ব্যাংকিং খাতে অরাজকতা

ব্যাংকিং খাতে অরাজকতা

ঢাকা, ২ জানুয়ারি (জাস্ট নিউজ) : বছরজুড়ে দেশের ব্যাংকিং খাত ছিল আলোচিত-সমালোচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের ভাষায়, ২০১৭ সালে ব্যাংক খাত ছিল কেলেঙ্কারির বছর। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় একের পর এক ব্যাংক দখল, বিশেষ স্বার্থে ব্যাংক কোম্পানি আইন পরিবর্তন, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে নতুন নতুন ঋণ কেলেঙ্কারি আর অনিয়ম নিয়ে বছরব্যাপী হৈচৈ হয়েছে।

বিতর্কিত শেখ আবদুল হাই বাচ্চুসহ বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির নায়কদের দুর্নীতি দমন কমিশনে জিজ্ঞাসাবাদ, নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংকে উদ্যোক্তাদের লুটপাট, আমানতকারীদের হাহাকারের পাশাপাশি তীব্র তারল্য সংকট নিয়েও তোলপাড় হয়েছে। বিশেষ করে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক জন্ম নেয়ার কয়েক বছরের মাথায় ৭ শতাধিক কোটি টাকার নজিরবিহীন ঋণ অনিয়মে পড়ে।

এর পেছনে প্রত্যক্ষ যোগসাজশ ছিল উদ্যোক্তাদের। পাশাপাশি সাবেক ব্যাংকার আর অর্থনীতিবিদদের বেশি সমালোচনার মুখে পড়ে ব্যাংক কোম্পানি আইনের বিতর্কিত সংশোধন। এতে ব্যাংকিং খাতে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নতুন করে লুটপাটের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে বলে সমালোচনা করেন তারা। এ আইনটি নতুন বছরে জাতীয় সংসদে অনুমোদন পেলে ব্যাংকিং খাত ভয়াবহ সংকটে পড়বে বলেও তাদের আশঙ্কা।

এদিকে বরাবরের মতো ব্যাংক লুটপাটকারীদের সরকার শাস্তির মুখোমুখি করতে পারেনি। কিছু চুনোপুঁটিকে গ্রেফতার করে দুদক নিজের অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা করেছে। আর বছর শেষে বেসিক ব্যাংকের আবদুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সান্ত্বনার বাণী দিতে পেরেছে। কিন্তু বড় বড় রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি ও ব্যাংক লুটেরাদের কিছুই হয়নি।

জানা গেছে, আর্থিক অবস্থার অবনতি হওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ৮ ব্যাংক ছাড়াও বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক, এবি ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংক রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। খেলাপির পাশাপাশি ঋণ কেলেঙ্কারি, অনিয়ম আর আমানত লুটপাটের পরও অনেক ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি টাকা মূলধনের জোগান দিয়েছে সরকার- যা তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছে। নতুন লাইসেন্স পাওয়া অধিকাংশ ব্যাংকই আমনতকারীদের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারপরও নতুন নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের স্ববিরোধী অবস্থানও ছিল লক্ষণীয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকাও ছিল বিতর্কিত। প্রথমে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া নিয়ে তীব্র আপত্তি জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু পরে রহস্যজনক কারণে এ অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে।

ব্যাংকিং খাত নিয়ে সারা বছরই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম), বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও সুশীল সমাজ। পাশাপাশি বেসরকারি অনেক ব্যাংকের উদ্যোক্তারাই ব্যাংক দখলের আতঙ্কে থাকেন- যা নতুন বছরেও অব্যাহত থাকবে বলে তাদের আশঙ্কা। কেউ কেউ মনে করছেন, নির্বাচন সামনে থাকায় নতুন বছরে ব্যাংকিং খাত আরও অস্থির হতে পারে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, পাকিস্তান আমলে ২২ পরিবারের কাছে জিম্মি ছিল ব্যাংকিং খাত। তখন বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করে অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়েছিলেন। এখন তারই দল এবং একই আদর্শের অনুসারীরা পরিবারভিত্তিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে- যা পুরো ব্যাংকিং খাতকে ধ্বংস করে দেবে।

তিনি বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলো বিপর্যয়ের শেষ প্রান্তে। বিতর্কিত আইনটি সংসদে পাস হলে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোও শেষ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, সরকারি ব্যাংকে লুটপাটের পর এবার ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলোতেও একই ঘটনা ঘটছে- যা উদ্বেগজনক।

ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলো অনেকটা জোরপূর্বক দখল করে নেয়া হচ্ছে। এছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুগতদের ব্যাংক দেয়া ঠিক হয়নি। শুরুতে বিভিন্ন পক্ষ বিরোধিতা করেছিল। আজ সেটা সত্য প্রমাণিত হল। এরপর আরও নতুন ব্যাংক দেয়া হচ্ছে। মূলত নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাত যতটা এগিয়েছে তার থেকে বেশি পিছিয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে এখন কোনো সংস্কারে আর কাজ হবে না।

গত ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেছেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে সঠিকভাবে হিসাব রাখা ও অডিট করা হলে এবং তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা আনা হলে দেশের অর্ধেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে। ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি আছে। এ জন্যই বড় বড় অনিয়ম হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ক্রমশই সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকিং খাত। একটি বিশেষ ব্যবসায়ী গ্রুপের কাছে ৭-৮টি ব্যাংকের মালিকানা চলে যাওয়া নিঃসন্দেহে খারাপ খবর। এটা যে কোনো সময় ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। পৃথিবীর কোথাও এমন নজির নেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মালিকদের চাপে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ সংশোধনী চূড়ান্ত হলে কয়েকটি পরিবারের কাছে ব্যাংকের মালিকানা চলে যাবে। কারণ আইন সংশোধন করে ব্যাংকের পর্ষদে একই পরিবার থেকে ৪ জন এবং টানা ৯ বছর দায়িত্ব পালনের সুযোগ রাখা হচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকে এক পরিবার থেকে এতসংখ্যক পরিচালক থাকলে ব্যাংকে সুশাসনের ঘাটতি দেখা দেবে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, সুশীল সমাজ এবং কয়েকজন সংসদ সদস্য।

সংশ্লিষ্টরা উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, সাধারণ মানুষ ব্যাংকে টাকা রেখে তা ফেরত পায়নি এমন নজির ছিল না। ফারমার্স ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা ঘটেছে। এছাড়া পরিচালনা পর্ষদে বহিরাগত লোক প্রবেশের নজির দেখিয়েছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। অস্তিত্বহীন সাইনবোর্ডসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকেও ঋণ দেয়া হচ্ছে। গত বছর এ ধরনের কিছু অনিয়ম পুরো ব্যাংকিং খাতকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ফেলেছে পদ্ধতিগত ঝুঁকির মধ্যে।

এদিকে বিদায়ী বছরে দেশের ব্যাংক খাত যেন নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে প্রায় ২০টির আর্থিক অবস্থা ছিল বেশ খারাপ। এগুলোর খেলাপি ঋণ অনেক বেড়েছে। সব ব্যাংকেই সুশাসনের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। নামে-বেনামে ইচ্ছামতো অর্থ তুলে নেয়া হয়েছে। ঋণে বেড়েছে বিভিন্ন ধরনের দুর্র্নীতি ও অনিয়ম। সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি ব্যবস্থা আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এসব বিষয়ে বলেন, বছরের শুরুতে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ ছিল। কিন্তু বছর শেষে দেখা গেল বেসরকারি অধিকাংশ ব্যাংকের অবস্থা আরও নাজুক। বিশেষ করে ফারমার্স এবং এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক পুরো ব্যাংকিং খাতকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এখন ব্যাংকিং খাত নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী গত বছরের শুরু থেকে ব্যাংকিং খাতে লাগামহীনভাবে বাড়ে খেলাপি ঋণ। নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) ও মূলধন ঘাটতিতে পড়ে সরকারি-বেসরকারি বেশ কিছু ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা, যা আগের বছর শেষে ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। এর সঙ্গে ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন যোগ করলে খেলাপি ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়াবে। এ হিসাব নিয়েও প্রশ্ন আছে। তাহলে প্রকৃত বিচারে খেলাপি কত হবে তা কেউ জানে না। এছাড়া বিপুল পরিমাণ খেলাপির কারণে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সাতটি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৮ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি ৩ হাজার ৪২১ কোটি টাকা ঘাটতিতে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক। প্রভিশন ঘাটতির পাশাপাশি মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে আটটি ব্যাংক। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে আট ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার প্রায় দুই বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। কিন্তু টাকা উদ্ধারে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে শ্রীলংকায় যাওয়া ২ কোটি ডলার ফেরত পাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু ফিলিপাইনে যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে ফেরত পাওয়া গেছে মাত্র দেড় কোটি ডলার। বাকি ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার এখনও পাওয়া যায়নি। যুগান্তর।

(জাস্ট নিউজ/ওটি/১০৩৬ঘ.)