অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস: লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতি ৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস: লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতি ৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমলেও লেনদেন ভারসাম্যের বা ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) ঘাটতি বেড়েই চলেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বিওপির ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৩৮ কোটি ডলার বা ৬ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এ ঘাটতি ৪ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার বেশি। অর্থনীতির এ গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশকের বড় ঘাটতি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে আরো বেশি চাপে ফেলেছে।

২০২১-২২ অর্থবছরজুড়ে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে টালমাটাল পরিস্থিতি পার করেছে বাংলাদেশ। রেকর্ড ৮৯ বিলিয়ন ডলারের আমদানির ধাক্কায় বাণিজ্য ঘাটতিতে ইতিহাস সৃষ্টি হয়। ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতির পাশাপাশি সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতিও ৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। যদিও ২০২০-২১ অর্থবছর ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত ছিল বাংলাদেশের বিওপি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অর্থবছর শেষে বিওপিতে যে ঘাটতি ছিল চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেই তার চেয়ে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বিওপির ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ বিলিয়ন ডলার। আর চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বিওপির ঘাটতির পরিমাণ ৬ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। তবে বিওপির ঘাটতি বাড়লেও বাণিজ্য ঘাটতি ও চলতি হিসাবের ভারসাম্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে।

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে সরকারের চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতির পরিমাণ ৫ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। দেশের আমদানি প্রবৃদ্ধি কমে আসায় বাণিজ্য ঘাটতি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। গত অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতি ১১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানির নতুন ঋণপত্র (এলসি) খোলা কমলেও আগের এলসি নিষ্পত্তি বাড়ছে। রফতানিতে প্রায় ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে এসেছে। এ কারণে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি বড় হচ্ছে। গত অর্থবছরের রেকর্ড আমদানির দায় পরিশোধের চাপে বৈদেশিক বাণিজ্যের রিজার্ভও ধারাবাহিকভাবে কমছে। সব মিলিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ও শঙ্কা কাটিয়ে উঠতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে।

চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে আমদানির নতুন এলসি খোলা ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ কমেছে। নতুন এলসি খোলা কমিয়ে আনতে পারাকে সফলতা হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, আমদানি এলসির লাগাম টেনে ধরতে পারাটি প্রাথমিক সফলতা। গত জুলাই থেকে আমদানির নতুন এলসি খোলার পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। এখন পর্যন্ত রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ ইতিবাচক ধারায় আছে। বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি ও চলতি হিসাবের ঘাটতি পরিস্থিতির উন্নতি এখন দৃশ্যমান। তবে আগে খোলা এলসি নিষ্পত্তি বাড়ার কারণে ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি বেড়েছে। আশা করছি, নতুন বছরে ডলারসহ বৈদেশিক বাণিজ্যে স্বস্তি ফিরে আসবে।

দেশের আমদানি নিয়ন্ত্রণে আনতে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই কঠোর নীতি গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিলাসপণ্যের এলসি মার্জিনের হার শতভাগে উন্নীত করা হয়। এর বাইরেও এলসি খোলায় জুড়ে দেয়া হয় নানা শর্ত। ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোও এলসি খোলা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। ফলে জুলাই থেকে নতুন এলসি খোলার পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। গত বছরের মার্চে দেশে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৯৮০ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরে এসে নতুন এলসির পরিমাণ ৫৭০ কোটি ডলারে নেমে আসে। এরপর নতুন এলসি খোলার পরিমাণ আরো কমে মাসে ৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। তবে এলসি খোলার পরিমাণ কমলেও নিষ্পত্তি বেড়েছে। শুধু অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেই আমদানির এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছে ৩১ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

রেকর্ড এ এলসি নিষ্পত্তির চাপেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে ১১৪ টাকা পর্যন্ত ওঠে। আর খুচরা বাজারে ডলারের দাম উঠে যায় ১২০ টাকা পর্যন্ত। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর অবস্থানের কারণে ডলারের দাম বর্তমানে কিছুটা কমে এসেছে। গতকাল ব্যাংক খাতে প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ বিনিময় মূল্য ছিল ১০৪ টাকা ৩৫ পয়সা।

আমদানি দায়ের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য অব্যাহতভাবে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে প্রায় সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়। শুধু ২০২২ সালেই রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করতে হয়েছে। এতে চাপের মুখে পড়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়নে উন্নীত হওয়া রিজার্ভের পরিমাণ এখন ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। তবে চলতি সপ্তাহেই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১১২ কোটি ডলারের দায় পরিশোধ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে রিজার্ভের পরিমাণ ৩২ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন বৈদেশিক বাণিজ্যকে ঘিরে সৃষ্ট চাপ ও শঙ্কা সহসা কাটবে না। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘গত অর্থবছরে বৈদেশিক বাণিজ্য ও চলতি হিসাবে যে ঘাটতি আমরা দেখেছি, সেটি নজিরবিহীন। এখন আমদানি দায় ও বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপে ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি রেকর্ড ছাড়াচ্ছে। এ ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্নমুখী তত্পরতার কারণে আমদানি ঋণপত্র খোলা কিছুটা কমেছে। কিন্তু ঋণপত্রের নিষ্পত্তি এখনই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না। গত অর্থবছরে রফতানিতে যে প্রবৃদ্ধি দেখা গিয়েছিল, সেটি এ বছর থাকছে না। বিদ্যমান বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতির কারণে রফতানির পাশাপাশি রেমিট্যান্স প্রবাহও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতার কারণে দেশে ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। রিজার্ভসহ ডলারের বাজারে যে সংকট ও অনিশ্চয়তা চলছে, সেটি সহসা কমবে বলে মনে হয় না। আমদানির নতুন ঋণপত্র কমিয়ে আনতে পারাটি প্রাথমিক সফলতা। তবে এটি নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার সুযোগ নেই। আরো কোন কোন পদক্ষেপ নিলে রফতানি ও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি বাড়ানো যাবে, সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে সামগ্রিক পরিস্থিতি পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।’-বণিক বার্তা