রাবিতে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকেও দুর্নীতি

রাবিতে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকেও দুর্নীতি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক’ নির্মাণে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি। নির্মাণ কাজে আর্থিক অস্বচ্ছতা, এক হাজার ৪০০ কেজি তামার পরিবর্তে মাত্র ৪৯২ কেজি ব্যবহার করা, অর্থ দপ্তরকে সময়মতো হিসাব না দেওয়ার তথ্য কমিটি তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে। এ ছাড়া স্মৃতিফলকে শেখ মুজিবকে অবমাননার অভিযোগও করা হয়েছে। তবে তদন্ত কমিটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে তার বিরুদ্ধে অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে বলে দাবি করেছেন নির্মাণ কমিটির প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম।

সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫৯তম সিন্ডিকেট সভায় শহীদ তিন শিক্ষক হবিবুর রহমান, মীর আব্দুল কাইয়ুম ও সুখরঞ্জন সমাদ্দার স্মরণে একটি বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক নির্মাণের সিদ্ধান্ত পাস হয়। স্মৃতিফলকটির নির্মাণ প্রস্তুতিকল্পে ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মুশফিক আহমদকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মিজানউদ্দিনের প্রশাসন। ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি তৎকালীন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহানকে স্মৃতিফলক নির্মাণ কাজের সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একই বছরের ৬ আগস্ট ১১ সদস্যের একটি নির্মাণ কমিটি করা হয়। যার প্রধান ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম।

এই কাজের শুরু থেকে কমিটির বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। একইসঙ্গে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক নামে তৈরি হলেও এতে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থ্‌াপন করা হয়। যেখানে তিন বুদ্ধিজীবীকে ওপরে এবং মূল নকশার বাইরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রিলিফ ভাস্কর্য বাঁ দিকে তুলনামূলক নিচে স্থাপন করা হয়। এরপর থেকেই বঙ্গবন্ধুকে অবমাননাসহ এটি নিয়ে আরও বিতর্ক শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭৩তম সিন্ডিকেট সভায় ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহানের প্রশাসন। সম্প্রতি তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, স্মৃতিফলক নির্মাণের জন্য ২০১৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭০তম সিন্ডিকেট সভায় ৮২ লাখ ৬৫ হাজার ১৬১ টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে স্মৃতিফলকের জন্য খোলা ব্যাংক হিসাবে ৭৬ লাখ ৫৮ হাজার ৯১৫ টাকা জমা হয়। ১৯টি চেকের মাধ্যমে জমা হওয়া টাকার মধ্যে ৭৬ লাখ ৪৮হাজার ৪১৫ টাকা তোলেন নির্মাণ কমিটির ১ নম্বর সদস্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম। ওই টাকা ব্যয়ের সঠিক বিল বা ভাউচার তদন্ত কমিটিকে দেখাতে পারেননি অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম। এ ছাড়া সিন্ডিকেট সভায় প্রতি ১০ লাখ টাকা উত্তোলনের পর সেসব বিল বা ভাউচার অর্থ দপ্তরের মাধ্যমে সমন্বয় করে পরবর্তী চাহিদাপত্র দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হলেও অধ্যাপক সুলতান তা করেননি। এমনকি এখনও তদন্ত কমিটির কাছে দাখিল করতে পারেননি বলে জানা যায়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকে এক হাজার ৪০০ কেজি তামা ব্যবহারের কথা ছিল, যার মূল্য ১৪ লাখ টাকা। অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম সাড়ে ৮ লাখ টাকা দিয়ে মাত্র ৮৫০ কেজি তামা কেনেন। এর মধ্যে আবার ২০-২৫ শতাংশ ওয়েস্টেস দেখানো হয়েছে। কাস্টিংয়ের সময় নষ্ট হয়েছে আরও ১২০ কেজি এবং অন্যান্যভাবে নষ্ট হয়েছে ২৬ কেজি। ফলে স্মৃতিফলকটিতে ৪৯২ কেজি তামা ব্যবহার করা গেছে, যার মূল্য চার লাখ ৯২ হাজার টাকা। এ ছাড়াও তিন লাখ ৬০ হাজার টাকার টেম্পার্ড গ্লাস ব্যবহার করার কথা থাকলেও সেটি ব্যবহারের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

তবে প্রশাসনের কথামতো ব্যক্তি আক্রোশে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করে নির্মাণ কমিটির প্রধান অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, আড়াই বছর আগে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তদন্ত কমিটির কাছে জানতে চেয়েছি- এ কমিটি কোনো ব্যক্তির বিরুব্দ নাকি আমাদের কমিটির বিরুদ্ধে? তাদের কাছে আমার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ, সেটি জানতে চেয়েছি, কিন্ত আড়াই বছরে তারা মাত্র একবার আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। বর্তমান প্রশাসন আমাদের টাকা না দেওয়ায় আমরা সবার পাওনা শোধ করতে পারিনি। সে জন্য সব হিসাব দিতে পারিনি। তদন্ত কমিটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে আমার বিরুদ্ধে অসত্য ও বিভ্রান্তকর তথ্য ছড়াচ্ছে। তা ছাড়া এর কাজ তো ব্যক্তি সুলতান-উল-ইসলাম একা করেননি, এর সঙ্গে কয়েকটি ছোট গ্রুপে কাজ হয়েছে, তাহলে আমি একা কীভাবে এটি করলাম? ১৯টি চেক উত্তোলন করলেও এসব চেক তৎকালীন উপ-উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষরে তোলা হয়েছে। তাছাড়া তামার বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আমরা সিন্ডিকেটে গ্রহণ করেছি। এ ধরনের অপরাধের জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায় বা কীভাবে প্রতিকার করা যায়, সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের লিগ্যাল (আইন) সেলের মতামত চেয়েছি। আশা করি, এ মাসের শেষের দিকে সে মতামত পেয়ে যাব। তাদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে সিন্ডিকেট ব্যবস্থা নেবে।

রাবির সব দুর্নীতির বিচার দাবি :রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকে বঙ্গবন্ধুকে অবমাননার অভিযোগ এনে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে ঢাকায় অতিথি ভবন কেনার নামে ১০ কোটি টাকার দুর্নীতিসহ সব অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তের মাধ্যমে বিচারের দাবি উঠেছে।

রবিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবন চত্বরে আয়োজিত মানববন্ধনে বক্তারা এ দাবি জানান। মানববন্ধনের আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ।

বক্তারা বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকের রিলিফ ভাস্কর্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ছিল না। তবে মূল কাজে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। ভাস্কর্যে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বাঁ পাশে এবং নিচে বঙ্গবন্ধুর রিলিফ ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যম জাতির পিতাকে অবমাননা করা হয়েছে। যেটি কোনো প্রগতিশীল শিক্ষকদের কাজ হতে পারে না।

তারা আরো বলেন, কয়েকদিন ধরে কিছু শিক্ষক বর্তমান প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। তারা নিজেদের প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের একাংশ বলে পরিচয় দিচ্ছেন। আমাদের দলের সদস্য ছয় শতাধিক, অথচ আন্দোলন করছেন মাত্র ৩০-৪০ জন শিক্ষক। তাহলে এই গুটিকয়েক শিক্ষক দলের একাংশ হয় কী করে?

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের আহ্বায়ক অধ্যাপক এম মজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে এতে বক্তব্য দেন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন মিশ্র, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সরকার সুজিত কুমার, টিএসসিসির পরিচালক অধ্যাপক হাসিবুল আলম প্রধান প্রমুখ। মানববন্ধন সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক আব্দুল গণি।