দাম কমার আশা কম

দাম কমার আশা কম

নিত্যপণ্যের দাম শিগগিরই কমার বিষয়ে কোনো আশার কথা শোনাতে পারল না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা ও ব্যবসায়ীকে নিয়ে গতকাল সোমবার এক বৈঠকের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উল্টো জানিয়েছে, পেঁয়াজের বাজার এক মাস ‘একটু নাজুক’ থাকবে।

বৈঠকে ভোজ্যতেল ও চিনির দাম নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। সূত্র জানিয়েছে, ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর যে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন, তা নিয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনে (বিটিটিসি) শিগগিরই বৈঠক হবে। সেখানে দাম বাড়ানো নিয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে।

অবশ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভোজ্যতেল ও চিনির কর কমানো নিয়ে এক মাস আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দেওয়া হয়েছে। নতুন করে চিঠি দেওয়া হয়েছে পেঁয়াজের ৫ শতাংশ শুল্ক তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে।

বৈঠকে চাল, আটা, ময়দা, মুরগি, গুঁড়া দুধ, সবজি, সাবান, টিস্যু ও তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম নিয়ে আলোচনা হয়নি।

এসব পণ্যের বেশির ভাগ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীনও নয়। সব মিলিয়ে মানুষের জন্য তেমন কোনো স্বস্তির খবর নেই। বরং দুশ্চিন্তার বিষয় এই যে বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারদর বাড়তি।

এদিকে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম বাড়ছে। চায়ের দোকানে এক কাপ চা পান করতে বাড়তি লাগছে এক থেকে দুই টাকা। রুটি-বিস্কুটের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ছাত্রাবাস, মেস, রিকশার গ্যারেজসহ বিভিন্ন জায়গায় খাবারের দামও বাড়িয়ে দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। গত রোববারই রান্নার গ্যাসের দাম বেড়েছে।

বাণিজ্যে সভা

দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভা শেষে অনলাইনে যুক্ত হয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। অন্যদিকে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ এবং এনবিআর, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি), ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী নেতারা বৈঠকে সশরীরে অংশ নেন।

সভার শুরুতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান একটি উপস্থাপনায় জানান, বিশ্ববাজারে গত এক বছরে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পাম তেলের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৭০ ও ৭৬ শতাংশ। বিপরীতে বাংলাদেশে বেড়েছে যথাক্রমে ৪৩ ও ৫৪ শতাংশ। বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত চিনির দাম বেড়েছে ৪৫ শতাংশের মতো। দেশে বেড়েছে ২৭ শতাংশ।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখন তেল ও চিনির যেসব চালান আসছে, সেগুলোর দাম অনেক বেশি পড়ছে। নতুন দাম কার্যকর হলে বিশ্ববাজার ও বাংলাদেশে মূল্যবৃদ্ধির হারের পার্থক্য কমে আসবে। ব্যবসায়ীরা বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি আরও ১১ টাকা বাড়িয়ে ১৬৪ টাকা ও চিনির দাম ৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮৪ টাকা করার প্রস্তাব ট্যারিফ কমিশনে জমা দিয়ে রেখেছেন। নতুন করে মূল্য সমন্বয়ের সভা শিগগিরই অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে গত ৯ সেপ্টেম্বর চিনির দাম খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৭৪ থেকে ৭৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা টিসিবির গতকালের বাজারদরের তালিকা বলছে, চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭৯ থেকে ৮০ টাকা দরে।

ব্যবসায়ীদের নতুন করে দাম বাড়ানোর যে প্রস্তাব, তা থেকে ভোক্তাদের রক্ষার একটি উপায় হিসেবে কর ছাড়কে দেখা হচ্ছে। ভোজ্যতেল আমদানিতে তিন স্তরে ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) রয়েছে। চিনিতে আমদানি শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, অগ্রিম কর (এটি) ও অগ্রিম আয়কর (এআইটি) রয়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, এখন এক কেজি চিনিতে মোট কর দাঁড়ায় ২৮ টাকার মতো। আর প্রতি লিটার সয়াবিন তেলে কর দাঁড়ায় ২০ টাকার বেশি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে গতকালের বৈঠক শেষে বাণিজ্যসচিব বলেন, তেল ও চিনির ওপর শুল্ক-কর কমাতে মাসখানেক আগেই এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হয়।

অবশ্য আগেও এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। তাতে সাড়া পাওয়া যায়নি। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্যসচিব গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রাজস্ব কর্মকর্তাদের চিন্তা থাকে রাজস্ব আদায় নিয়ে। এখন কর ছাড় দিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্দেশনা দরকার।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন কর যদি কিছুটা কমিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে দাম যতটা বাড়ার কথা, ততটা হয়তো বাড়বে না। তবে কমার আশা কম।

পেঁয়াজের বাজার এক মাস ‘নাজুক’

দেশে সপ্তাহ দুয়েক আগে এক কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০ টাকার মতো। সেই দাম এ সপ্তাহে ৮০ টাকা ছোঁয়। বাণিজ্যসচিব গতকালের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, আগামী এক মাস পেঁয়াজের বাজার পরিস্থিতি একটু নাজুক থাকবে। উৎপাদন পরিস্থিতি ও ভারতে দাম বাড়ার চিন্তা থেকে এটি মনে হয়েছে তাঁর। তবে তাঁর আশা, পেঁয়াজের দাম যতটা বেড়েছে, সেখানেই স্থিতিশীল থাকবে।

দাম যাতে সহনীয় থাকে, সে জন্য আমদানি সহজ করা ও বাজারে তদারকি বাড়ানোর উদ্যোগের কথা জানান বাণিজ্যসচিব। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ-ও বলছে, দেশে পাঁচ লাখ টন পেঁয়াজ মজুত আছে। আমদানিও হচ্ছে। মানুষ যাতে আতঙ্কিত না হয়।

এদিকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে শুল্ক (৫%) তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এনবিআরের সদস্য (শুল্কনীতি) সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধ পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

অবশ্য ৫ শতাংশ শুল্ক তুলে নিলে পেঁয়াজের দামে খুব যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, সে আশা করে লাভ নেই। ভারতে পেঁয়াজের প্রতি টনের দর এখন ৩৪৪ মার্কিন ডলার। এ দরে আমদানি করলে কেজিতে দেড় টাকার মতো কর পড়ে।

রুটি, বিস্কুট ও পরোটার দাম বাড়ছে

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সরাসরি সংসারের ব্যয় যেমন বাড়িয়ে দিচ্ছে, তেমনি বাড়ছে রেস্তোরাঁয় খাবারের দামও। যেমন কারওয়ান বাজারের আল সাফিন রেস্তোরাঁ বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে দিয়ে ক্রেতাদের জানিয়েছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য সকালের নাশতার রুটি ও পরোটার দাম ১০ টাকা করা হয়েছে, যা কার্যকর হয়েছে ২০ সেপ্টেম্বর। এই দর আগে ছিল ৭ টাকা। রেস্তোরাঁটির ব্যবস্থাপক মাহবুবুল হক মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে দ্রব্যমূল্য যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে দাম না বাড়িয়ে কোনো উপায় ছিল না।

ফুটপাতের চা-দোকানে বিক্রি হওয়া বিভিন্ন ধরনের রুটি প্রতিটি ৮ থেকে ১০ টাকায় পাওয়া যেত, যার দাম বেড়েছে দুই থেকে তিন টাকা। একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ১২ টাকার একটি রুটি দোকানে বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকায়। যেসব বিস্কুট তিন টাকা ছিল, তা এখন চার থেকে পাঁচ টাকা রাখছেন বিক্রেতারা।

চায়ের দোকানমালিকেরা বলছেন, চিনি ও দুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাঁরা এক কাপ চায়ের দাম এক থেকে দুই টাকা বাড়িয়েছেন। ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের চায়ের দোকানি সবুজ মিয়া এক কাপ চায়ের (তরল দুধ মিশ্রিত) দাম ৩ টাকা বাড়িয়ে ১০ টাকা করেছেন। তিনি বলেন, ‘দাম না বাড়িয়ে চলব কী করে।’

এখন ১৪০ টাকা

নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় কিছু কিছু ছাত্রাবাস, মেস ও রিকশার গ্যারেজে খাবারের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নীলখেত কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের নিবাসী আঞ্জুমান লায়লা প্রথম আলোকে বলেন, এক মাস আগে তাঁদের ক্যানটিনে এক টুকরো মুরগির মাংসের দাম ছিল ২২ টাকা। এখন সেটা ২৫ টাকা নেওয়া হচ্ছে। মাছের দাম বেড়েছে প্রতি টুকরায় ৫ টাকা। তিনি বলেন, মুরগির টুকরার আকার আরও ছোট হয়েছে। ভাত রান্নার চালের মান কমেছে।

রিকশাচালকদের বেশির ভাগ ঢাকায় রিকশার গ্যারেজে থাকেন। সেখানে থাকা ও খাবারের মূল্য বাবদ ১১০ থেকে ১২০ টাকা নেওয়া হতো। এখন ২০ টাকার মতো বাড়ানো হয়েছে। জামালপুরের বকশীগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসা রিকশাচালক মোস্তফা জালাল বলেন, বাড়তি ব্যয় তিনি কিছুটা বাড়তি ভাড়া নিয়ে ওঠাচ্ছেন।

রিকশাচালকেরা বাড়তি ভাড়া নিয়ে বাড়তি খরচ পুষিয়ে নিচ্ছেন। ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়িয়ে বাড়তি ব্যয় সামলাচ্ছেন। বিপাকে আছেন সীমিত আয়ের মানুষ, যাঁদের মাস শেষে পাওয়া নির্দিষ্ট বেতনে চলতে হয়।-প্রথম আলো