রাজধানীতে তীব্র গ্যাস সঙ্কট

রাজধানীতে তীব্র গ্যাস সঙ্কট

ঢাকা, ১২ জানুয়ারি (জাস্ট নিউজ) : প্রতিদিন সকাল ৬টায় পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। আসে রাত ১২টায়। সারা দিন গ্যাসের দেখা মেলে না। রাত জেগে রান্না করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন গৃহিণীরা। এখন হোটেল থেকে খাবার কিনে খেতে হচ্ছে। কত দিন হোটেল থেকে কিনে খাওয়া যায়। এমনিতেই তীব্র শীত এর মধ্যে ভয়াবহ এ গ্যাস সঙ্কটে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। কথাগুলো বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন খান। মিরপুর পল্লবী থেকে তিনি টেলিফোনে ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, প্রতি মাসেই গ্যাস বিল পরিশোধ করেন। এক মাস বকেয়া পড়লেই গ্যাসসংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নোটিশ দেয়া হয়। কিন্তু দিনের পর দিন গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না, এ জন্য কর্তৃপক্ষের কোনো অনুসূচনা নেই। গ্রাহকের দুঃখ দেখার যেন কেউ নেই।

জাহাঙ্গীর হোসেন খানের মতো এ প্রশ্ন সব রাজধানীবাসীর। রাজধানীতে প্রায় সব এলাকাতেই গ্যাস সরবরাহের চিত্র একই। গ্যাস সরবরাহ না থাকায় দিনে বাসাবাড়িতে চুলা জ্বলছে না। শীতে খাবার পানি পর্যন্ত গরম করা যাচ্ছে না। গভীর রাত জেগে গৃহিণীদের রান্না করতে হচ্ছে। এতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। যারা রাত জেগে রান্না করতে পারছেন না তাদের বাধ্য হয়ে হোটেল থেকে খাবার কিনে খেতে হচ্ছে। আবার হোটেলগুলোতেও খাবার পাওয়া যাচ্ছে না। বাসি খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। এতে অনেকেই পেটের পীড়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের বাসি খাবার খেয়ে স্কুলে যেতে হচ্ছে। গ্যাস সমস্যার কারণে কেউ কেউ কেরোসিন ও ইলেকট্রিক চুলা কিনছেন। কেউ বা গ্যাস সিলিন্ডার কিনছেন। গ্যাস সিলিন্ডারের সাথে গ্যাসের চুলার বিক্রি বেড়ে গেছে। শুধু বাসাবাড়িতেই সমস্যা হচ্ছে না, সিএনজি পাম্পগুলোতেও গ্যাসের চাপ কমে গেছে। এতে একবার গ্যাস নিতে ৩-৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে সিএনজি-চালিত গাড়িগুলোর। এ কারণে সিএনজি পাম্পগুলোতে গাড়ির দীর্ঘ লাইন পড়ে যাচ্ছে।

রাজধানীবাসীর এ দুর্ভোগ যেন স্থায়ী রূপ নিয়েছে। প্রতি বছরই শীতের শুরুতে এ সঙ্কট শুরু হয়, স্থায়ী হয় পুরো শীতজুড়ে। এ দুর্ভোগের কারণ নিয়ে বরাবরই গ্যাস খাতের সংস্থাগুলোর পরস্পরের পক্ষে-বিপক্ষে দোষারোপ করতে দেখা যায়। যেমন, গ্যাস বিতরণের সাথে জড়িত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তিতাস থেকে বলা হয় চাহিদা অনুযায়ী তাদেরকে গ্যাস সরবরাহ করছে না পেট্রোবাংলা। আবার পেট্রোবাংলা থেকে তিতাসের পাইপলাইনকে দোষারোপ করা হয়। বলা হয় গ্যাস সরবরাহের জন্য পাইপলাইনগুলো অনেক পুরনো এবং ব্যাসে কম থাকায় শীতকালে বর্ধিত চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা যায় না।

যাত্রাবাড়ীর দনিয়া এলাকার গ্যাস সঙ্কটের ভয়াবহতা তুলে ধরে গৃহবধূ তানিয়া আকতার ও বিলকিচ আক্তার গতকাল এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, প্রতিদিন ভোর ৬টায় পাইপলাইনে গ্যাস চলে যায়, সারা দিন আর গ্যাস আসে না। সন্ধ্যায় গ্যাস এলেও অনেক দিন তা রাত ৯টায় চলে যায়। গ্যাসের এ দুর্ভোগে এ এলাকার গৃহিণীরা রাত জেগে রান্না করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। অনেকেই শীতকে উপেক্ষা করে ভোর ৩টা-৪টা থেকে দিনের রান্না শুরু করেন। ৬টার আগেই রান্না শেষ করতে হয়। অন্যথায় উপোস থাকতে হয়। গ্যাসের এ সঙ্কটের কারণে সামর্থ্যবানেরা বিকল্প হিসেবে এলপি গ্যাস ব্যবহার করছেন। কেউবা কেরোসিনের চুলা কিনে কোনো রকম রান্নার কাজ সারছেন। তবে সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে স্কুলগামী ছোট শিশুদের নিয়ে। তাদের বাসি খাবার খেয়ে স্কুলে যেতে হচ্ছে। কিন্তু টিফিন দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। খিলগাঁও তালতলার বি ব্লকের বাসিন্দা রিফাত আরা জানান, এ এলাকার নতুন করে গ্যাস সঙ্কট দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৮টার পর গ্যাস চলে যাচ্ছে। আর আসছে বেলা ২টা-৩টায়। এ সময়ের মধ্যে সামান্য পানিও গরম করা যায় না।

উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা ওমর আলী জানান, আগে কখনো এ এলাকায় গ্যাস সঙ্কট ছিল না। গত এক মাস যাবৎ গ্যাস সমস্যা এ এলাকার নতুন সঙ্কট হিসেবে দেখা দিয়েছে। বেলা ১১টার পর থেকে দুপুর পর্যন্ত এবং কখনো কখনো রাতেও এ এলাকায় গ্যাস থাকে না। গ্যাসের চাপ কম থাকায় সামান্য খাবারও গরম করা যায় না।

দক্ষিণ মুগদার বাসিন্দা আয়েশা ছিদ্দিকা জানান, মুগদা এলাকায় গ্যাসের করুণ অবস্থা। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা-৪টা পর্যন্ত একটানা পাইপলাইনে গ্যাস থাকে না। গ্যাস না থাকায় ভয়াবহ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাদের।
রাজধানীর গেন্ডারিয়া থেকে দেলোয়ার হোসেন গ্যাস সঙ্কটের ভয়াবহতা সম্পর্কে বলেন, রাত ১১টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত সরবরাহ লাইনে গ্যাস থাকে। এর মধ্যে রান্না করতে না পারলে হয় হোটেল থেকে খাবার কিনে খেতে হবে, না হয় উপোস থাকতে হবে। আর দিনে মেহমান এলে সামান্য আপ্যায়ন করা যায় না। এতে মানসম্মান নিয়ে টানাটানি অবস্থা। মেহমানকে আপ্যায়ন করতে হয় হোটেলে নিয়ে। তিনি জানান, তার বাসায় গ্রামের বাড়ি থেকে গতকাল এক মেহমান এসেছেন। হোটেলে নিয়ে দুপুরের খাবার খাওয়ানোর ফলে মেহমান অনেকটা মনক্ষুণ্ন হয়েছেন। তিনি বলেন, একোতো বাড়িভাড়ার সাথে দফায় দফায় বিদ্যুৎ বিল বাড়ানো হচ্ছে। তিন শ’ টাকার বিদ্যুৎ বিল এখন ক্ষেত্র বিশেষ দেড় হাজার টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। সব মিলে রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে এখন রাজধানীতে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে।

রামপুরার ওয়াপদা ওমর আলী লেনের বাসিন্দা মিসেস রেখা রহমান জানান, সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। তিনি বলেন, গোসল করার জন্য এক পাতিল পানি গরম করতে ৪-৫ ঘণ্টা লেগে যায়। এভাবেই চলছে তাদের নিত্যদিন।

বাসাবো কদম তলার বাসিন্দা আনোয়ারা বেগম জানিয়েছেন, দিনে একটু পানি গরম করার মতো গ্যাস থাকে না। ছোট শিশুদের গোসল করার জন্য পানি গরম করা যায় না। রাত জেগে খাবার রান্না করতে হয়। এ কারণে গৃহিণীরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এ দুর্ভোগ কবে নাগাদ শেষ হবে তারও কোনো উত্তর তাদের দিতে পারছে না। গ্যাসের এ সঙ্কট রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকাতেই রয়েছে। এমনকি রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র সংসদ ভবন এলাকার আশপাশ মনিপুরী পাড়া, ফার্মগেট, গ্রিন রোড, মোস্তফা রোড, মতিঝিল, মালিবাগ, রামপুরা, খিলগাঁও এলাকায়ও গ্যাসের তীব্র সঙ্কট শুরু হয়েছে শীতকাল ঘিরে।

সিএনজি স্টেশনে দীর্ঘ লাইন : শুধু রান্নার কাজেই রাজধানীবাসী দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন না, এসব এলাকার সিএনজি স্টেশনগুলোতে গ্যাস নেয়ার জন্য গাড়ির দীর্ঘ লাইন পড়ে যাচ্ছে। পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ কম থাকায় কোনো কোনো এলাকার সিএনজি পাম্প থেকে একবার গ্যাস নিতে তিন-চার ঘণ্টা লেগে যায়। এতে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে পরিবহন ভাড়া। রাজধানীতে ভয়াবহ এ গ্যাস সঙ্কটের বিষয়ে তিতাসের এমডি প্রকৌশলী মীর মশিউর রহমানের বক্তব্য জানতে বার বার ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে তিতাসের পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী আলী আশরাফ গতকাল এ বিষয়ে এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, তাদের উৎপাদনের কোনো সমস্যা নেই। তাদের ১৭০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে ১৭০ কোটি ঘনফুটই পাচ্ছেন। কিন্তু শীতের কারণে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, শীতে গ্যাসের চাহিদা গড়ে ২০ শতাংশ বেড়ে যায়। কিন্তু গ্যাস পাচ্ছেন আগের হারেই। -নয়া দিগন্ত

(জাস্ট নিউজ/একে/০৯৩০ঘ.)