ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভব্যতা নিয়ে প্রশ্ন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভব্যতা নিয়ে প্রশ্ন

ঢাকা, ২০ এপ্রিল (জাস্ট নিউজ) : কোটা সংস্কার আন্দোলনের জের এখনো থামেনি৷ সেই জেরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের একটি হলের তিন শিক্ষার্থীতে মধ্যরাতে বের করে দিয়েছে হল কর্তৃপক্ষ৷ এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে৷ প্রশ্ন উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভব্যতা নিয়েও৷

বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টার আগে ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সুফিয়া কামাল হলের তিন ছাত্রীকে বের করে দেয় হল কর্তৃপক্ষ৷ তাদের স্থানীয় অভিভাবকদের ডেকে ঐ তিন ছাত্রীকে নিয়ে যেতে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ৷ এই তিন ছাত্রী হলেন গণিত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শারমীন শুভ, থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী কামরুন্নাহার লিজা এবং গণিত বিভাগের পারভীন৷ এদের বের করে দেয়ার সময় তারা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে চাননি৷ একজন অভিভাবক শুধু বলেন, আমাদের কথা বলতে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে৷

সুফিয়া কামাল হলের প্রাধ্যক্ষ ড. সবিতা রেজওয়ানা রহমান শুক্রবার ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেন, “তাদের বের করে দেয়া হয়নি, বরং অভিভাবকদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে৷ তাদের অভিভাবকদের বিকালেই ডাকা হয়৷ তারা আসার পর প্রথমে মেয়েদের কাউন্সেলিং করা হয়৷ এতে রাত হয়ে যায়৷ তিনজনকে সেকারণেই রাতে তাদের অভিভাবকদের হাতে তুলে দেয়া হয়৷ আরো একজনকে অভিভাবকের হাতে তুলে দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু সে না আসায় দেয়া যায়নি৷”

প্রভোস্ট দাবি করেন, “এই ছাত্রীরা ইফফাত জাহান এশার ওপর হামলার সঙ্গে জড়িত৷ তারা নানা গুজব ছাড়াচ্ছিল৷ তদন্তে তা প্রমাণ হওয়ায় তাদের হল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে৷”

এশার ওপর হামলার (জুতার মালা পরানো) ঘটনা কি পরিকল্পিত না আগে কোনো ঘটনা আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রভোস্ট বলেন, “আগে ছাত্রীদের কোনো রাগ থাকতে পারে৷ তবে তা আমরা তদন্ত করে দেখিনি৷”

তাহলে ওই রাতে (১০ এপ্রিল) এশাকে কেন বহিষ্কার করা হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি তখন দেশের বাইরে ছিলাম৷ তাই কী ঘটেছিল বলতে পারব না৷”

হল প্রভোস্টের কাছে প্রশ্ন ছিল, এভাবে নারী শিক্ষার্থীদের গভীর রাতে বের করে দেয়া যায় কি? জবাবে তিনি বলেন, “নারী শিক্ষার্থী বলবেন না৷ আমরা নারী-পুরুষ আলাদা করে দেখি না৷ আমরা ‘জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন' করি না৷ আমাদের কাছে সবাই সমান৷

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ঐ রাতে হল ছাত্রলীগের সভাপতি এশা কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দেয়া ছাত্রীদের ‘শাসন' করছিলেন৷ তার প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ ছাত্রীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে৷ মোর্শেদা খানম নামে একজন ছাত্রীর পা কেটে যায়৷ তখন গুজব ছড়িয়ে পরে যে মোর্শেদার পায়ের রগ কেটে দেয়া হয়েছে৷ মোর্শেদা নিজেও হল ছাত্রলীগের সহ সভাপতি৷ বিক্ষুব্ধ ছাত্রীরা এশাকে জুতার মালা পরিয়ে দেয়৷ তার ঐ রাতেই বিশ্ববিদ্যালয় এশাকে বহিষ্কার করে৷ ছাত্রলীগও বহিষ্কার করে৷ কিন্তু তিন দিনের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছাত্রলীগ এশার বহিষ্কারের আদেশ প্রত্যাহার করে৷ এখন চলছে জুতার মালা পরানোর জন্য কারা দায়ী তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেয়ার পর্ব৷ ছাত্রলীগ এরইমধ্যে ২৪ জনকে বহিষ্কার করেছে৷ তাদের মধ্যে মোর্শেদা খানমও আছে৷

হল প্রভোস্ট দাবি করেন, “এশাকে প্রথম বহিষ্কার করা হয়েছিল ছাত্রীদের দাবির মুখে৷ তাকে বহিষ্কার করে তার নিরপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে৷ পরে তদন্তে দেখা গেছে তার ঐ রাতে কোনো দোষ ছিল না৷ তবে কেউ যদি কোনো অভিযোগ এশার বিরুদ্ধে করে, তা আমরা আবারো তদন্ত করে দেখব৷”

কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহবায়ক রাশেদ খান অভিযোগ করেন, “এই আন্দোলনের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের সবাইকে এখন নানাভাবে শাস্তি দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে৷ সুফিয়া কামাল হলের ২৬ জন ছাত্রীকে বের করে দেয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে৷ তাদের মধ্যে তিনজনকে বের করে দেয়া হয়েছে৷ হলের প্রভেস্ট বলেছেন প্রয়োজন হলে দুই হাজার ছাত্রীকেই বের করে দেয়া হবে৷ ছাত্রীরা তাই স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্কে আছে৷”

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “এশা ছাত্রীদের ওপর আগে অনেক নির্যাতন করেছে৷ কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয়ায় সে অনেককেই নানাভাবে হয়রানি করেছে৷ ১০ এপ্রিল রাতে যা ঘটেছে, তা বিক্ষুব্ধ ছাত্রীদের প্রতিক্রিয়া৷ আর গুজব কে ছড়িয়েছে? আহত মোর্শেদা তো কখনোই বলেনি যে তার পায়ের রগ কাটা হয়েছে৷ আমরা পুরো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই৷”

তিনি বলেন, “বৃহস্পতিবার গভীর রাতে তিন ছাত্রীকে বের করে দেয়াকে আমি বলব বর্বরতা৷ এটা মধ্যযুগীয় আচরণ, কোনো সভ্য দেশে এটা সম্ভব নয়৷”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ঐ তিন ছাত্রী নানাভাবে গুজব ছড়াচ্ছিল৷ তারা ফেসবুকে ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে হলে বসে নানা ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছিল, গুজব ছড়াচ্ছিল৷ এতে হলে একটা খারাপ ঘটনা ঘটতে পারত৷ তাই তাদের অভিভাবকদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে৷ তবে তাদের ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়নি৷ কিছুদিন হলের বাইরে থাকতে বলা হয়েছে শুধু৷”

তাদের গভীর রাতে বের করে দেয়া হলো কেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এখানে দিন-রাতের কোনো ব্যাপার নেই৷ অভিভাবকদের আসতে রাত হয়েছে, তাই তাদের রাতে তুলে দেয়া হয়েছে৷”

মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল তিন ছাত্রীকে মধ্যরাতে হল থেকে বের করে দেয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, কীভাবে তিন ছাত্রীকে মধ্যরাতে হল থেকে বের করে দেয়া হয়, তা আমি ভাবতেই পারছি না৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের কি কোনো বিধি-বিধান নেই? আমাদের এখন ভাবতে হচ্ছে আমাদের ছেলে-মেয়েদের যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠাই, সেখানে তাদের নিরাপত্তা কী?



আর যে পরিস্থিতিই হোক না কেন, হাতে-নাতে মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেয়া হবে – এ ধরনের কোনো নিয়ম থাকতে পারে না৷ স্থানীয় অভিভাবক তো সমব সময় বাবা-মা হন না৷ আত্মীয়স্বজন বা পরিচিতরা হতে পারেন৷ তাঁদের হাতে কীভাবে মধ্যরাতে ছাত্রীদের তুলে দেয়া যায়!

সুলতানা কামাল বলেন, এই ঘটনায় মেয়েদের বিরুদ্ধে অভিযোগও স্পষ্ট নয়৷ বলা হচ্ছে, তারা গুজব ছড়িয়েছে৷ কী গুজব, কীভাবে ছড়িয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন৷ তাই ছাত্রীদের বের করে দেয়ার ঘটনা তদন্ত হওয়া দরকার৷ আর এটা যাঁরা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন৷

এই তিন ছাত্রীকে মধ্যরাতে বের করে দেয়ার সময় কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা বা হলের পক্ষ থেকে কোনো যানবাহনও দেয়া হয়নি৷ তারা রিকশাযোগে হল ত্যাগ করে৷ তারা হামলার শিকারো হতে পারতো প্রতিপক্ষের হাতে৷ পড়তে পারতো অনিরাপদ পরিস্থিতির মুখে৷ এ বিষয়টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানির কাছে তুলে ধরলে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এটা হল প্রশাসনের সিদ্ধান্ত৷ আমাদের কাছে কোনো সহযোগিতা চাইলে আমরা করতাম৷” সূত্র: ডয়চে ভেলে।

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/২১৪৪ঘ.)