অর্থনীতিতে বিপদের পদধ্বনি

অর্থনীতিতে বিপদের পদধ্বনি খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। ফাইল ছবি

দেশের অর্থনীতির প্রধান দুটি খাতের একটি ব্যাংক অন্যটি শেয়ারবাজার। এ দুই খাতই বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। নতুন নতুন নীতিমালা আসছে। এসব নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে।

অন্যদিকে, শেয়ারবাজারের দুষ্টু চক্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে তারা বহাল তবিয়তে শেয়ারবাজারে প্রভাব বিস্তার করে আসছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতরা চিহ্নিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

এমন পরিস্থিতিতে এ দুই খাত খারাপ অবস্থায় থাকায় দেশের অর্থনীতিও বিপদের সম্মুখীন বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে এসব বিষয় বিস্তারিত তুলে ধরেছেন তিনি।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বাংলাদেশের জিডিপি (মোট জাতীয় আয়) প্রবৃদ্ধি খুবই আকর্ষণীয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ওপরে। তবে এটার বণ্টন ব্যবস্থা ভালো না। দেশের সম্পদ এখন মাত্র ৫ শতাংশ মানুষের হাতে পুঞ্জিভূত। ফলে দেশের উন্নয়ন সুফল থেকে বাকি ৯৫ শতাংশ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। দেশের শতকরা ৫ ভাগ লোক ভালো আছে, এর মানে দেশ ভালো আছে এটা কখনোই বলা যায় না। এটা দেশের জন্য ভালো নয়। এটা দেশের সংবিধানের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

অবস্থার উন্নতির জন্য সরকারের পদক্ষেপের বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। যেমন, ব্যাংক খাতে বর্তমানে ১০ লাখ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে ৯ লাখ কোটি টাকা নিয়মিত এবং ১ লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ বিষয়ে সরকার যথেষ্ট সুযোগ প্রদান করছে। আর যারা ভালো গ্রাহক তাদের জন্য সরকার কিছু করছেন না। এর ফলে ভালো ঋণ গ্রহীতারা ধীরে ধীরে খেলাপি ঋণ গ্রহীতায় পরিণত হচ্ছে। এটা উলটো ব্যবস্থা বলে মনে হচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপি বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। অবশ্য বর্তমানে আদালতের নির্দেশে ওই প্রজ্ঞাপন স্থগিত আছে। যদি এটি বাস্তবায়িত হয় তাহলে দেশের ব্যাংকিং খাতে বিরাট বিপর্যয় নেমে আসবে।

সাবেক এ ব্যাংকার বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা বিপন্ন অবস্থায় আছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা নির্ভর করে সরকারের ইচ্ছার ওপর।

তিনি বলেন, ব্যাংকের মোট আমানতের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যাংক মালিক বা শেয়ারহোল্ডারদের। আর ৯০ ভাগ সাধারণ আমনতকারীদের। অথচ ব্যাংক পরিচালিত হয় সম্পূর্ণভাবে মালিকদের দ্বারা। ব্যাংকের যে বোর্ড অব ডাইরেক্টর থাকে তাদের সবাই শেয়ারহোল্ডার। এখানে আমানতকারীর স্বার্থ সবচেয়ে বেশি হলেও তাদের পক্ষে কথা বলার লোক নেই। যে কারণে আইন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড থেকে শুরু করে যত কেন্দ্রীয় ব্যাংক আছে সবই এজন্য তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাংকিং খাত ঠিক রাখার জন্য।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ব্যাংকের মালিক বিপরীত পক্ষ। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থ দেখে আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমানতকারীর স্বার্থ দেখে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো কাজে সরকার হস্তক্ষেপ করে না। কিছুদিন আগে ভারতের মোদি সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক (আরবিআই) থেকে কিছু ঋণ চেয়েছিল। তবে তা নিয়মবহির্ভূত হওয়ায় আরবিআইয়ের গভর্নরের পদত্যাগের কথা তুলে ধরেন তিনি।

বাংলাদেশের অবস্থা এ ক্ষেত্রে ভিন্ন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক একেবারেই সরকারের অধীনে চলে গেছে। যদিও আইনতভাবে এখন কোনো বিষয়েই সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজনীয়তা নেই। তবে বাস্তবে দেখা যায়, সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিভিন্ন বিষয়ে শুধু অনুরোধ না রীতিমতো বিভিন্ন কাজ করিয়ে নিচ্ছে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর বিভিন্ন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা একেবারেরই বিপন্ন অবস্থায় আছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা নির্ভর করে সরকারের সহযোগিতার ওপর। অর্থাত্ যখন সরকার চাপ প্রয়োগ করবে না। কারণ, সরকার শক্তিশালী। সরকার এখন বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যবহার করছে। এতে আমানতকারীর স্বার্থ ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোও সুপরিচালিত হতে পারছে না।

ঋণখেলাপিরা এখন সরকারের উচ্চপর্যায়ে রয়েছেন- এ বিষয়ে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, আমরা জানতে পেরেছি একটি পাঁচতারকা হোটেলে ব্যাংক মালিকদের একটি বৈঠক হয়। সেখানে নেতৃত্ব দেন বহু ঋণখেলাপি ব্যাংক মালিক। ওই বৈঠক থেকে সরকারকে তারা বলেন, আপানারা যে খেলাপি ঋণের কথা বলেন এটা আর বলতে হবে না। এমন নীতিমালা করব যাতে আর খেলাপি ঋণ না বাড়ে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে, পরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। যদিও আদালত সে প্রজ্ঞাপন এখন স্থগিত রেখেছে। ওই প্রজ্ঞাপনে ঋণখেলাপির সংজ্ঞা একেবারে সংকোচিত করে ফেলা হয়েছে। খেলাপিরা যদি নির্ধারণ করেন কে ঋণ খেলাপি হবে— তাহলে দেশে সুশাসন বলে আর কিছু থাকে না।

তিনি বলেন, সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে খেলাপিদের শীর্ষ চক্র এবং ব্যাংক মালিকদের কিছু অংশ মিলে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পরিচালিত করছে। একইসঙ্গে তারা সরকারকেও পরিচালিত করছে।

শেয়ারবাজারে আস্থার সঙ্কট রয়েছে বলে সাবেক এ ব্যাংকার মনে করেন। তিনি বলেন, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি নিয়ে ২০১০ সালে যে রিপোর্ট দিয়েছিলাম তা কার্যকর হয়নি। কেবল দুজনের ১ কোটি টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। তারা দুজনই বিএনপিপন্থি। এখানে যদি দলাদলি করা হয়, তাহলে তো সুশাসন থাকে না। এ কারণে শেয়ারবাজারে আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে।

শেয়ারবাজারে মূল সমস্যা দুটি, ঢাকা স্টক একচেঞ্জে (ডিএসই) এক ধরনের কোটারি রয়েছে। ডিএসইতে সদস্য সংখ্যা কমপক্ষে ১ হাজার না হলে এ কোটারি ভাঙা সম্ভব হবে না। এজন্য শক্ত অবস্থা নিতে হবে। আর দ্বিতীয়টা, ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন সমস্যার সমাধান।

শেয়ারবাজারে যে কোটারি বা চক্র রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সরকারের সে শক্তি নেই। অথবা এমনও হতে পারে— সরকার তার শক্তি প্রদর্শন করছে না। এমনকি এ চক্রের লোকজন সরকারের কাছের লোকও হতে পারে। এসব লোকই সরকারকে প্রভাবিত করছেন।

ব্যাংকগুলোকে প্রতি বছর মূলধন জোগান দেওয়াকে অনৈতিক বলে মনে করেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বলেন, এক একবারের জন্য দেওয়া যেতে পারে। বছরে বছরে এটা দিয়ে জনগণের টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলাটা একেবারেই অনৈতিক। তিনি বলেন, যারা ঋণখেলাপি, চোরাকারবারি, টাকা পাচারকারী- তারা এখন বড় শক্তিতে পরিণত হয়ে গেছে। এর কারণ হলো- বর্তমানে ৫ শতাংশ লোকের কাছে অর্থ আছে। তারাই দেশকে পরিচালিত করছে।

সম্প্রতি দেখা গেছে, বাংলাদেশে ধনী ব্যক্তিদের উত্থান হয়েছে। এটা আমেরিকা ও চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। দ্রুত ধনী লোকের বৃদ্ধি হওয়া মানেই হলো আরেক দিকে দরিদ্র লোক বেড়ে যাওয়া। সে দিক থেকে এটা খারাপ।

এমআই