রমজানের বাজারের আঁচ দেড় মাস আগেই

রমজানের বাজারের আঁচ দেড় মাস আগেই

রমজানের প্রায় দেড় মাস বাকি থাকলেও সংযমের ওই মাসটি ঘিরে প্রয়োজনীয় বেশকিছু পণ্যের দাম এরই মধ্যে চড়তে শুরু করেছে। অন্য বছরগুলোতে সবজির দাম শীতের ভরা মৌসুমে কম থাকলেও এবারের বাজারের ছবি ভিন্ন। সব সবজির দাম এবার বেশি। চাল-ডাল, পেঁয়াজসহ আরও কিছু পণ্যের দর আগে থেকেই লাগামহীন। আমদানিনির্ভর পণ্যগুলোর দামও বাড়ছে হুহু করে। নিত্যপণ্যের দর অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় ক্রেতারা পড়েছেন মহাবিপদে।

সরকারি বিপণন সংস্থা (টিসিবি) প্রতিদিন প্রকাশ করে বাজারদরের তালিকা। গতকাল বৃহস্পতিবার পণ্যের কমবেশির তালিকা ঘেঁটে দেখা যায়, এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২০টি পণ্যের মধ্যে ১৭টির দামই বেড়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে চাল, আটা, ময়দা, সয়াবিন তেল, পাম তেল, পেঁয়াজ, মুরগি, গরুর মাংস, চিনি, ডিম, জিরা ইত্যাদি।

গতকাল রাজধানীর কারওয়ানবাজারে কথা হয় ক্রেতা শিহাব উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'চার দিন আগে পেঁয়াজ কিনেছি ৩০ টাকা কেজিতে। আজ কিনলাম ৫০ টাকায়। রমজানে পেঁয়াজের চাহিদা বাড়ে বলে দেড় মাস আগেই দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়া এবং বিশ্ববাজারে পণ্যের দর বাড়তি- এমন অজুহাতে কয়েক মাস ধরেই জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছেন তারা। এখনই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে রমজানে ক্রেতারা আরও অসহায় হয়ে পড়বেন।'

দেশি পেঁয়াজের মৌসুম এখনও শেষ হয়নি। তারপরও ঝাঁজ বেড়েছে পণ্যটির। গত সোমবার দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়। তিন-চার দিনের ব্যবধানে কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা। আর আমদানি করা পেঁয়াজের কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। যা কয়েক দিন আগে পাওয়া যেত ৩৫ থেকে ৪৫ টাকায়।

ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি বোতলজাত সয়াবিনের লিটারে আট টাকা বাড়িয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাজারে এক লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকায়। বোতলজাত সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে বোতলের গায়ে দর লেখা থাকলেও খোলা সয়াবিনে সে সুযোগ নেই। ফলে খোলা সয়াবিন আর পাম তেল বিক্রি হচ্ছে আরও বেশি দামে। খুচরা বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা এবং পাম তেল ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কারওয়ানবাজারের এক খুচরা ব্যবসায়ী বলেন, 'খোলা সয়াবিন তেল কেউ কেনেন আধা লিটার, কেউ এক লিটার। ফলে বোতলজাত সয়াবিনের চেয়ে খোলা সয়াবিন তেলের ক্রেতা বেশি। তবে সরবরাহ কম; তাই খোলা সয়াবিনের দাম বেশি।'

কয়েক মাস স্থির থাকার পর আবার নড়েচড়ে উঠেছে চিনির বাজার। চিনির চাহিদাও রমজানে বাড়ে। গত সপ্তাহে প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হয়েছিল ৭৫ থেকে ৭৬ টাকা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে তিন থেকে চার টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৭৮ থেকে ৮০ টাকায়। তিন-চার মাস আগে ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৯০ টাকায় উঠেছিল। তবে ধীরে ধীরে কমে এখন এ মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায়। আর সোনালি জাতের মুরগির কেজি ২৬০ থেকে ২৭০ টাকা। ডিম বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা ডজন।

চার থেকে পাঁচ মাস ধরে মসুর ডালের দাম বাড়তি। বাজারে দেশি মসুর ডালের কেজি গত সপ্তাহের চেয়ে পাঁচ টাকা বেড়েছে। গত সপ্তাহে প্রতি কেজি দেশি মসুর ডাল ১১০ থেকে ১১৫ টাকায় বিক্রি হলেও এখন দাম ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। আর আমদানি করা বড় দানার মসুর ডালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ১০০ টাকায়। বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় টিসিবি তাদের ট্রাকে গত তিন মাসে পাঁচ টাকা করে দুই দফায় ১০ টাকা দাম বাড়িয়েছে পণ্যটির। রমজানে সাধারণত ছোলার চাহিদা বেশি থাকে। ছোলার কেজি এখনই বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা দরে। মাস দেড়েক আগেও পণ্যটি বিক্রি হয়েছিল ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়।

ভালো ফলনেও কমছে না চালের দাম: কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ধান উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তিন কোটি ৯৫ লাখ টন। আমন ও আউশ মৌসুমে ফলন হয়েছে ভালো। বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে আমদানিও করা হয়েছে চাল। খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, চালের মজুতও রয়েছে রেকর্ড পরিমাণে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চালের মজুত ছিল ১৭ লাখ ১৫ হাজার টন। এর পরও কমেনি দাম। বাজারে মোটা চালের দাম এখন ৪৮ থেকে ৫২ টাকা। প্রতি কেজি মিনেকেট চাল ৬২ থেকে ৬৫ এবং নাজিরশাইল ৬৫ থেকে ৭২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

মৌসুমজুড়েই শীতের সবজির দাম চড়া: শীতের সবজির মৌসুম এখন শেষ পর্যায়ে। এবার পুরো মৌসুমেই চড়া ছিল সবজির বাজার। দুই-একটি ছাড়া বেশিরভাগ সবজির কেজি ৪০ টাকার ওপরে। কোনোটির দাম ১০০ টাকাও ছুঁয়েছে। একটি ফুলকপির দাম এখনও ৪০ থেকে ৫০ টাকা। মুলা বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা কেজিতে। একটি লাউ কিনতে গেলে এখন ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা।

ভোক্তাদের সোচ্চার হতে হবে: কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সমকালকে বলেন, 'সবার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। যারা বাজারে গিয়ে নিজেদের অসহায় মনে করে, তাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। নতুবা সরকার শুনবে না।'

তিনি আরও বলেন, 'জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কয় দিন পর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দাবি তুলবেন তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর জন্য। সরকার হয়তো তাই-ই করবে। সাধারণ মানুষের তো আয় বাড়ছে না। কষ্টটা তাদেরই বেশি হবে। সে জন্য নিত্যপণ্যের বাজারে এখনই লাগাম টানতে হবে।'-সমকাল