বাইরে নিচতলায় ছেলেটা পড়ে আছে। হল কর্তৃপক্ষই পুলিশকে খবর দেয়। খবর পেয়ে তিনটার দিকে ঘটনাস্থলে যান তাঁরা। ছেলেটির পরনে ছিল ট্রাউজার ও শার্ট।

আঘাতের চিহ্নের কথা উল্লেখ করে দেলোয়ার হোসেন বলেন, আঘাত কোনো অস্ত্রের নয়। কোনো কিছু দিয়ে বাড়ি দেওয়া হয়েছে। লাশের ময়নাতদন্ত হবে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।