চাল রপ্তানি নিয়ে বিতর্ক

চাল রপ্তানি নিয়ে বিতর্ক

আমদানির চালে তৈরি জটে কপাল পুড়ছে কৃষকের। জমিতে সোনালী ধান দোল খেলেও কৃষকের মনে চাপা কান্না। ধান বিক্রি করে খরচও উঠাতে পারছে না। আর জমির ধান কাটার শ্রমিকের বাড়তি মজুরি নিয়ে আছে দুঃশ্চিন্তা। এ অবস্থায় ধানের ‘ন্যায্য দাম’ নিশ্চিত করতে চাল রপ্তানির চিন্তা করছে সরকার। সরকারি এ উদ্যোগ নিয়ে ইতোমধ্যেই তৈরি হয়েছে বিতর্ক।

অর্থনীতিবিদ ও কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরীক্ষা নীরিক্ষা না করে চাল রপ্তানি হলে এটি ভবিষ্যৎ সংকট তৈরি করতে পারে। এছাড়া চাল রপ্তানি করতে হলে পুরো বিষয় নিয়ে পরিকল্পনা করে করতে হবে যাতে কৃষকের উপকার হয়। কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি করা চালে যেমন কৃষকের কপাল পুড়েছে তেমনি চাল রপ্তানি হলেও ব্যবসায়ী চক্র এর সুবিধা পাবে। কৃষকের কোন লাভ হবে না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে যখন প্রচুর চাল আমদানি হচ্ছিল, তখনই ভাবা উচিত ছিল কৃষকের ধান উঠলে দাম কমে যেতে পারে। এই মুহূর্তে সরকারকে দেখানো উচিত ছিল তারা ধানের দাম বাড়ানোর জন্য তৎপর। এখন সরকারের উচিত হবে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে ধান-চাল সংগ্রহ বাড়ানো। আর দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে ধান সংগ্রহের ব্যবস্থা করা।

জানা গেছে, বর্তমানে দেশে চাহিদার তুলনায় ধান-চাল বেশি রয়েছে। এছাড়া চলছে বোরো ধান কাটার মৌসুম। দামও কম। উৎপাদন খরচের প্রায় অর্ধেক দামে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষককে। অথচ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে সরকারি-বেসরকারিভাবে গত ১০ মাসে ২ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। পাইপলাইনে রয়েছে আরো ৩ লাখ ৮০ হাজার টন চাল। ২০১৭ সালের মে মাসে হাওরে আগাম বন্যায় ফসলহানির পর সরকার চালের আমদানি শুল্ক উঠিয়ে দেয়। সরকার থেকে বলা হয়েছিল, এই ক্ষতির ফলে ঘাটতি হবে ১০ লাখ টন চালের। কিন্তু গত দুই বছরে দেশে প্রায় ৬০ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। গত নভেম্বরে সরকার ২৮ শতাংশ আমদানি শুল্ক পুনর্বহাল করে। এতে চাল আমদানি কমলেও বন্ধ হয়নি। বাড়তি উৎপাদন ও আমদানির চাল বাজারে চাপ তৈরি করছে। ফলে দাম নিয়মিত কমছে। ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় বিপদে পড়েছেন কৃষক। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ-কর্মসূচিও পালিত হচ্ছে।

সরকারি-বেসরকারি হিসাব বলছে, দেশে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত রয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে এই বাড়তি চাল রপ্তানির বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কেন চাল আমদানি করা হচ্ছে? তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। আবার চাল রপ্তানি করা হলে কারা লাভবান হবে? কৃষক নাকি ব্যবসায়ীরা। এ নিয়েও বিতর্ক দেখা দিয়েছে বিভিন্ন মহলে।

একাধিক ব্যবসায়ীরা জানান, সরকার মূলত চালকলমালিকদের কাছ থেকে চাল কেনে। চালকলমালিকরা ফড়িয়াদের মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে। সরকার প্রতিবছর ১ লাখ টন ধান কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কেনার ঘোষণা দেয়। কিন্তু কোনো সময়ই তা কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কেনা হয় না। ফলে সব সময় বড় কিছু চালকলমালিক ধান-চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করেন।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মুনসুর বলেন, কৃষক ধানের দাম পাচ্ছেন না। এটা সত্য। এজন্য চাল রপ্তানি করা উচিত। তবে এটা খুব সহজ হবে না। যদি সিস্টেমেটিকভাবে রপ্তানি করা হয়, তাহলে কৃষক লাভবান হবে। কিন্তু আমাদের দেশে তো সেটা হয় না। তাই বলা যায়, চাল রপ্তানি করা হলে ব্যবসায়ীরাই লাভবান হবেন।

গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন জানায়, বড় বড় রাইস মিল মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে কৃষকরা ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। ধানের ন্যায্যমূল্য পেতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৮ দফা দাবিও জানিয়েছে সংগঠনটি।

জানা গেছে, সরকার এ বছরের মে মাস থেকে ১৩ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্য ঠিক করেছে। চলবে তিন মাস। মে মাসের অর্ধেক পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ১ হাজার ২৬৯ টন চাল সংগ্রহ হয়েছে। বেশির ভাগ চালকলমালিক বাজার থেকে ধান কেনা শুরুই করেননি। চালকলমালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছে থাকা পুরোনো চাল তারা সরকারি গুদামে দিচ্ছেন।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে এ বছর বোরো মৌসুমে ১ কেজি চাল উৎপাদনে ৩৬ টাকা খরচ পড়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ১০ লাখ টন সেদ্ধ চাল, দেড় লাখ টন আতপ চাল এবং দেড় লাখ টন ধান সংগ্রহ করবে। কেজিপ্রতি ৩৬ টাকা দরে সেদ্ধ চাল, ৩৫ টাকা দরে আতপ চাল এবং ২৬ টাকা দরে ধান সংগ্রহ করা হবে। গত ২৫শে এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে ধান-চাল সংগ্রহ চলবে ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত। অর্থাৎ চালের সংগ্রহ মূল্যেই কৃষকের জন্য কোনো লাভ ধরা হয়নি।

এর আগে ২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কায় দুই দফায় ২৫ হাজার টন চাল রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এসব চালের টনপ্রতি রপ্তানি মূল্য ধরা হয় ৪৫০ ডলার; যা বাংলাদেশের প্রায় ৪০ হাজার টাকার মতো।

এমআই