বাজেটের টাকা কোথা থেকে আসবে ভাবিনি: অর্থমন্ত্রী

বাজেটের টাকা কোথা থেকে আসবে ভাবিনি: অর্থমন্ত্রী

সঙ্কটকালের বাজেট প্রস্তাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি আর রাজস্ব আয়ের বড় লক্ষ্যকে অর্থনীতিবিদরা ‘অবাস্তব’ বললেও অর্থমন্ত্রী আ ম মুস্তফা কামাল তার সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিয়েছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে।

মোট পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার যে বাজেটের ৬৬ শতাংশ অর্থ রাজস্ব আয় থেকে যোগানোর পরিকল্পনার ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, ‘টাকা কোথা থেকে আসবে সে চিন্তা আমরা করিনি। মানুষকে বাঁচাতে হবে, কমর্সংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামের অর্থনীতিসহ সামষ্টিক অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করতে হবে। অর্থ যাই লাগবে সেটা জোগাড় করা হবে।’

আর মহামারীর ধাক্কায় বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য সংশোধন করে যেখানে ৫ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে হয়েছে, কবে এই মহামারী শেষ হবে সেই নিশ্চয়তা যখন কেউ দিতে পারছে না, তখনও নতুন অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করার ব্যাখ্যায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ওই লক্ষ্য তিনি ধরেছেন ‘অতীতের অর্জনের ধারাবাহিকতায়’।

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী উপস্থাপন করেছেন, তাতে অর্থনীতিতে মহামারীর ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার ওপর জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, বরাদ্দে মনোযাগ পেয়েছে স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা আর কৃষি খাত।

মহামারীর মধ্যে গত তিন মাস ধরেই ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় স্থবির, শিল্প উৎপাদনও গতিহারা। আমদানি-রপ্তানি, রেমিটেন্সসহ অর্থনীতির সব সূচকই বাজে অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ফলে বিদায়ী অর্থবছরে রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যের চেয়ে অনেক পিছিয়ে পড়েছে এনবিআর।

তারপরও অর্থমন্ত্রী বাজেটের পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় নির্বাহের জন্য ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হিসেবে আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন, যার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা।

শুক্রবার বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এসে বার বার এ বিষয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে অর্থমন্ত্রী আ ম মুস্তফা কামালকে। করোনা ভাইরাস সঙ্কটে এবারের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন হয়েছে অনলাইনে।

নিজের দেওয়া দ্বিতীয় বাজেটকে ‘মানুষকে রক্ষা করার’ বাজেট হিসেবে বর্ণনা করে মুস্তফা কামাল বলেন, ‘সেই চিন্তা থেকেই আমরা প্রথমে টাকা খরচ করব; পরে আয় করব। আগে মানুষকে বাঁচাতে হবে। তারপর টাকা জোগাড় করব।’

আগের দিন সংসদে দেওয়া বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, এবার দেশের অর্থনীতিতে ‘সেরা প্রবৃদ্ধিটি’ উপহার দেওয়ার প্রত্যয় তার ছিল। সরকারের ইপ্সিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ দশমিক ২ থেকে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ।
‘কিন্তু করোনার প্রভাব সারাবিশ্বের অর্থনীতির হিসাব-নিকাশকে সম্পূর্ণভাবে ওলটপালট করে দিয়েছে।’

তারপরও ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করার কথা জানিয়ে মুস্তফা কামাল বলেন, ‘ইকোনমিস্ট গত ২ মে ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে নবম স্থানে রেখেছে। তাদের হিসাবে আমরা অন্যদের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছি।’

তবে তার ওই লক্ষ্যের সঙ্গে একমত হতে পারেননি অর্থনীতিবিদদের অনেকেই। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম ওই লক্ষ্যকে বলেছেন ‘অবাস্তব’। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর প্রশ্ন করেছেন- ৮.২% প্রবৃদ্ধি ‘কোন যাদুবলে’ আসবে?

বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, সবার আগে মনে রাখতে হবে, এই বাজেট ‘স্বাভাবিক বাজেট নয়’।

‘গতানুগতিক ধারার বাজেট এটা নয়। কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে ক্রান্তিকালের বাজেট। এই ক্রান্তিকালে আমরা পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত তেমন পাইনি। স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ ছিল। ভিন্ন পন্থায় কাজ করতে হয়েছে আমাদের। এছাড়া আমাদের উপায় ছিল না।’

কী সেই ভিন্ন পন্থা? পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত না পেয়ে থাকলে কোন পদ্ধতিতে এবার প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে?

মুস্তফা কামাল বলছেন, ‘সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে অতীতের অর্জনের ধারাবাহিকতায় আমরা বাজেটে ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপির লক্ষ্য ধরেছি।’

‘অতীতের অর্জনে আমরা দেখেছি, গত কয়েক বছর ধরে আমরা ৮ শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। সারা বিশ্বের মত অনেক দেশই এ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি। আমরা, চায়না এবং ভারতই কেবল এমন প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।’

কোভিড-১৯ সঙ্কট ‘দ্রুত মোকাবেলা করতে পারলে’ ওই ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবদ্ধি ঠিকই পাওয়া সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

অর্থমন্ত্রী তার বাজেটে যে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হিসেবে পাওয়ার আশা করছেন, তার মধ্যে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা তিনি চান এনবিআরের কাছ থেকে।

অর্থাৎ, এনবিআরের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা এবার বাড়ছে ৯.৮১ শতাংশ। অথচ আদায় পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় বিদায়ী অর্থবছরে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৩ লাখ কোটি টাকা করতে হয়েছে সংশোধিত বাজেটে।

সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের মতে, এনবিআরের মাধ্যমে ওই টাকা আদায়ের পরিকল্পনা বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘বাস্তবভিত্তিক নয়’। আর এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, ওই লক্ষ্য অর্জন করা ‘সম্ভব নয়’।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে মুস্তফা কামাল বলেন, ‘এ কথা ঠিক যে আমাদের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত খুবই কম। ১০/১১ শতাংশ। এটাকে আমরা নতুন বাজেটের মাধ্যমে ১৫ শতাংশে নিয়ে যেতে চাই। এজন্য এনবিআরকে পুরোপুরি অটোমেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

এই অটোমেশনের কাজটি মহামারীর কারণে বিলম্বিত হলেও এখন যন্ত্রপাতি আনার ব্যবস্থা হয়েছে এবং অটোমেশন হলে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যও পূরণ করা সম্ভব বলে অর্থমন্ত্রী মনে করছেন।

‘আমরা বিশ্বাস করি, কোভিড-১৯ বেশিদিন প্রলম্বিত হবে না। আর সে বিবেচনা থেকেই ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট দিয়েছি। আমাদের অতীতের অর্জন অস্বাধারণ অর্জন। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে প্রতিবছরই আমরা জিডিপির যে লক্ষ্য ধরেছিলাম তার থেকে বেশি অর্জন করেছি। সর্বশেষ গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমরা ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি।’

অর্থমন্ত্রী বলেন, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামো খাতে অনেক উন্নতি হয়েছে। নতুন বাজেটে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তারমধ্যে ১৭টি ইতোমধ্যে চালু হয়েছে।

‘সবকিছু মিলিয়ে আমরা প্রত্যাশা করছি, কোভিড-১৯ থেকে আমরা দ্রুত মুক্ত হব। আমাদের অর্থনীতি আবার সেই আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। আর সেটা যদি হয়, আমরা বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য ধরেছি, সেটা অর্জিত হবে। ৮ দশমিক ২ শতাংশ যে প্রবৃদ্ধি ধরেছি সেটাও অর্জন করতে সক্ষম হব। মোট কথা আমরা বাজেট বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব।’

কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার এবং এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম যার যার বাসা থেকে ভার্চুয়াল এই সংবাদ সম্মেলনে যুক্ত ছিলেন।