ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশে বিধিনিষেধ কতোটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশে বিধিনিষেধ কতোটা যৌক্তিক?

ঢাকা, ১১ জুলাই (জাস্ট নিউজ) : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা প্রোক্টরের অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে ‘বহিরাগতদের’ অবস্থান, ঘোরাফেরা এবং কার্যক্রম পরিচালনায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন। এমন সিদ্ধান্তে সামাজিক মাধ্যমে নানা প্রতিক্রিয়াও দেখা যাচ্ছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার প্রভোস্ট কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার বিষয়ক ওই সভা থেকেই এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত আসে। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পাঠানো এক বিবৃতিতে জানানো হয় যে, এখন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা প্রোক্টরের অনুমতি ছাড়া বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে অবস্থান ও ঘোরাফেরা করতে দেয়া হবেনা।

ব্যাপক প্রতিক্রিয়া
ঢাবি প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তে এরইমধ্যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে প্রতিটি মহলে। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে শুরু করে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চর্চার একটি প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে এ ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো কোন পরিস্থিতি দেশে সৃষ্টি হয়নি বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক।

বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের চলাফেরা স্বাভাবিক নিয়মেই সীমিত রাখা হয়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারটা এক্ষেত্রে আলাদা। কেননা এটি নিছক বিশ্ববিদ্যালয় নয় বরং রাজনৈতিক পালাবদলের প্রত্যক্ষ সাক্ষী, দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক এবং জনতার আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক,’ বলছেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, এখানে বহিরাগতদের প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করিনা। দেশে এখনও এমন কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। যদিও এখানে সম্প্রতি কিছু অনাকাঙ্কিত ঘটনা ঘটেছে। তবে এই কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণের চলাফেরা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়।

মোহাম্মদ হামিদুল্লাহ বলছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের হয়রানি করার জন্যই বহিরাগতদের অবস্থান এবং ঘোরাফেরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা মত প্রকাশ এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর আক্রমণের বহিঃপ্রকাশ।

হাবিবুর রহমান বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একপাশে ঢাকা মেডিকেল, পাশে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, ভেতরে বাংলা একাডেমী, পরমাণু শক্তি কমিশন, ব্রিটিশ কাউন্সিল, কার্জন হলের উল্টা দিকে হাইকোর্ট। টিএসসির পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান- এগুলো সব পাবলিক প্লেস। এর মাঝখানে রাস্তাগুলো সিটি কর্পোরেশন এর। প্রক্টোরিয়াল অফিসে লোকবল বিশ জনের কম। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের মোট পথ আটটি। কোথাও কোনো গেইট নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই। এই পরিস্থিতিতে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা অসম্ভব।

নফিউল ইসলাম হৃদয় লিখেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি ক্যান্টনমেন্ট হয়ে গেছে? জনগণ এর টাকায় পরিচালন বিশ্ববিদ্যালয় জনগণ যেতে পারবেনা! এই অধিকার কে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে???

সুজন চন্দ্র সরকার সুজয় বলছেন, সিদ্ধান্তটি সাময়িক সময়ের জন্য দেয়া হতে পারে। তবে কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য যদি এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তবে আমি বলবো ঢাবি কর্তৃপক্ষ দলকানা।

তোফায়েল আহমেদের মতে, ঢাবি হল উন্মুক্ত জ্ঞান চর্চার আসর। তাই নিষেদ্ধাজ্ঞা যত দ্রুত প্রত্যাহার করা যায় ততই মঙ্গল।

রেজওয়ান আহমেদ তুহিন লিখেছেন, এটা নির্যাতনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে। বহিরাগতের সংজ্ঞা দেয়া হয় নি এখানে। এছাড়া বহিরাগতের অবস্থান নিষিদ্ধ হলে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বহিরাগত গাড়িও নিষিদ্ধ হওয়ার কথা, সেটা হবে না বা হচ্ছে না। এটা করা হয়েছে উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহারের মাধ্যমে নির্যাতন ও হয়রানি করার জন্য।

তবে কেউ কেউ আবার এমন সিদ্ধান্তের প্রশংসাও করেছেন।
ইমাম মানজুর বলছেন, অবশ্যই ভাল সিদ্ধান্ত। কিন্তু এটার প্রয়োগ দরকার। বিশ্ববিদ্যালয় এখন একটা পার্কে পরিণত হয়েছে। ছাত্রদের অবাধে ঘোরাফেরা করবে সেই সুযোগ নাই।

মো সাইফুল ইসলাম নামে আরেকজন লিখেছেন, পদক্ষেপটিকে স্বাগত জানাই। তবে এর সুফল/কুফল নির্ভর করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কার্যক্রম ও সদিচ্ছার উপর।

কী ছিল সেই বিজ্ঞপ্তিতে?

সোমবারের বিজ্ঞপ্তিতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের ছাত্রত্ব নেই তাদেরকে কয়েক দিনের মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশনা দিয়ে নোটিশ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। হল প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া কোন অভিভাবক বা অতিথি হলে অবস্থান করতে পারবে না। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিতে পারবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। কোনো অবস্থাতেই যাতে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের সদস্য ও চরমপন্থিরা হলে প্রবেশ এবং অবস্থান করতে না পারে, সে ব্যাপারে হল প্রশাসনকে স্বচ্ছ সতর্ক ও তৎপর থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এ নিয়ে হলে অবস্থানরত ছাত্র সংগঠন ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হল প্রশাসনকে নিয়মিত মতবিনিময় সভায় বসার আহ্বান জানানো হয়েছে ওই বিজ্ঞপ্তিতে।
তবে বহিরাগতরা যদি কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে চান তাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা প্রোক্টরের অনুমতি নিতে হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নিতে পারবে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক কয়েকটি সহিংসতার ঘটনার তদন্ত করে তার প্রতিবেদন দাখিলের জন্য প্রভোস্ট কমিটির ওই সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সামাদকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ধরণের নিয়ন্ত্রণ আরোপ কি কি দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং আন্দোলনের পথে বাধার সৃষ্টি করবে। এমন জবাবে অধ্যাপক সামাদ বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ স্বাভাবিক রেখে যেকোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে আমরা স্বাগত জানাই।

এই বিশ্ববিদ্যালয় দেশের মুক্তি সংগ্রামের সূতিকাগার, সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র। এখানে গান, কবিতা, গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলন, ন্যায় সংগ্রামের মিছিল সবই হবে।

তিনি বলেন, তবে আন্দোলনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যাবে- এটা কারো কাম্য নয়। বহিরাগতদের কারণে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনেক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

বহিরাগত কারা?
বহিরাগত বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে বিপক্ষে যারা বিশৃঙ্খলা করেছে তার বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিরাগত। যেসব বহিরাগত এসব নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুস্থ পরিবেশ কলুষিত করছে এই বিধিনিষেধ শুধুমাত্র তাদের জন্য প্রযোজ্য। সবার জন্য নয়।

সরকারী চাকরিতে নিয়োগে কোটার পরিমাণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং চাকরি প্রত্যাশীরা ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’-এর ব্যানারে গত কয়েক মাস ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছে, যার কেন্দ্র বিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সূত্র: বিবিসি।

(জাস্ট নিউজ/এমআই/১২৩২ঘ.)