দেশে খেলাপি ঋণ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে

দেশে খেলাপি ঋণ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে

১৯৯০ সালেও দেশে খেলাপি ঋণ ছিল ৪ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। সেই খেলাপি ঋণ এখন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গত ১৪ বছরে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে তখন খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা।

ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রধান কারণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। এখানে বছরের পর বছর ধরে খেলাপিদের নানা ধরনের ছাড় দেওয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা বদলানো হয়েছে বারবার। আইন সংশোধন করে একাধিকবার ঋণ তফসিলের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। আর এসব সুযোগ-সুবিধা নিয়েই বড় বড় ঋণখেলাপি খেলাপির তালিকা থেকে বাইরে থেকে গেছেন। হয়েছেন আরও ক্ষমতাবান।

১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পরে অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান জাতীয় সংসদে খেলাপি ঋণগ্রহীতার নাম প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৯৬ সালের পরে আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া তালিকা প্রকাশ করে প্রভাবশালী ঋণখেলাপিদের রোষানলে পড়েছিলেন। সেই প্রভাবশালীরাই এখন সরকারের দেওয়া নানা সুযোগ নিয়ে খেলাপির তালিকা থেকে বের হয়ে গেছেন। এমনকি তাঁরাই এখন খেলাপি ঋণের ছাড় কীভাবে দেওয়া হবে, সেই নীতিমালাও তৈরি করে দিচ্ছেন।

যেভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ

দেশে এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসেই (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক খাতে গত জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। এই হিসাবে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে খেলাপি বেড়েছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের হার এখন ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংক বলছে, প্রতিযোগী এবং তুলনীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হারই সবচেয়ে বেশি। কেবল ভারতের খেলাপি ঋণের হার বাংলাদেশের কাছাকাছি, আর সবার অনেক কম। এই খেলাপি ঋণই ব্যাংকিং খাতের বড় সমস্যা।

কে কী বলছেন

অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে প্রধান করে গঠিত ব্যাংক সংস্কার কমিটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল ১৯৯৯ সালে। কমিটি তাদের রিপোর্টে বলেছিল, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহ রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা বণ্টনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হইয়াছে, যাহাও খেলাপি ঋণের অন্যতম কারণ। স্বার্থান্বেষী ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীসমূহের বিরোধিতা ব্যাংকিং খাত সংস্কারের সম্ভবত সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। এ কারণে সংস্কার কর্মসূচি সফল করতে হলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার।’ মূলত এই অঙ্গীকারই কখনো দেখা যায়নি বলেই খেলাপি ঋণ ক্রমান্বয়ে বেড়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০১৯ সালে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলেছিল, ‘বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার প্রবণতার শিকড় অত্যন্ত গভীরে। আবার প্রভাবশালী, ওপর মহলে ভালো যোগাযোগ আছে এবং ধনী, এমন কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেওয়ার কোনো তাগিদই অনুভব করেন না। বাংলাদেশে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও এখন নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান এসব ঋণগ্রাহক।’

আইএমএফ আরও বলেছিল, ‘বাংলাদেশে খেলাপি আড়াল করে রাখা আছে। খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করা হয়, প্রকৃত খেলাপি ঋণ তার তুলনায় অনেক বেশি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ হবে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা।’ আইএমএফের এই বক্তব্য ছিল তিন বছর আগের। ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, এখন হিসাব করলে প্রকৃত খেলাপি হবে ৪ লাখ কোটি টাকারও বেশি।

বিশ্বব্যাংক গত অক্টোবর মাসে ‘চেঞ্জ অব ফ্যাব্রিক’ নামে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা বলেছে, দুর্বল করপোরেট শাসন, আইনের প্রয়োগের দুর্বলতা এবং স্বচ্ছতার অভাব ব্যাংক খাতকে বড় ধরনের ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। এতে ব্যাংক খাতের অপব্যবহারের সুযোগও বেড়েছে। অনেকগুলো আর্থিক কেলেঙ্কারি এবং উচ্চ খেলাপি ঋণ এরই প্রমাণ।

যেভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন হওয়া সংজ্ঞা হচ্ছে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা। দেশে প্রথম খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। তবে পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞাটি ছিল ১৯৯৪ সালের। এর পর থেকে যতগুলো সরকার এসেছে, সবাই এর সংজ্ঞা নিজেদের মতো করে পরিবর্তন করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খেলাপি হওয়ার সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। আবার খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ কতবার পুনঃ তফসিল করা যাবে, তারও পরিবর্তন করা হয়েছে বেশ কয়েকবার।

২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর শুরুতে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যেমন, ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার জারি করে বলেছিল, কোনোভাবেই তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃ তফসিল করা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালাটিও ধরে রাখতে পারেনি। প্রভাবশালীদের তদবির ও চাপে পিছু হটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে তিন মাস সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

প্রভাবশালী ঋণখেলাপি ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে ২০১৫ সালে। সে সময় খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলের বিশেষ এক স্কিম হাতে নেওয়া হয়। তখন নিয়ম ছিল তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃ তফসিল করা যায় না। কিন্তু বেশির ভাগ প্রভাবশালী উদ্যোক্তাই তিনবার সুযোগটি নিয়েও খেলাপি হয়ে পড়েছিলেন। এরপরেই ঋণ পুনর্গঠন নামে নতুন এক সুবিধা দেওয়া হয়। ওই সুবিধার আওতায় দেশের বড় ১১টি শিল্প গ্রুপের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল। তারপরও এসব গ্রুপের বেশির ভাগই ঋণের কিস্তি আর পরিশোধ করেনি।

২০১৮ সালে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞার আবার বদল হয়। ঋণ পরিশোধের সময় আরও তিন মাস বাড়ানো হয়। একই সময় ঋণ অবলোপন বা রাইট অফের ক্ষেত্রেও বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়। তবে ২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দেশের ইতিহাসে ঋণখেলাপিদের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধাটি দেন। সে সময় ২ শতাংশ কিস্তি দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ রাখা হয়। নতুন নিয়মে ঋণ পরিশোধের জন্য ১০ বছর সময় দেওয়া হয়, এর মধ্যে প্রথম এক বছর কোনো কিস্তি দিতে হয়নি। সেই সুযোগ নেওয়া বেশির ভাগই পরে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

এবার আরেক বিপদ

খেলাপি ঋণ নিয়ে এবার সত্যিকারের নতুন এক বিপদে পড়েছে ব্যাংকিং খাত। এত দিন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় খেলাপি ঋণ বাড়তে দেওয়া হয়েছে, আর এখন পরিস্থিতি সামাল নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ব্যাংক খাতে। এখন দুষ্ট ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অনেক ভালো ব্যবসায়ীও ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন। এতে সামনে খেলাপি ঋণ আরও বেশি বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।

অর্থনৈতিক সংকট চলছে বিশ্বব্যাপীই। বিশ্বমন্দার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। ডলারের দামের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। ফলে উৎপাদিত পণ্য সেভাবে বিক্রিও হচ্ছে না। এতে ব্যবসায়ীদের নগদ টাকার প্রবাহ কমে গেছে। আয় ও ব্যয়ের হিসাবে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের ব্যবধান। এতেই ব্যাংকের ঋণের কিস্তি পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে তারা।

করোনা মহামারির কারণে এর আগে ঋণ পরিশোধে বড় ছাড় দিয়ে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, যা চলতি বছরে তুলে নেওয়া হয়। এর ফলে দুই বছর ঋণ পরিশোধ না করেও অনেকেই ভালো গ্রাহকের তালিকায় ছিল। আর এখন ছাড় উঠে যাওয়ার পর অনেকেই ঋণ পরিশোধ করছেন না। আবার যেসব ঋণ ইতিপূর্বে খেলাপি হওয়ার কারণে পুনঃ তফসিল করা হয়েছিল, সেই ঋণের কিস্তিও শোধ হচ্ছে না। এতেও বাড়ছে খেলাপি ঋণ। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করছে।

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও ব্যাংক খাতকে খলনায়ক হিসেবেই মনে করা হয়েছে। সুশাসনের প্রচণ্ড দুর্বলতা আর্থিক খাতে বড় বড় কেলেঙ্কারির জন্ম হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে সাধারণ মানুষের, আমানতের নয়-ছয় হয়েছে। লাভবান হয়েছেন কেবল ঋণখেলাপিরাই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহল থেকে ঋণখেলাপিদের ব্যাংক ডাকাত বলা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্রীয় পোষকতা বন্ধ হয়নি কখনোই। ফলে কেবলই বাড়ছে খেলাপি ঋণ।-প্রথম আলো