‘গত মাসে আলুভর্তাই বেশি খাইছি’

‘গত মাসে আলুভর্তাই বেশি খাইছি’

সপ্তাহ বিরতিতে ঢাকার রাস্তায় আবার ট্রাকে করে সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্যপণ্য বিক্রি শুরু করেছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। তবে কোথাও ট্রাক না আসায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা শেষে ফিরে গেছেন লোকজন। কোথাও অতিরিক্ত ভিড় হওয়ায় হয়েছে ধস্তাধস্তি। লাইন ভেঙে পণ্য নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারির পর আজ রোববার আবার ‘ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে পণ্য বিক্রয় কার্যক্রম’ শুরু করেছে টিসিবি। চলবে ২৪ মার্চ পর্যন্ত। ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন পয়েন্টে ১৫০টি ট্রাকে চিনি, মসুর ডাল, সয়াবিন তেল ও পেঁয়াজ—এ চারটি খাদ্যপণ্য পাওয়া যাবে। শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন বিক্রি হবে এসব পণ্য।

আজ সকাল ১০টা থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও বছিলা এলাকা ঘুরে দেখেন এই প্রতিবেদক। বছিলায় প্রায় ২০০ নারী–পুরুষ পণ্য নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাঁদের অনেকে বলেন, সর্বশেষ পণ্য বিক্রির দিন বলা হয়েছিল, ৬ মার্চ (আজ) আবার গাড়ি আসবে। কিন্তু গাড়ি আসেনি। তাই কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করে বেলা একটার দিকে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন তাঁরা।

হাসিনা বেগম বছিলা এলাকার একজন গৃহকর্মী। গত মাসে টিসিবির পণ্য কিনতে এসেছিলেন চারবার। কিন্তু অন্যের বাসায় কাজ শেষ করে আসতে দেরি হওয়ায় পণ্য পাননি এক দিনও। তাই আজ এসেছিলেন সকাল সাড়ে আটটায়। আর আজ গাড়িই আসেনি।

পণ্য কিনতে আসা নারীদের সারিতে ৩০ নম্বরে ছিলেন হাসিনা বেগম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে গাড়ির দেখা না পাওয়ায় অন্যদের মতো তিনিও ছিলেন ক্লান্ত–ক্ষুব্ধ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, কাজ করে সব মিলিয়ে আড়াই হাজার টাকা পান। তা দিয়ে দুই বাচ্চার দেখভাল করতে হয়। শ্বশুরের বাসায় থাকেন। তবে আয়ের পুরোটাই চলে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে।

কাজ ফেলে পণ্য নিতে আসা হাসিনা বেগমের কণ্ঠে ছিল হতাশা। বলেন, ‘গত মাসে আলুভর্তাই বেশি খাইছি। তেল পাই নাই তো, তাই তরকারি বেশি রান্না করতে পারি নাই। বাচ্চারা আবার ভাজি, তরকারি, ডাল খাইতে চায়। বাইরে তো কিনতে পারি না।’

চিনি, ডাল, তেল ও পেঁয়াজ—টিসিবির গাড়ি থেকে চারটি পণ্যেরই প্রতিটি দুই কেজি করে কেনেন হাসিনা বেগম। আর বাইরে থেকে কেনেন মোটা চাল। বলেন, ‘দুই কেজিতে সারা মাস চালাই। দুই কেজির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়াই থাকতে হইল। তেল পাইলেও মনডা মানত। আইজও পাইলাম না।’

বয়োবৃদ্ধ, নারী, শিশু, এমনকি অসুস্থ ব্যক্তিও ছিলেন টিসিবির গাড়ির অপেক্ষায়। তাঁদের কেউ কেউ জানান, তিন মাস ধরে গাড়ি ঠিকমতো আসে না। মাঝেমধ্যে আসে।

ইমাম হোসেন নামের একজন দোকানি টিসিবির ডিলারদের অনুরোধে পণ্য নিতে আসা ব্যক্তিদের হাতে সিরিয়াল নম্বর লিখে দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, নতুন ডিলার নিয়োগ হয়েছে এখানে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে এখনো যোগাযোগ হয়নি। প্রতিদিনই লোকজন পণ্য দেওয়ার তারিখ না জানতে এসে ঘুরে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষ পাগল হয়ে গেছে।

মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা গেল, নারী–পুরুষের দীর্ঘ লাইন। বিশৃঙ্খলা করছেন কেউ কেউ। সারির মাঝে প্রবেশের চেষ্টা করছেন তাঁরা। আবার সামনে গিয়ে সারির বাইরে থেকে পণ্য নেওয়ার চেষ্টা করছেন দু–একজন। এ প্রতিবেদক সেখানে থাকা অবস্থায় নারীদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয় বেশ কয়েকবার। হয় চিৎকার-চেঁচামেচি। কটুকথাও বলেন কেউ।

টিসিবির পণ্যের জন্য অপেক্ষারত নারীদের কয়েকজন জানালেন, একজন সকালে কলম দিয়ে হাতে সিরিয়াল লিখে দিয়ে গেছেন। তবে একই সিরিয়াল দুজনের হাতেও দেখা গেল।

রোজিনা আক্তার সারির মাঝামাঝি ঢোকার চেষ্টা করছিলেন। তাঁর হাতে সিরিয়াল নম্বর ‘৭৭’। একই সিরিয়ালের আরেক নারী লাইনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। রোজিনা আক্তারের দাবি, তিনি সকালে এসে সিরিয়াল নম্বর নিয়ে চলে যান বাসায়। সন্তানকে পড়তে পাঠিয়ে আবার এসেছেন।

সারিতে থাকা অন্যরা রোজিনার দাবি মানছিলেন না। তাঁরা বলছিলেন, তিনি নিজে সিরিয়াল লিখে এনেছেন। এ পর্যায়ে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন তাঁরা। প্রতিবেদক সেখানে সাড়ে ৩ ঘণ্টা অবস্থানকালে এমন হাঙ্গামা হতে দেখেন বেশ কয়েকবার।

মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে পণ্য দেওয়া শুরু হয় সকাল পৌনে ১০টার দিকে। কিছুক্ষণ পর কথা হয় মোহাম্মদ এবাদত হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কড়া রোদে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে আছি। আসার পর ১৩ জনের পেছনে ছিলাম; এখন আছি ২০ জনের পেছনে। অনেকের খাতিরের লোক লাইনে ঢুকছে।’

পণ্য বিক্রেতা মোহাম্মদ দেলোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিরিয়াল (সারি) ঠিক না করলে পণ্য দেব ক্যামনে? আমি তো তর্ক করতে যাব না। পণ্য, টাকা হিসাব করতে করতেই হয়রান।’

মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে পণ্য বিক্রির কার্যক্রম দেখতে এসেছিলেন ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল ইসলাম। ধস্তাধস্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব পয়েন্টেই (পণ্য দেওয়ার স্থান) এমন হুড়োহুড়ি হচ্ছে। মানুষজনকে মানানো যায় না। এক পরিবার থেকে একাধিক ব্যক্তি দাঁড়ানোর অভিযোগও হরহামেশা শোনা যায়। কিন্তু কেউ লাইনে দাঁড়ালে তো আমরা পণ্য দিতে বাধ্য। যাচাই করার সময় কোথায়?’

টিসিবির ট্রাকে চিনি প্রতি কেজি ৫৫ টাকা, মসুর ডাল ৬৫ টাকা, সয়াবিন তেল লিটার ১১০ টাকা ও পেঁয়াজ প্রতি কেজি ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একজন দুই কেজি করে পণ্য ও দুই লিটার তেল কিনতে পারেন।