করোনার আঘাতে দিশেহারা বস্ত্র খাত, ক্রেতাদের কমপ্লায়েন্স কোথায়

করোনার আঘাতে দিশেহারা বস্ত্র খাত, ক্রেতাদের কমপ্লায়েন্স কোথায়

রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশে ব্রিটিশ বেনিয়া নীলকরদের মতো পোশাক খাতে জেঁকে বসে ক্রেতাদের খবরদারি সংগঠন। যার নাম অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স। সম্প্রতি অ্যাকর্ড বাংলাদেশ থেকে অফিস গুটিয়ে নিলেও তাদের উত্তরসূরিরা রয়ে গেছে। বিশেষ করে ক্রেতাদের চরিত্র বদলায়নি। তারা সব সময় শ্রমিকদের স্বার্থে গলাবাজি করে। কিন্তু বাস্তবে শ্রমিকদের জন্য কিছুই করে না। পণ্যের দাম বাড়ায় না। উল্টো করোনার মহাদুর্যোগে অর্ডার বাতিল করে বসে আছে। সময়মতো কোনো বিল ছাড় করছে না। কমিয়ে দিচ্ছে পণ্যমূল্য। কিন্তু খবরদারি থামেনি। এখন আবার বলছে, সময়মতো শ্রমিক-কর্মচারীরা বেতন না পেলে কমপ্লায়েন্স থাকবে না। গামেন্টসহ বস্ত্র খাতের শিল্প উদ্যোক্তারা এমন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ওদের চরিত্রটা বরাবরই স্ববিরোধী।

তারা বলেন, অতীতে তারা শতভাগ কমপ্লায়েন্সের নামে দিনের পর দিন গার্মেন্ট মালিকদের ওপর বিপুল অঙ্কের খরচের বোঝা চাপিয়েছে। এমনকি তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে সংশ্লিষ্ট কেনাকাটা না করলে নেতিবাচক রিপোর্ট দিয়েছে। পান থেকে চুন খসলেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা একটি স্বাধীন দেশে অবাধে গার্মেন্ট মালিকদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছে। বিধিবহির্ভূতভাবে নাক গলায় ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি ইস্যুতে। কিন্তু এই মহামারীতে তারা মালিক-শ্রমিক কারও পাশে নেই।

এদিকে সরকারের কাছ থেকে গার্মেন্ট মালিকরা সতিক্যারার্থে সহায়তা পাচ্ছেন না। শ্রমিকদের বেতন দেয়ার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল গঠন করা হলেও সেটি নির্ভেজাল ঋণ। যা শিল্প মালিকদের ঋণ হিসেবে দেয়া হয়েছে এবং পরিশোধ করতে হবে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংক শ্রমিকদের হিসাবে টাকা পাঠানোর আগে মালিকদের কাছ থেকে অগ্রিম চেক নিয়েছে। মে মাসের বেতনও একই পন্থায় দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। অথচ বেশির ভাগ কারখানা বন্ধ। যেগুলো চালু আছে সেখানে বড়জোর ৩০-৪০ শতাংশ শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করতে পারছে। বাকিদের দিয়ে কাজ করানোর মতো কাজ নেই। এ অবস্থায় কমপ্লায়েন্স ধরে রাখতে হলে আয় ছাড়াই মালিকদের বিপুল লোকসান দিয়ে বেতন-ভাতা গুনতে হবে। অথচ সরকারের বক্তব্য-বিবৃতি শুনলে মনে হবে, এই সংকটকালীন মুহূর্তে সরকার সব ব্যয় বহন করছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, ব্যবসা টেকসই করতে অতীতে অনেক আলোচনা হলেও পোশাক ক্রয়ের ক্ষেত্রে নিয়মনীতি মানছে না ক্রেতারা। অনেক ক্রেতা পোশাকের দাম না দিয়েও শ্রমিকের বেতন-ভাতা পরিশোধের চাপ দেয়। এটি একেবারেই অন্যায্য। তিনি আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের ব্যবসা হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে। তাই ক্রেতাদের র‌্যাংকিং করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যেই বকেয়া পরিশোধে কয়েকটি ব্র্যান্ডকে চিঠি দেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর দেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলো সংস্কারে বাংলাদেশে কাজ শুরু করে উত্তর আমেরিকার ক্রেতা জোট অ্যালায়েন্স ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড। কমপ্লায়েন্সের নামে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স পোশাক খাতের ওপর বিধিবহির্ভূত খবরদারি শুরু করে। ঠুনকো সব অজুহাতে খ্যাতনামা কারখানাকে নন-কমপ্লায়েন্স ঘোষণা করে। এরপর সংস্কারের নামে নিজেদের মনোনীত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তা সামগ্রী কিনতে বাধ্য করে। যাতে উদ্যোক্তাদের কারখানা সংস্কারে ২-৫ কোটি টাকা খরচ হয়। এছাড়া কারখানা সংস্কারের বাইরে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোকে পর্দার আড়াল থেকে উসকানি দেয় জোট দুটি। এমনকি শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর জন্যও হস্তক্ষেপ করে।

ক্ষতিগ্রস্ত গার্মেন্ট মালিকরা বলছেন, দেশে-বিদেশে দু’জায়গাতেই ক্ষতিগ্রস্ত গার্মেন্ট মালিকরা। করোনা প্রভাবে বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার স্থগিত-বাতিল করেছে। পেমেন্টের শর্ত শিথিল করে নিচ্ছে। অন্যদিকে পণ্যের দাম কমিয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের বেতন দেয়ার ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে, যা স্ববিরোধী অবস্থান। এর আগেও কমপ্লায়েন্সের নামে মালিকদের রক্ত শোষণ করেছে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স। প্রায় আড়াই হাজার কারখানাকে সংস্কারের নামে মোটা অংকের খরচ করায়। সেই ঋণের বোঝা এখনও বহন করছেন বহু গার্মেন্ট মালিক। প্রশ্ন হল, এখন অর্ডার বাতিল করার ক্ষতিপূরণ কে দেবে? শর্তের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে এতদিন যারা খবরদারি করেছে, সেই আন্তর্জাতিক ক্রেতা সংগঠনগুলোর ভূমিকা তাহলে কাদের স্বার্থে? শ্রমিক-মালিক- না শুধু নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ছড়ি ঘোরানো। এছাড়া এদের বিষয়ে সরকারের কোনো বক্তব্য নেই কেন?

ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প মালিকরা আরও বলেন, সরকারের উচিত ছিল, রফতানি আয়ের প্রধান খাত হিসেবে সত্যিকার অর্থেই প্রণোদনা দেয়া। অফেরতযোগ্য প্রণোদনা শিল্প মালিকদের দেয়া হলে শ্রমিকদের বেতন দেয়া নিয়ে এত জটিলতা হতো না। অন্যদিকে শ্রমিকদের বেতন দেয়ার বিষয়েও সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের বলি গার্মেন্ট মালিকরা। কারখানা বন্ধ থাকাকালীন সময়ে শ্রমিকদের ৬০ ভাগ বেতনের যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তাও বাস্তবতার নিরিখে নেয়া হয়নি। চাহিদা অনুযায়ী কারখানায় শ্রমিক প্রয়োজন না পড়লে কোন মালিক বসিয়ে বেতন দেবেন? শ্রমিক-কর্মচারীদের বসিয়ে রেখে বেতন কে দেবে, কিভাবে দেবে? সরকারি প্রণোদনা তো ঋণ। এটি মালিককেই পরিশোধ করতে হবে। তাহলে করোনার মহাসংকটে শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য বাস্তবিকঅর্থে সরকারের সহায়তা কোথায়?

এ বিষয়ে এফবিসিসিআইর সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বৈশ্বিক এ মহামারীর সময় বিদেশি ক্রেতাদের যে ধরনের আচরণ করার কথা ছিল তা অনেকে করেনি। বেশির ভাগ ক্রেতা অর্ডার স্থগিত-বাতিল, পেমেন্ট শর্ত পরিবর্তন করেছে। যদিও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ব্যক্তি উদ্যোগে গার্মেন্ট মালিকরা বেশকিছু অর্ডার ফেরত এনেছেন। তবে এ মুহূর্তে উদ্যোক্তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের জায়গা পণ্যের দাম কমে যাওয়া এবং ডলারের অতিমূল্যায়ন। ভবিষ্যতে পোশাক শিল্পের অবস্থা কোন দিকে যাবে, তা জুনের শেষ দিকে বোঝা যাবে।

তিনি আরও বলেন, সরকার শ্রমিকদের বেতন দিতে স্বল্প সুদে যে ঋণ দিয়েছে তা মে মাসের বেতনের মাধ্যমে শেষ হয়ে গেছে। এ ঋণের বাইরেও অনেক মালিককে নিজস্ব তহবিল থেকে শ্রমিকদের বেতনের অর্থ দিতে হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সহসাই পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। তাই অন্তত জুন-আগস্ট পর্যন্ত ৩ মাস যে কোনোভাবে সরকারকে এ খাতে নীতি-সহায়তা চলমান রাখতে হবে।

এদিকে ২১ মে যুক্তরাজ্যভিত্তিক পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এডিনবার্গ উলেন মিল ইডব্লিউএম গ্রুপকে বকেয়া পরিশোধ না করলে কালো তালিকাভুক্ত করার হুমকি দেয় বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। যা সব মহলের কাছে প্রশংসিত হয়। ইডব্লিউএম গ্রুপের অধীনে পিকক, জ্যাগার, বনমারশে, জেন নরম্যান, অস্টিন রিডসহ কয়েকটি ব্র্যান্ড রয়েছে। চিঠিতে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে পাওনা অর্থ পরিশোধের জন্য একটি সময় বেঁধে দেয়া হয় এবং পাওনা পরিশোধে সময়সীমা পেরিয়ে গেলে তাদের কালো-তালিকাভুক্ত করা হবে বলে জানানো হয়।

ইডব্লিউএমকে বকেয়া অর্থ পরিশোধ ও নির্দেশনাগুলো মেনে চলার অনুরোধ জানিয়ে রুবানা হক ই-মেইলে লেখেন, নির্দেশনা অনুসরণ না করলে ইডব্লিউএম ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা ছাড়া বিকল্প উপায় থাকবে না। সেটি হলে ভবিষ্যতে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্যদের সঙ্গে ইডব্লিউএম ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হবে।

বিকেএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এ মহামারীতে বিদেশি ক্রেতাদের অবস্থান একেবারেই অনৈতিক। আগে ক্রেতারা ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি ইস্যুতে গার্মেন্ট মালিকদের নৈতিকতা শেখাত। এখন তারাই সম্পূর্ণ অনৈতিক কাজ করছে। অর্ডার বাতিল করা, বিদেশে শিপমেন্ট হওয়া পণ্যের পেমেন্ট দিতে ১৮০ দিন শর্তারোপ করছে। তারপরও সব মুখ বুঝে সহ্য করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, পোশাক খাতের এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। হাতে কাজ নেই। জুনের বেতন কিভাবে দেয়া হবে তা কেউই বলতে পারছে না। তাই সরকারের উচিত স্বল্পসুদে ঋণের তহবিল অন্তত ৩ মাসের জন্য সম্প্রসারণ করা।সূত্র : যুগান্তর

এমজে/